মলাট বৃত্তান্ত
টেলিভিশনের ভূত ভবিষ্যৎ
একটা সময় ছিল মানুষ আমাদের ধরে, পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে পারলে ধন্য হতো। * এখন মানুষ যে আমাদের ঘরে রাখে, এতেই আমরা ধন্য।
ইমন চৌধুরী
প্রকাশ: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
জন লগি বেয়ার্ড নামে এক ব্রিটিশ বিজ্ঞানী কথা নেই বার্তা নেই ১৯২৬ সালের কোনো একদিন বেমক্কা টেলিভিশন আবিষ্কার করে বসলেন। দুনিয়া পেল বিনোদনের এক আজব যন্ত্র! কারও মতে জাদুর বাকসো! কত কী দেখা যায়! কত কী শোনা যায়! আবিষ্কারের পর থেকে টেলিভিশন হয়ে উঠল এক ব্যস্ত যন্ত্র। আর লগি সাহেবের সম্মানে প্রতি বছর ২১ নভেম্বর পালিত হয় বিশ্ব টেলিভিশন দিবস। কিন্তু কে জানত এক শতাব্দী পর জাদুর এ বাকসোটা বেকার হয়ে পড়বে। বেকারই বটে। মোবাইলের দৌরাত্ম্যে টিভি এখন কোণঠাসা।
আশির দশকে আমাদের বাসায় একটা টেলিভিশন ছিল। সম্ভবত একুশ ইঞ্চি। চার পায়ের একটি কাঠের বাকসোতে বন্দি জীবন কাটাত সেটি। যে সময়ের কথা বলছি সেই যুগটা ছিল সাদা-কালোর যুগ। তখন টেলিভিশন সাদা-কালো হলেও আমাদের জীবন ছিল রঙিন। এখন টেলিভিশন রঙিন হয়েছে। কিন্তু জীবন হয়ে পড়েছে যেন সাদা-কালো। রীতিমতো কালার লেস!
সে সময় কোনো এক বাসায় টেলিভিশন থাকলে গোটা বিল্ডিংয়ের সবার ওই একটা দিয়েই হয়ে যেত। সন্ধ্যা হলে ছেলে-বুড়ো-মহিলারা সবাই দলবেঁধে সেই বাসায় হাজির হতেন টিভি দেখতে। গৃহকর্ত্রী আনন্দ চিত্তে সবার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিতেন। চা খেতে খেতে, গল্প-গুজব করতে করতে চলত টিভি দর্শন। আজব যন্ত্র! যন্ত্রের ভেতর ঘোরাঘুরি করে মানুষজন! এত ছোট জায়গায় এত বড় বড় মানুষ কী করে জায়গা করে নিত অবাক হয়ে ভাবতাম আমরা। মাঝে মাঝে টেলিভিশনের পেছনে গিয়ে উঁকিঝুঁকি মেরে টিভির ভেতরের মানুষদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতাম।
একটা গোটা কলোনিতে বা মহল্লায় হয়তো দু’চার ঘর টিভি থাকত সে সময়। এখন ঘরে ঘরে টিভি, রুমে রুমে টিভি। একলা ঘরে শুয়ে, বসে, হাঁটু ভাঁজ করে, কাত হয়ে, উপুড় হয়ে, চিত হয়ে টিভি দেখেন লোকজন। একের পর এক চ্যানেল পাল্টান। রিমোর্টটা কিছুতেই হাতছাড়া করতে চান না। অথচ মনোযোগ দিয়ে কিছু দেখেন বিষয়টি এমনও না। সময়ের সঙ্গে আমাদের চিত্ত অস্থির হয়ে গেছে। আমরা কোথাও স্থির থাকতে রাজি না এখন। তাই এখন অনেকে টিভি দেখাও ছেড়ে দিয়েছি। এখন শুয়ে, বসে, হাঁটু ভাঁজ করে, কাত হয়ে, উপুড় হয়ে, চিত হয়ে টিভির পরিবর্তে মোবাইল দেখি। মোবাইলও বোধহয় অবাক হয়ে আমাদের দেখে।
মাঝে মাঝে বেচারা জন লোগি বেয়ার্ডকে মনে পড়ে। ভদ্রলোক টেলিভিশন উদ্ভাবন করেছেন বটে! কিন্তু তার বিবর্তন দেখে যেতে পারেননি। অবশ্য যখন তিনি এটি উদ্ভাবন করেন তখন যন্ত্রটির নাম রেখেছিলেন টেলিভাইজর। পুরোনো হ্যাটের বাক্স, এক জোড়া কাঁচি, কয়েকটা মোটা সুই, বাইসাইকেলের লাইটের লেন্স, চা পরিবহণের বাক্স, আঠা আর সামান্য মোমের সাহায্যে তিনি প্রথম টেলিভিশন উদ্ভাবন করলেন। বেয়ার্ড যখন টেলিভিশন উদ্ভাবনের ঘটনাটি তৎকালীন সংবাদপত্রগুলোকে জানাতে চাইলেন, তখন কিছু সংবাদপত্র মানতেই চায়নি যে কোনো রকমের তারের সংযোগ ছাড়া একটা বাক্সের মতো জিনিসে নানা রকমের ছবি দেখা যাবে। শুধু তাই নয়, দি ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকায় প্রচারের জন্য গেলে বেয়ার্ডকে পাগল বলে জোর করে অফিস থেকে বের করে দেওয়া হয়। তবু তিনি দমে যাননি।
আমরাও দমে যায়নি। অফুরন্ত দম নিয়ে টেলিভিশন দেখতে বসি। তারপর অস্থির চিত্তে একের পর এক চ্যানেল পাল্টাই। অচিরেই আমাদের দম ফুরিয়ে আসে। আর ঘরে যদি নানা বয়সের দর্শক থাকে তবে তো কথাই নেই। রিমোট নিয়ে শুরু হয় যুদ্ধ। গিন্নির সিরিয়াল, কর্তামশাইয়ের টক শো, পুত্রের খেলার চ্যানেল, এমনকি বাসার কাজের মেয়েটিও তার দাবি ছাড়তে নারাজ। সেও চায় বাংলা সিনেমার সময় কেউ যেন বিরক্ত না করে তাকে। সিনেমায় নায়কের দুঃখ দেখে তার চোখে পানি চলে আসে। সে চোখ মুছে, নাক মুছে। আহা টেলিভিশন! কিন্তু এ চিত্রও ফিকে হতে শুরু করেছে। দর্শকের এ অস্থিরতা এখন মোবাইলে এসে ঠেকেছে। দিন দিন টিভি হয়ে যাচ্ছে পর। মুঠোফোন দখল করে নিচ্ছে ঘর।
প্রিয় পাঠক, ভাবছেন টেলিভিশন নিয়ে এত কথার দরকার কী! না, দরকার নেই। আপাতত ভাবতে থাকুন টেলিভিশনের ভবিষ্যৎ কী? প্রশ্নটা একজনকে করতেই মুচকি হেসে তিনি বললেন, ‘ভবিষ্যতেরই কোনো ভবিষ্যৎ নেই! টেলিভিশনের আবার ভবিষ্যৎ!’