Logo
Logo
×

বিচ্ছু

মলাট বৃত্তান্ত

গোল্ড যখন ঘোলা পানিতে

সমবায় ব্যাংকের গ্রাহকদের ৭৩৯৮ ভরি স্বর্ণ বেচে দিয়ে হাওয়া হয়ে গেল লোকটা! এটা কীভাবে সম্ভব? * ভালো ম্যাজিশিয়ান হলে সবই সম্ভব!

Icon

শফিক হাসান

প্রকাশ: ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আচানক নোমান মামা রসের সিন্ধু হয়ে উঠলেন কীভাবে, জেরবার হচ্ছি ভেবে ভেবে। নির্বিকার মামা গুনগুন করে একই গান গেয়ে শোনান-সোনা সোনা লোকে বলে সোনা/ সোনা নয় তত খাঁটি/ তার চেয়ে বেশি খাঁটি/ আমার বাংলাদেশের মাটি...। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত হয়ে গাইছেন, বিশ্বাস করাতে পারি না নিজেকে। ক্ষুদ্রাকারে হলেও তার ব্যবসায়ী চেহারাটি আমি দেখেছি। লাভ আর লোভ ছাড়া অন্যকিছুতে মন নেই বললেই চলে। সবসময় সাদাসিধে জীবনযাপন করা মামার পোশাক থেকে এখন ভুরভুর করে পারফিউম সুগন্ধ ছড়ায়।

কোন গ্রামে নাকি তিনি নতুন ব্যবসা ফেঁদে বসেছেন। ব্যবসা করতে গ্রাম থেকে মানুষ শহরে আসে, মামা গেলেন গ্রামে! কেমন ব্যবসা! হদিস করতে না পেরে নিজেকে বুঝ দিয়েছি অতীত ইতিহাসের আলোকে। শিক্ষাখাতে যখন নকলের স্বর্ণযুগ ছিল, উচ্চশিক্ষার্থে দলে দলে ছেলে-মেয়ে গ্রামযাত্রা করত। শহরের কলেজগুলোতে অনেক কড়াকড়ি, সে তুলনায় গ্রাম স্বস্তিদায়ক। মামা ডাবল এম.এ করার জন্য আবার গ্রামমুখী হননি তো! অবশ্য চাইলেও এখন ছক্কা হাঁকানো যায় না। নিরন্তর ভাবনা ও জিজ্ঞাসার তৃতীয় সপ্তাহের মাথায় মামা সদয় হলেন। এক সকালে বললেন, ‘চল তবে।’

‘কোথায়?’

‘শিক্ষাসফরে। সেখানে সিলেবাসের বাইরের পাঠ পাবি।’

মামার সঙ্গে যেই না রাস্তায় দাঁড়ালাম, কোত্থেকে যেন সাঁই করে এসে সামনে দাঁড়াল একটি প্রাইভেট কার। মামা উঠে বসলেন, বিমূঢ় আমাকে পাশে নিয়ে। চালক প্রশ্ন করল, ‘কোথায় যাব, স্যার?’ ‘মুকুন্দপুর করপোরেট অফিসে।’

তলে তলে এতকিছু! বুঝতেও পারিনি। গ্রামের রাস্তায় তেমন ভিড় হয় না। অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। মামা যখন আমাকে নিয়ে বিরাট একটি অফিসে প্রবেশ করলেন, লোকজন অকাতরে সালাম দিতে লাগল। বসে থাকা মানুষ সম্মান দেখিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। এলাহি কান্ডকারখানা! চমৎকার ডেকোরেশনের অফিসকক্ষে ঢুকে মামার নেমপ্লেট দেখেও ভিমরি খাওয়ার দশা হলো।

চেয়ারম্যান

নোমান হোসেন লোকসেবা ব্যাংক (এনএইচএলবি)

কথা বলার মতো একটা ইস্যু মিলল। সমীহভাব গলায় ঢেলে বললাম, ‘সবাই প্রতিষ্ঠানের নামে লেখে জনসেবা। আপনি লোকসেবা লিখলেন কেন!’

মামা হেসে বললেন, ‘পার্থক্যটা এখানেই। অন্যরা জনসেবা করুক, আমাকে লোকসেবাই করতে হবে। মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণে দরকার নতুন কিছু ভিন্নতর কৌশল।’

ইতস্তত করে বললাম, ‘কী ব্যবসা আপনার?’

