
প্রিন্ট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫০ এএম
সংকটে চিড়েচ্যাপটা শিল্প খাত
গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধিতে মহাবিপদ সংকেত
এভাবে উৎপাদন খরচ বাড়লে নতুন বিনিয়োগ তো আসবেই না; বরং বিদ্যমান শিল্পপ্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে পড়বে * বিনিয়োগ সম্মেলন এবং গ্যাসের দাম বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
গ্যাসের দাম বাড়ানোর ফলে এবার শিল্প খাতের জন্য একেবারে যেন মহাবিপদ সংকেত নেমে এসেছে। এমনিতে নানামুখী সংকটে দেশের শিল্প খাতের যখন চিড়েচ্যাপটা অবস্থা, তখন সরকারের এমন সিদ্ধান্তে শিল্পোদ্যোক্তারা একরকম দিশেহারা। অকাট্য যুক্তি থাকলেও বিদেশি ক্রেতারা পণ্যের দাম বাড়াতে রাজি নন, উলটো দাম কমানোসহ কমিশন পেতে চান। এর মধ্যে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ঘোষিত নতুন ট্যারিফ প্ল্যান নিয়েও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার পারদ তুঙ্গে। এ অবস্থায় গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত কেউ মেনে নিতে পারছে না। ভুক্তভোগী শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীদের অনেকে যুগান্তরকে জানিয়েছেন, নতুন করে বিনিয়োগ করা তো দূরের কথা, বিদ্যমান বিনিয়োগ ও ব্যবস্যা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে।
ঋণের উচ্চসুদ, নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস-বিদ্যুতের অভাব, ট্রাম্পের নতুন ট্যারিফ প্ল্যান, স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ, রপ্তানি পণ্যের মূল্য হ্রাস, ভারতের ট্রানজিট সুবিধা বন্ধসহ নানামুখী চাপে দেশীয় শিল্পমালিকরা চাপের মধ্যে রয়েছেন। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) চাপে সর্বত্র উলটো নীতি গ্রহণ করায় সংকট দিনদিন আরও ঘনীভূত হচ্ছে। এ কারণে নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, বিদ্যমান বিনিয়োগ টিকিয়ে রাখতে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করতে হচ্ছে। অর্থনীতিবিদ ও শিল্পমালিকরা মঙ্গলবার যুগান্তরকে এসব কথা বলেছেন।
আইএমএফ ৪৭০ কোটি ডলার ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি ছাড়ে মোটা দাগে বাংলাদেশকে ৩টি শর্ত দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে-জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো, কর-জিডিপি অনুপাত দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি বা রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রার অতিরিক্ত ৫৭ হাজার কোটি টাকা আদায় এবং মুদ্রা বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) রোববার গ্যাসের দাম ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে আদেশ জারি করে। এখন ক্যাপটিভ বিদ্যুতের নতুন গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারে ৪২ টাকা দিতে হবে, যা আগে ছিল ৩১ টাকা। শিল্পের নতুন গ্রাহকদের দাম প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৩০ টাকা। মাঝারি শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ৩০ থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে। নতুন এ দাম ১৩ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়েছে। অর্থাৎ এ তারিখের পর থেকে যত গ্যাস সংযোগ অনুমোদন করা হবে, তাদের বাড়তি দাম দিতে হবে। এর আগ পর্যন্ত যেসব সংযোগ আবেদনের চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে নতুন দাম দিতে হবে। আর পুরোনো শিল্পগ্রাহকরা অনুমোদিত লোডের বাইরে যতটুকু ব্যবহার করবেন, ততটুকুর জন্য নতুন হারে দাম দিতে হবে। এর আগে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। তাতেও নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি পাননি শিল্পমালিকরা।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পলিসি রেট বাড়ানোর পর তা ধরে রেখেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে হুহু করে বাড়ছে ব্যাংক ঋণের সুদ। বর্তমানে শিল্প ঋণে সুদহার ১৩-১৫ শতাংশের কাছাকাছি। ব্যাংকগুলো তারল্য সংকট মেটাতে উচ্চ সুদে আমানত সংগ্রহ করায় তা সুদহারে প্রভাব ফেলছে।
