
প্রিন্ট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১০:৫০ এএম

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
জেগে উঠেছিল প্রতিটি মেঠোপথ আর রাজপথ। সব জাতি আর শ্রেণি-পেশার মানুষ আনন্দ ভাগাভাগি করেছিল নির্বিঘ্নে-নির্দ্বিধায়। সারা দেশে ব্যাপক উৎসাহ আর উদ্দীপনায় উৎসবের সমারোহে কেটেছে পুরো একটা দিন। নতুন পোশাক আর ঐতিহ্যবাহী সব খাবারের পসরা ছিল সব জায়গায়। শোভাযাত্রা, লোকজ সংস্কৃতি, নাচে-গানে সোমবার পহেলা বৈশাখে বঙ্গাব্দ ১৪৩২ বরণ করে নিয়েছে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ, প্রতিটি জাতিগোষ্ঠী। এদিন ফ্যাসিবাদকালের সব জঞ্জাল মুছে ফেলে নতুন ও সমৃদ্ধিশালী এক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নে নেওয়া হয়েছে শপথ। সত্যিকারের গণতান্ত্রিক, অসাম্প্রদায়িক এবং বৈষম্যহীন দেশের জন্য জাতি তার আকাঙ্ক্ষা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা : পহেলা বৈশাখ উদযাপনের অন্যতম অনুষঙ্গ ছিল ‘বর্ষবরণ আনন্দ শোভাযাত্রা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চারুকলা অনুষদের আয়োজনে এ শোভাযাত্রার সামনে ছিল ‘ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি’ মোটিফ। শোভাযাত্রার শুরুতে স্বজাতীয় নাচে-গানে অংশ নিয়েছে ২৮টি জাতিগোষ্ঠী। এছাড়াও বৈশাখী পোশাকে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ ও বিদেশি নাগরিকরাও শোভাযাত্রায় অংশ নেন। সোমবার সকাল ৯টা ৩ মিনিটে শোভাযাত্রাটি চারুকলার সামনে থেকে শুরু হয়। এরপর এটি শাহবাগ মোড়, টিএসসি, শহিদ মিনার, দোয়েল চত্বর, বাংলা একাডেমির সামনের রাস্তা দিয়ে সাড়ে ১০টায় পুনরায় চারুকলা অনুষদে গিয়ে শেষ হয়।
এবারের শোভাযাত্রাকে শুধু বাঙালির নয়, বাংলাদেশের প্রাণের উৎসব হিসাবে আখ্যা দিয়েছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে ফারুকী বলেন, এটাকে আমরা অনেকদিন ‘বাঙালির প্রাণের উৎসব’ বানিয়ে রেখেছি। এটা শুধু বাঙালির প্রাণের উৎসব আর নয়; এটা ‘বাংলাদেশের প্রাণের উৎসব’। বাঙালি, চাকমা, মারমা গারোসহ সব জাতিগোষ্ঠী বর্ষবরণ পালন করে। ফলে আমরা এটিকে বাংলাদেশের উৎসব হিসাবে পালন করা শুরু করলাম। তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, এটা বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐক্য ও সম্মিলনের একটি বড় ধাপ। আমরা হয়তো ২০-৩০ বছর পর থাকব না; কিন্তু আজকের বছরটি স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কারণ, এরপর থেকে বাংলাদেশ এভাবেই চলবে।
উপদেষ্টা ফারুকী বলেন, এবারের শোভাযাত্রা রাজনৈতিক নয়। তবে একটি নির্দিষ্ট রাজনৈতিক গ্রুপ তাদের প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য এটাকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করেছে। এবার আমরা শুধু ফ্যাসিস্টের মুখাবয়ব ব্যবহার করেছি। কারণ, ফ্যাসিস্ট কোনো রাজনীতির অংশ নয়, ফ্যাসিস্ট সবচেয়ে বড় অশুভশক্তি। শোভাযাত্রার শুরুতে মারমা, ম্রো, চাকমা, বম, খুমি, ত্রিপুরা, পাঙখুয়া, রাখাইন, তঞ্চঙ্গ্যা, মণিপুরি, খাসিয়া, চা জনগোষ্ঠীসহ ২৮টি নিজস্ব জাতিগোষ্ঠী নাচ-গানে শোভাযাত্রায় অংশ নেয়। জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে ভাবুক দল নিয়ে অংশ নেন ফরহাদ মজহার।
জাতিগোষ্ঠীর পরের অংশে ছিল শোভাযাত্রার মূল দল। এতে সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান, উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) সায়মা হক বিদিশা, উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) মামুন আহমেদ, কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী প্রমুখ শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দেন। তাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার, বিভিন্ন ছাত্রসংগঠন অংশ নিয়েছে।
উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান বলেন, এবারের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একটু মুক্ত পরিবেশে আমরা একত্র হয়েছি। আমাদের সামনে নতুন সুযোগ এসেছে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড জাতি-ধর্ম-পেশা সব ক্ষেত্রে যত অবারিত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করা যায়।
এরপর হাতে বহনকারী ঘোড়ক দল অংশ নেয়। পরে প্রধান মোটিফগুলো রাখা হয়। মোটিফগুলোয় যথাক্রমে ফ্যাসিবাদের মুখাকৃতি, এরপর যথাক্রমে বাকি ছয়টি প্রধান মোটিফ-বাঘ, মাছ, পাঁচটি পাতার শান্তির পায়রা, পালকি, গণ-অভ্যুত্থানে মুগ্ধর ‘পানি লাগবে’, ৩৬ জুলাই, ফিলিস্তিনের প্রতি সংহতি জানিয়ে ‘তরমুজের ফালি’ রাখা হয়েছে।
মোটিফের পরে রাখা হয়েছে ১০০ ফুটের পটচিত্রগুলো। এর মধ্যে ছিল-পটচিত্র আকবর, পটচিত্র বেহুলা, গাজীর পট, পটচিত্র বনবিবি, পটচিত্র বাংলাদেশ ইত্যাদি।
এছাড়াও আপামর ছাত্রজনতা, ব্যান্ড দল, কৃষকদের একটি অংশ, রিকশা দল, ঘোড়ার গাড়ির দল অংশ নিয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ফিলিস্তিনে যুদ্ধ বন্ধের আহ্বানও ছিল। শোভাযাত্রার একদম শুরুতে ছিল ডিএমপির অশ্বারোহী দল। এছাড়াও র্যাব, পুলিশের সোয়াট টিম, প্রক্টরিয়াল টিম নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। শোভাযাত্রায় ‘হাসিনার বিচার কর’, ‘জুলাই গণহত্যার বিচার কবে?’, ‘ভারতের সঙ্গে সকল অসম চুক্তি বাতিল কর’, নদী বাঁচাও প্রভৃতি প্ল্যাকার্ড দেখানো হয়। এছাড়া মাঝারি-ছোট আকারের ১৪টি মোটিফ, নানা মুখোশ, চিত্র দেখানো হয়। শোভাযাত্রা ছাড়াও ঢাবিতে ছিল নানা আয়োজন। সকাল ৮টায় কলাভবনের সামনে বটতলায় বর্ষবরণের আয়োজন করা হয়। ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’ প্রতিপাদ্য নিয়ে বাংলা নববর্ষ ১৪৩২-কে স্বাগত জানিয়ে আয়োজনটি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ।
ছায়ানটের প্রভাতি আয়োজনে মুক্তির বার্তা : পহেলা বৈশাখের ভোরেই ছিল ছায়ানটের প্রভাতি আয়োজন। ভোরের আলো ফুটতেই রমনা বটমূলে ভৈরবীতে রাগালাপ দিয়ে ছায়ানটের ১৪৩২ বঙ্গাব্দবরণের সূচনা হয়। মঞ্চে সারি বেঁধে বসেন দেড় শতাধিক শিল্পী। সোয়া ৬টায় শুরু হয় এ বর্ষবরণের ৫৮তম আয়োজন। এরপর শুরু হয় গানপর্ব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, লালন ও বাংলাদেশের লোকজধারার বেশকিছু গান এ পর্বে জায়গা করে নেয়। একক ও সমবেত কণ্ঠের পরিবেশনায় গাওয়া গানগুলো হলো-তোমার চরণ তলে দিও মোরে ঠাঁই, নতুন প্রাণ দাও, তিমির দুয়ার খোলো, আপনারে দিয়ে রচিলি রে, তুমি প্রভাতের সকরুণ রবি, তুমি প্রভাতের সকরুণ ভৈরবী, ভেঙেছো দুয়ার এসেছো জ্যোতির্ময়, সকল কলুষ তামস হর জয় হোক তব জয়, তোর ভেতরে জাগিয়া কে যে-সহ আরও বেশকিছু গান। এর ফাঁকে আবৃত্তিশিল্পীরা কবিতা আবৃত্তি করেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে অনুষ্ঠানের শেষ হয় জাতীয় সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ দিয়ে।
ছায়ানটের বর্ষবরণ আয়োজনের অন্যতম দিক লিখিত বক্তব্য কিংবা বিশেষ বার্তা, যা বরাবরই পাঠ করে আসছিলেন সন্জীদা খাতুন। এবার ছায়ানটের হয়ে সেই বার্তা পাঠ করেন নির্বাহী সভাপতি ডা. সারওয়ার আলী। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শেষের আগমুহূর্তে শিল্পী ও দর্শনার্থীরা দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। পরে ছায়ানটের শিল্পীদের সমবেত কণ্ঠে জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মাধ্যমে ছায়ানটের এবারের বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শেষ হয়।