‘যৌথ ব্যবসা। জামানতহীন ঋণদান, সোনা বন্ধক রাখার অননুমোদিত ব্যাংক।’

‘এজন্যই কি সোনার গানটা ঘনঘন গাইতে হয়?’

‘নারে পাগল। যে কোনো ব্যবসা করাই আমার জন্য সহজ। সব ব্যবসার অভিন্ন গান। দেশটা সোনাদানায় মোড়ানো।’

‘তাহলে মানুষের দুঃখ-কষ্ট যায় না কেন? তরকারি, ডিম ও গ্যাসের দাম ফের বাড়ল!’

‘বুদ্ধি সবার সমান নয়! বুদ্ধি থাকলে উপবাস থাকতে হয় না। বছর দুয়েকের মাথায় আমি হাজার কোটি টাকার মালিক হয়ে যাব। তখন তুই-ই আমাকে মামা না বলে স্যার ডাকবি!’

‘বলেন কী, স্যার? আলাদিনের দৈত্য বশ্যতা স্বীকার করেছে নাকি?’

‘শত-হাজার চেরাগের জন্ম আমিই দিই। নতুন প্রবাদ সৃষ্টি করেছি আঙুল ফুলে তালগাছ!’

অবাক আমি বেকুব হয়ে উঠছি। তবুও প্রশ্ন থামালে চলবে না- ‘আপনার ব্যবসার ধরন কী?’

‘সবকিছু ডাবল ডাবল। মনে কর, কেউ আমার প্রতিষ্ঠানে ২০ ভরি স্বর্ণ জমা রাখল। পাঁচ বছর পরে ৪০ ভরি ফেরত পাবে। আবার কেউ এক লাখ টাকা সঞ্চয় করলে দুই লাখ পাবে।’

‘এমন সুবিধা তো আরও প্রতিষ্ঠানও দিচ্ছে। তবে লোকে আপনার কাছে কেন আসছে দলে দলে?’

আত্মপ্রসাদের হাসি হাসেন মামা-‘কৌশলটা এখানেই। কেউ যদি দুইদিন পরও অ্যাকাউন্ট ক্লোজ করতে চায়, সেও দ্বিগুণ সোনাদানা-অর্থকড়ি পেয়ে যাচ্ছে।’

‘দুইদিনের জন্য কেউ অ্যাকাউন্ট খোলে নাকি?’

‘বিপদ বলে-কয়ে আসে না। গত মাসেও ৬০০ গ্রাহক বিপদে পড়েছে। তাদের সাহায্য করেছি। অবশ্য বিপদে ফেলেছিলাম আমিই!’

‘মানে ত্রাণকর্তা নাটক!’

‘নয়তো কী! খবরগুলো যখন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল লাখ মানুষ এসে ভিড় জমাতে শুরু করল। সবাই গ্রাহক হতে চায়। আমিও নিত্যনতুন শাখা খুলে কূল পাচ্ছি না! তোকে একটা শাখার ম্যানেজার বানিয়ে দিই?’

‘ছি, মামা। মানুষকে নিয়ে এমন খেলা অশোভন।’

‘তোরা পড়ে থাক সি গ্রেডের মূল্যবোধ নিয়ে। এই ফাঁকে আমি সেরা ধনী হয়ে যাব।’

কাগজের প্রথম পাতায় ছবি ছাপা হলে কে না খুশি হয়! অথচ আমি বেজারই হলাম। নোমান মামার ছবির সঙ্গে শীর্ষ সংবাদের শিরোনাম-গ্রাহকের ২৭ হাজার ভরি সোনা ও সাড়ে ১২শ কোটি টাকা লোপাট করলেন স্বয়ং ব্যাংক চেয়ারম্যান!

মনে পড়ল, মামার কাছ থেকে শোনা শেষ উক্তিটা-লোকে ঘোলা জলে মাছ শিকার করে আর আমি ঘোলা জলে গোল্ড! এই দেশের মাটিই খাঁটি, এখানকার মানুষকে প্রলোভনে ফেলে সহজেই ধোঁকা দেওয়া যায়...।

আহা, আমজনতা বিপদে পড়েই এসব প্রতিষ্ঠানে আসে; কেউবা ভবিষ্যতের আশায়। সেখানেও কেন এমন জালিয়াতি হবে। এখন দেখছি আমাকেও গা-ঢাকা দিতে হবে। লোভে পড়ে গতমাসে একটি শাখার ম্যানেজার পদে যোগদান করেছিলাম!

shafique_hasan79@yahoo.com

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : সাইফুল আলম

প্রকাশক : সালমা ইসলাম