এ তো গেল অভ্যন্তরীণ দেশীয় চাপ। আন্তর্জাতিকভাবেও চাপে আছেন রপ্তানিমুখী শিল্পমালিকরা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নির্বাচিত হওয়ার পর একাধিক নির্বাহী আদেশ জারি করেছেন। সর্বশেষ তার রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ প্ল্যান বা পালটা শুল্কারোপ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক শৃঙ্খলায় অস্থিরতা তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাশাপাশি এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে উন্নত বিশ্বে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের অগ্রাধিকারমূলক বাজার প্রবেশাধিকার সুবিধাগুলো সংকুচিত হবে। এতে তৈরি পোশাককে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পড়তে হবে। কারণ, প্রতিযোগী দেশ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও ভারত তৈরি পোশাকের বাজার ধরতে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে।
শিল্পমালিকরা বলছেন, সরকার মুখে মুখে বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিচ্ছে। কিন্তু নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে করছে ঠিক তার উলটো। যেমন: আইএমএফ-এর পরামর্শে ইতোমধ্যে এনবিআর শিল্পের করছাড় সুবিধা কমিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী সময়ের প্রস্তুতির অংশ হিসাবে ফিনিশড পণ্যের শুল্কহার কমিয়ে আনতে চাইছে। করছাড় না থাকলে এবং ফিনিশড পণ্যের শুল্ক কমানো হলে দেশে কখনোই শিল্পায়ন হবে না। এতে নতুন কর্মসংস্থানও হবে না। নতুন বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান না হলে সর্বোপরি দেশের রাজস্ব আদায়ও কমবে। অন্যদিকে রোববার নতুন সংযোগ গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। এতে নতুন বিনিয়োগের পথ রুদ্ধ হলো। পুরোনো উদ্যোক্তারাও কারখানা সম্প্রসারণে বিনিয়োগ করবে না। কারণ, রপ্তানিমুখী শিল্পমালিকরা এখনই গ্যাসের পরিবর্তে বাতাসের দাম দিচ্ছে। দিনের বড় একটি অংশ নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়ায় গ্যাসের চাপ থাকে না। তারা বলছেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকদিন ধরে নীতি সুদহার বাড়িয়ে রেখেছে। এতে ব্যাংক ঋণের সুদহার বেড়েই চলছে। উচ্চ নীতি সুদ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হলেও অজ্ঞাত কারণে সরকার এই ফর্মুলা এখনো ব্যবহার করছে। তারল্য সংকট থাকায় এবং উচ্চ সুদের কারণে ব্যাংকগুলো শিল্পের কাঁচামাল ও ভোগ্যপণ্যে ঋণপত্র খুলতে কালক্ষেপণ করছে, যা প্রকারান্তরে মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিচ্ছে। সরকারি দপ্তরগুলোর নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য তো আছেই।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি একে আজাদ বলেন, হঠাৎ করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে দেশে-বিদেশে খারাপ বার্তা যাবে। নতুন বিনিয়োগকারীরা আগ্রহ দেখাবেন না। ফলে দেশে শিল্প-কলকারখানা স্থাপনে স্থবিরতা নেমে আসবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমনিতেই আমাদের পণ্যে সাড়ে ১৫ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। এর সঙ্গে সম্প্রতি আরও ১০ শতাংশ যোগ হয়েছে। এতেই আমরা অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। এরপর গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি আমাদের দারুণভাবে হতাশ করেছে। আমরা এমনিতেই প্রতিযোগিতা থেকে পিছিয়ে পড়ছি, এতে আমাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা আরও কমে যাবে। এখন তো সরকার ঠিকমতো গ্যাসই দিতে পারছে না। প্রায়ই মিটার জিরোতে চলে আসে। উৎপাদন ঠিক রাখতে আমাদের ডিজেলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সব মিলিয়ে যে পরিমাণ খরচ বাড়বে, তার ভার বহন করার ক্ষমতা শিল্পের নেই।