
প্রিন্ট: ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১:১৮ এএম
নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ল ৩৩ শতাংশ
১৩ এপ্রিল থেকে কার্যকর * অনুমোদিত গ্যাসের চেয়ে বেশি ব্যবহার করলে বাড়তি গ্যাসের জন্য নতুন দর কার্যকর হবে

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিল্পোদ্যোক্তাদের তীব্র আপত্তি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত বাড়ানো হলো গ্যাসের দাম। তবে আশার কথা, শিল্প খাতের পুরোনো গ্রাহকদের জন্য নতুন বর্ধিত দর দিতে হবে না। নতুন শিল্পের বয়লারে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি ১০ টাকা বাড়ানো হয়েছে। অর্থাৎ আগের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভে ৩১.৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪২ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির গড় হার ৩৩ শতাংশ। জ্বালানি খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত শিল্প খাতের জন্য আত্মঘাতী হবে।
এদিকে নতুন শিল্পের পাশাপাশি এখন যারা অনুমোদিত লোডের বেশি গ্যাস ব্যবহার করছেন-সেসব শিল্পপ্রতিষ্ঠানকেও অতিরিক্ত লোডের জন্য ৩০ টাকার পরিবর্তে ৪০ টাকা দরে বিল দিতে হবে। নতুন দর চলতি এপ্রিলের বিল থেকেই কার্যকর হবে।
রোববার বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন দর ঘোষণা করে। সংবাদ সম্মেলনে নতুন দর ঘোষণা করেন বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। এ সময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য মিজানুর রহমান, সদস্য সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া, মো. আব্দুর রাজ্জাক ও শাহীদ সারোয়ার।
এদিকে দাম বাড়ানো হলেও এর পক্ষে যৌক্তিক ব্যাখ্যা দিতে পারেনি বিইআরসি। মূল্যবৃদ্ধিতে সরকার কত টাকা বাড়তি আয় করবে, তা জানে না কমিশন। সাধারণত কোম্পানিগুলোর রাজস্ব চাহিদা হিসাব করে বিইআরসি। এরপর ঘাটতি পূরণে সরকার ঘোষিত ভর্তুকির ভিত্তিতে মূল্য সমন্বয় করা হয়। রাজস্ব চাহিদা যাচাই ছাড়া এভাবে মূল্যবৃদ্ধি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের পরামর্শে করা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বিইআরসি চেয়ারম্যান বলেন, মন্ত্রণালয়ের প্রেসক্রিপশনে করা হয়নি।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, বিদ্যমান গ্রাহকদের দর (শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা) অপরিবর্তিত থাকবে। প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের (ইতোমধ্যে অনুমোদিত) অর্ধেক বিল বিদ্যমান দরে, অর্ধেক ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়। অন্যদিকে নতুন শিল্প ও ক্যাপটিভে গ্যাসের দাম যথাক্রমে ৩০ ও ৩১.৭৫ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭৫.৭২ টাকা করা।
ক্যাবের জ্বালানি বিষয়ক উপদেষ্টা ড. শামসুল আলম বলেন, নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়ানো দেশের জন্য একটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই সিদ্ধান্তের ফলে দেশে নতুন শিল্প বিকশিত হওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। তিনি বলেন, গণশুনানিতে আমরা হিসাব করে দেখিয়ে দিয়েছিলাম দাম না বাড়িয়ে উলটো কমানো যায়। বিগত সরকার এ সেক্টরে যেসব লুণ্ঠনমূলক ব্যয় বাড়িয়ে দিয়েছিল সেগুলো কমালেই দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হতো না। বর্তমান সরকার ভোক্তাদের সুরক্ষা না দিয়ে সেই লুণ্ঠনমূলক ব্যয়ের অভিযোগের দায়ভার নিজেরা কাঁধে তুলে নিয়েছে।
পেট্রোবাংলার দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের ওপর ২৬ ফেব্রুয়ারি গণশুনানি গ্রহণ করে বিইআরসি। পেট্রোবাংলা তাদের প্রস্তাবে বলেছে, দাম না বাড়ালে বছরে প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি হবে। পেট্রোবাংলার সেই প্রস্তাব নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। শুনানিতেও ব্যবসায়ী ও ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারা তীব্র আপত্তি তোলেন। বিশেষ করে শিল্পে দুই ধরনের দর নির্ধারণ করার বিরোধিতা করেন সবাই। তারা বলেন, বিদ্যমান শিল্প চলতি দরে, আর নতুন শিল্পের জন্য বাড়তি দাম নির্ধারণ করা হলে অসম প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। একই দেশে শিল্পে দুই ধরনের দর আইনের দৃষ্টিতে অচল। তাই চ্যালেঞ্জ করার কথাও জানান তারা।