নীরবতা পালনের আগে ছায়ানটের নির্বাহী সভাপতি সারওয়ার আলী বলেন, ‘ফিলিস্তিনে, গাজায় ভয়াবহ মানবতার বিপর্যয় এবং গণহত্যায়, বিশেষ করে শিশু হত্যার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। ফিলিস্তিনবাসী আপন ভূমি রক্ষায় যে সংগ্রাম করছেন, তার প্রতি আমরা সংহতি জানাই। ইসরাইলের নির্বিচার হত্যাযজ্ঞে নিহত মানুষদের স্মরণে সবাইকে এক মিনিট নীরবতা পালনের অনুরোধ করছি।’
ড্রোন শোতে নতুন বাংলাদেশের প্রত্যয় : এবারের নববর্ষের আয়োজনের অন্যতম আকর্ষণ ছিল রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে ব্যতিক্রমী ড্রোন শো। নববর্ষ উদযাপনের অংশ হিসাবে সোমবার সন্ধ্যায় রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে এই আয়োজন হয়। ‘নতুন বছর, নতুন বাংলাদেশ’ থিমকে সামনে রেখে আয়োজিত শোতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা নতুন বাংলাদেশের এগিয়ে চলার প্রত্যয় জানানো হয়। ২ হাজার ৬০০ ড্রোনের মনোমুগ্ধকর প্রদর্শনীতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে সংসদ ভবনের আকাশ।
সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং ঢাকার চীনা দূতাবাসের কারিগরি সহায়তায় শিল্পকলা একাডেমি এই ড্রোন শো আয়োজন করে। একই সঙ্গে বিকালে আয়োজন করা হয় কনসার্টের। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিবিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।
সন্ধ্যা ৭টায় শুরু হওয়া ড্রোন শোতে সংসদের আকাশে ১২টি মোটিফ প্রদর্শনের মাধ্যমে জুলাই অভ্যুত্থানের শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। এতে জায়গা করে নিয়েছেন শহিদ আবু সাঈদ ও মীর মুগ্ধরা। নতুন করে নিজেদের বীরত্বগাথা তুলে ধরেছেন যেন তারা।
১৪ মিনিটের ড্রোন শোতে মুক্তির আনন্দ, জুলাই অভ্যুত্থানের সময় শহিদ আবু সাঈদের নির্ভীক আত্মত্যাগ, আন্দোলনে নারী, ঐতিহ্যবাহী বাংলাদেশি সংস্কৃতি, জাতীয় ঐক্য এবং চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব তুলে ধরা হয়। এছাড়াও ছিল ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতাসংগ্রামের সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের সংহতি প্রকাশ করে একটি দৃশ্য। ‘ড্রোন শো’ পরিচালনা করেন ১৩ জন চীনা পাইলট বা ড্রোন চালনাকারী বিশেষজ্ঞ। এর আগে বিকালে কনসার্ট শুরু হয় বান্দরবানের বেসিক গিটার লার্নিং স্কুলের পরিবেশনার মাধ্যমে। এরপর আরএনআর সংগীত পরিবেশন করে। সমবেত সংগীত ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি সব শিল্পী পরিবেশন করেন। ‘ব্যান্ড সংগীত’ পরিবেশন করে অ্যাশেজ ব্যান্ড দল।
চ্যানেল আই-সুরের ধারা হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ : প্রতিবছরের মতো এবছরও অনুষ্ঠিত হলো চ্যানেল আই-সুরের ধারা হাজার কণ্ঠে বর্ষবরণ। ধানমন্ডির রবীন্দ্র সরোবরে সূর্যোদয়ের সঙ্গে যন্ত্রসংগীতের মাধ্যমে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। দীপ্তি চৌধুরীর উপস্থাপনায় শিল্পী স্বাতী সরকারের পরিচালনায় সুরের ধারার শিল্পীরা একে একে পরিবেশন করেন তাদের পরিবেশনা। অতিথি শিল্পী হিসাবে সংগীত পরিবেশন করেন ফেরদৌস আরা। শিল্পী ফাহিম হোসেন, কিরণ চন্দ্র রায়, প্রিয়াংকা গোপ, অনন্যা আচার্য, শারমিনসহ তরুণ শিল্পীরাও তাদের সংগীত পরিবেশন করেন। ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিবেশনায় মুগ্ধতা ছড়িয়ে যায়। সমাপনী বক্তব্যে অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বলেন, আমরা এই একটি দিনই বাঙালি হয়ে যাই। আমরা বাঙালি হয়েই থাকতে চাই।