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, সময়মতো গ্যাসকূপ খননের উদ্যোগ না নেওয়ায় শিল্পকে তার মাশুল দিতে হচ্ছে। সরকার এলএনজি আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে, যা মূলত একটি অলিগার্ক শ্রেণিকে লাভবান করেছে, আগের সরকারও এই পথেই হেঁটেছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বর্তমান সরকারও একই পথে হাঁটছে বলে মনে হচ্ছে। এখন সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, তারা কি দেশের শিল্প খাতকে ধ্বংস হতে দেবে, নাকি এগুলোকে রক্ষা ও উন্নয়নে পদক্ষেপ নেবে? রাসেল আজিজ আরও বলেন, বিদ্যুৎ ও জ্বালানির নিশ্চয়তা ছাড়া বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা অসম্ভব। কিন্তু আমরা যখন বারবার গ্যাসের দাম বাড়াচ্ছি, তখন বিনিয়োগকারীরা কীভাবে আসবে? এই ধরনের মূল্যবৃদ্ধি নতুন বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করবে। ফলে নতুন কর্মসংস্থানও ব্যাহত হবে। তিনি আরও বলেন, যে কোনো পরিস্থিতিতে এই মূল্যবৃদ্ধি গ্রহণযোগ্য নয়। বিপিসি, তিতাস এবং এ ধরনের সংস্থাগুলো মুনাফাভিত্তিক মানসিকতা নিয়ে চলছে। এ কারণে গ্যাসের দাম কমছে না। অথচ মুনাফা না করলে গ্যাসের দাম কমিয়ে ২০ টাকার মধ্যে আনা সম্ভব।
বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, নতুন সংযোগে গ্যাসের দাম বাড়ানো মানে সরকার চাচ্ছে না দেশে শিল্পায়ন হোক, উৎপাদন বাড়ুক। একতরফাভাবে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে।
নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে কেউ নতুন বিনিয়োগে যাবে না। বিদ্যমান রেটেই শিল্প হিমশিম খাচ্ছে। আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে নেওয়া এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জন্য কখনোই মঙ্গলজনক নয়। এটা অতীতেও বারবার প্রমাণিত হয়েছে। তারপরও এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে সরকার কেন গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল, সেটি কারও বোধগম্য নয়।
অর্থনীতিবিদরা যা বললেন : গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধিতে বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে উল্লেখ করে অর্থনীতির স্বার্থে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার পরামর্শ দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। মঙ্গলবার যুগান্তরকে তিনি বলেন, গ্যাসের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া বিনিয়োগের সঙ্গে সম্পৃক্ত এ ধরনের আরও বেশ কিছু উপকরণের দাম বেড়েছে। এটি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক নয়। তার মতে, এ সিদ্ধান্তের কারণে অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাধাগ্রস্ত হবে বিনিয়োগ। উৎপাদন নিরুৎসাহিত হবে। কমবে কর্মসংস্থান। তিনি বলেন, এমনিতেই বাংলাদেশে বিনিয়োগে নানা ধরনের জটিলতা রয়েছে। প্রতিযোগী দেশের তুলনায় খরচ বেশি। এ কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসতে চায় না। দেশি বিনিয়োগকারীদেরও নতুন বিনিয়োগে আগ্রহ কম। এ অবস্থা দীর্ঘদিন থেকে চলে আসছে। এরপর বিনিয়োগসংক্রান্ত উপকরণের দাম বাড়ানো হলে নতুন বিনিয়োগের সম্ভাবনা আরও কমবে। ফলে অর্থনীতির স্বার্থে বিষয়গুলো পুনর্বিবেচনা করা উচিত।
উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. এমকে মুজেরী বলেন, যে মুহূর্তে দেশে বিনিয়োগ আকর্ষণে জাঁকজমকপূর্ণভাবে সম্মেলন করা হলো, ঠিক তার পরপরই এ ধরনের সিদ্ধান্ত কাম্য নয়। এ সিদ্ধান্ত সাংঘর্ষিক।