প্রসঙ্গত, পেট্রোবাংলা কয়েকটি উৎস থেকে গ্যাস কিনে থাকে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান সিলেট গ্যাস ফিল্ড কেম্পানি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানিকে প্রতি হাজার ঘনফুটের দাম দেওয়া হয় ২৮ টাকা এবং বাপেক্সকে দেওয়া হয় ১১২ টাকার মতো। দেশের খনি থেকে গ্যাস উত্তোলন করা বাংলাদেশ প্রতি হাজার ঘনফুট গ্যাস কিনে বহুজাতিক কোম্পানি শেভরনের কাছ থেকে ২.৭৬ ডলার এবং টাল্লোর কাছ থেকে ২.৩১ ডলারে। অন্যদিকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ৭ মাসে কাতার থেকে আমদানি করা এলএনজির দাম ১০.৬৬ ডলার ও ওমান থেকে আনা এলএনজির দাম পড়েছে ১০.০৯ ডলার। তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কয়েক দশকের স্থবিরতার কারণে আমদানির দিকে যেতে হয়েছে। অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা না হলে ভবিষ্যতে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে মনে করেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা।
সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ বলেন, দেশের মজুত প্রাকৃতিক গ্যাস কমার সঙ্গে সঙ্গে এলএনজি আমদানি বাড়তে থাকে। এলএনজির বাড়তি দাম দিতে গিয়ে চাপে পড়ে পেট্রোবাংলা। এ অজুহাতে তারা ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছিল। তবে গণশুনানিতে বেশির ভাগ অংশগ্রহণকারী এ প্রস্তাবে ঘোর আপত্তি জানান।
কিসের ভিত্তিতে দাম বাড়ানো হলো এমন প্রশ্নের জবাবে বিইআরসির চেয়ারম্যান বলেন, রাজস্ব চাহিদা ধরলে দাম অনেক বেশি বাড়াতে হতো। তাই ভোক্তার জন্য সহনীয় রাখতে ৩৩ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। এ ক্ষেত্রে ভর্তুকির হিসাবও করা হয়নি।
নতুন ও পুরোনো শিল্পে আলাদা দাম রেখে যে বৈষম্য তৈরি করা হয়েছে, এটা আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, বিইআরসির আইনি আওতার মধ্যে থেকেই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিনিয়োগ কমার বিষয়টা এখনই বলা যাবে না। নতুন বিনিয়োগে প্রভাব পড়বে কি না, তা নজরে রাখা হবে। নতুন যারা আসবেন, তারা যদি দেখেন তাদের পোষাবে, তাহলে তারা আসবেন। সমস্যা মনে করলে তারা বিকল্প জ্বালানিও ব্যবহার করতে পারেন।
দাম ঘোষণার সময় বলা হয়, শুনানিতে অংশগ্রহণকারীরা মূল্যবৃদ্ধির বিরোধিতা করে ‘সিস্টেম লস’ কমাতে বলেছিলেন। এটা দ্রুত কমানো খুব কঠিন। এ নিয়ে তাগাদা দেওয়া হয়েছে। এখন থেকে সব কোম্পানির আর্থিক প্রতিবেদন মূল্যায়ন করা হবে। পেশাদার নিরীক্ষক নিয়োগ করে আয়-ব্যয়ের যথার্থতা যাচাই করা হবে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় এলএনজি আমদানি বাড়াতে বলা হয়েছে।
বিইআরসির আদেশ বলছে, নতুন এ দাম ১৩ এপ্রিল থেকেই কার্যকর হবে। অর্থাৎ এই দিন থেকেই যত গ্যাস সংযোগ অনুমোদন করা হবে, তাদের বাড়তি দাম দিতে হবে। এর আগ পর্যন্ত যেসব সংযোগ আবেদনের চাহিদাপত্র ইস্যু করা হয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহারে নতুন দাম। আর পুরোনো শিল্প গ্রাহকেরা অনুমোদিত লোডের বাইরে যতটুকু ব্যবহার করবেন, ততটুকুর জন্য নতুন দাম দিতে হবে।
এর আগে নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শিল্পে ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয় শিল্পে গ্যাসের দাম। শিল্প ও ক্যাপটিভে প্রতি ইউনিটের দাম করা হয় ৩০ টাকা। পরে গত বছর ক্যাপটিভে দাম বাড়িয়ে করা হয় ৩১ টাকা ৫০ পয়সা।
ক্যাপটিভ পাওয়ার প্ল্যান্টে গ্যাসের নতুন হার : বিইআরসি জানায়, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ শ্রেণির ক্ষেত্রে গ্যাসের দাম একই হারে বাড়ানো হয়েছে। ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ গ্রাহকদের প্রতি ঘনমিটারে ৪২ টাকা দিতে হবে, যা পূর্বে ছিল ৩১ টাকা। ক্যাপটিভ শ্রেণির গ্রাহক বলতে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র বোঝায়। এছাড়া বর্তমান গ্রাহকরা যদি তাদের অনুমোদিত লোডের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করেন, তবে তাদেরও প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের জন্য দিতে হবে ৪২ টাকা। অন্যদিকে, ৫০ শতাংশের কম ব্যবহার করলে গ্যাসের মূল্য হবে প্রতি ঘনমিটার পূর্বের ৩১.৫০ টাকা।
শিল্প খাতে গ্যাসের নতুন হার : শিল্প খাতের নতুন ভোক্তাদের জন্য গ্যাসের দাম প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ৩০ টাকা। তবে পুরাতন শিল্প গ্রাহকরা তাদের পূর্বের অনুমোদিত লোডের চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করলে তাদের ক্ষেত্রেও গ্যাসের দাম হবে প্রতি ঘনমিটার ৪০ টাকা। এছাড়া যারা ৫০ শতাংশের কম ব্যবহার করবেন, তাদের জন্য গ্যাসের দাম পূর্বের মতোই ৩০ টাকা থাকবে।
মাঝারি শিল্পে মূল্য বৃদ্ধি : মাঝারি শিল্প খাতে গ্যাসের দাম ৩০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৪০ টাকা করা হয়েছে। যদি কোনো ভোক্তা পূর্বের অনুমোদিত লোডের চেয়ে ৫০ শতাংশের বেশি ব্যবহার করেন, তবে অতিরিক্ত ১০ টাকা হারে গ্যাসের মূল্য বাড়বে।