
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০২:১৫ পিএম

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, ব্যাপক উৎসাহ, আনন্দ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে সারা দেশে মুসলিমরা পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপন করেছেন। মুসলিমদের সবচেয়ে বড় এই ধর্মীয় উৎসব সোমবার পালিত হয়। এক মাসের সিয়াম সাধনার পর তারা ঈদ উদযাপন করেন। তবে প্রতিবছরের চেয়ে এবারের পরিবেশটা একটু ভিন্ন। তীব্র গণ-আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর প্রথম ঈদ। ফলে সারা দেশে বাড়তি উচ্ছ্বাস ও উদ্দীপনা ছিল। জমানো খুশি যেন উপচে পড়েছে। ঈদের দিনে হয়েছে সুলতানি ও মোগল আমলের কায়দায় ‘ঈদ আনন্দ র্যালি’। উৎসব পালনে সরকারের পক্ষ থেকে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তাও নিশ্চিত করা হয়।
সাপ্তাহিক বন্ধসহ টানা ছুটি পান অনেকে। এই লম্বা ছুটি ঈদ আনন্দকে আরও রাঙিয়ে তুলেছে। ঈদের নামাজ, খাওয়া-দাওয়া, বিনোদনসহ সবকিছুতেই বাড়তি উচ্ছ্বাস ছিল। ঈদের ছুটিতে ঢাকাসহ সারা দেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোয়ও তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। রোববার সন্ধ্যায় ঈদের চাঁদ দেখার পরই শুরু হয় শুভেচ্ছা বিনিময়। এ সময় রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা দেশবাসীকে পৃথকভাবে ঈদ শুভেচ্ছা জানান। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন শুভেচ্ছা বাণীতে বলেন, ‘ঈদুল ফিতর মুসলমানদের অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব। এ উপলক্ষ্যে আমি দেশে-প্রবাসে বসবাসকারী সব বাংলাদেশিসহ বিশ্ববাসীকে জানাই আন্তরিক শুভেচ্ছা ও মোবারকবাদ। মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, ঈদের এই আনন্দ যেন সবার মাঝে সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশবাসী ও বিশ্বের সব মুসলমানকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও ঈদ মোবারক জানিয়েছেন। শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি আরও বলেন, পরাজিত শক্তির সব প্ররোচনা সত্ত্বেও দলমত নির্বিশেষে সবাই যেন সুদৃঢ়ভাবে ঐক্যবদ্ধ থাকেন, সেজন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে হবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদ আনন্দের দিন হলেও বিগত বছরগুলোতে উৎসব পালনে ছিল নানা বিধিনিষেধ তথা কড়াকড়ি। ছিল ভয়, শঙ্কা ও গ্রেফতার আতঙ্ক। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক জোট ছাড়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের জন্য দিনটি বয়ে আনত চাপা কষ্ট ও আতঙ্ক। কারণ উৎসবের দিনেও তারা পরিবারের সঙ্গে স্বাধীনভাবে দিনটি উদযাপন করতে পারেননি।
সোমবার সকালে ঈদের নামাজ আদায়ের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা। কুশল বিনিময়, কোলাকুলি, স্বজনের কবর জিয়ারত, আত্মীয়স্বজনের বাড়ি বাড়ি ঘুরে সময় পার করেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। এছাড়া মোবাইল ফোনে এসএমএস, ফেসবুক, মেসেঞ্জার, ই-মেইলে সারা দিনই চলে শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময়। ঈদের দিন দেশের বিভিন্ন হাসপাতাল, কারাগার, সরকারি শিশুসদন, সামাজিক প্রতিবন্ধী কেন্দ্র, আশ্রয়কেন্দ্র, ভবঘুরে কল্যাণকেন্দ্র ও দুস্থ কল্যাণকেন্দ্রে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।
রাজধানীতে সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত জাতীয় ঈদগাহে অনুষ্ঠিত হয়। এবার ঈদগাহে ৩৫ হাজার নারী-পুরুষ নামাজ আদায় করেছেন। জাতীয় ঈদগাহে প্রধান জামাতে সর্বস্তরের মুসল্লিদের সঙ্গে ঈদের নামাজ আদায় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এতে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের খতিব মাওলানা মোহাম্মদ আবদুল মালেক ইমামের দায়িত্ব পালন করেন। সকাল সাড়ে ৮টায় প্রধান উপদেষ্টাকে স্বাগত জানান প্রধান বিচারপতি, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা এবং সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তাসহ বিশিষ্ট ব্যক্তি। নামাজ শেষে প্রধান উপদেষ্টা ঈদগাহে দেশবাসীর উদ্দেশে শুভেচ্ছা বক্তব্য এবং মুসল্লিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।
অন্যদিকে প্রতিবছরের মতো এবারও বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে পর্যায়ক্রমে ৫টি ঈদের নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়। সকাল ৭টায় অনুষ্ঠিত হয় প্রথম জামাত। ইমামের দায়িত্ব পালন করেন বায়তুল মোকাররমের পেশ ইমাম মাওলানা মুহিববুল্লাহিল বাকী। দ্বিতীয় জামাত অনুষ্ঠিত হয় সকাল ৮টায়। ইমামতি করেন সিনিয়র পেশ ইমাম মাওলানা মিজানুর রহমান। তৃতীয় জামাত সকাল ৯টায়। এতে ইমামতি করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম ড. মাওলানা ওয়ালিউর রহমান খান। সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত হয় চতুর্থ জামাত। ইমাম হিসাবে ছিলেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সম্পাদক ও অনুবাদক ড. মুশতাক আহমদ। সর্বশেষ জামাত অনুষ্ঠিত হয় বেলা পৌনে ১১টায়। এতে ইমামের দায়িত্ব পালন করেন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মুফতি মো. আব্দুল্লাহ।
ঈদের দিন বঙ্গভবনে বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। অন্যদিকে তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। এ সময়ে তিনি ঈদুল ফিতরের বার্তা ধারণ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নিতে সবার প্রতি আহ্বান জানান। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এবারের ঈদ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের একে অপরের কাছাকাছি যেতে হবে। কমিয়ে আনতে হবে দূরত্ব। দেশ ও সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে হবে। কারণ, এবার ঐক্যবদ্ধ হওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনা এখন জরুরি। এটি প্রতিদিন আমাদের মনে রাখতে হবে।’
ঈদ উৎসব নির্বিঘ্ন করতে রোববার রাত থেকে ঢাকার বিভিন্ন পয়েন্টে সতর্কাবস্থানে ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। সোমবার ভোর থেকে গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোয় অবস্থান নেয় পুলিশ। সকালে জিরোপয়েন্ট ক্রসিং, মৎস্য ভবন ক্রসিং, সরকারি কর্মচারী হাসপাতাল মোড়, দোয়েল চত্বর ক্রসিং, প্রেস ক্লাব লিংক রোড, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পেছনের গলি, ইউবিএল ক্রসিংয়ে নিশ্চিদ্র নিরাপত্তা ছিল।
এবারের ঈদে সুলতানি ও মোগল আমলের কায়দায় ঈদ আনন্দ র্যালি হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) আয়োজনে রাজধানীর আগারগাঁওয়ের পুরোনো বাণিজ্য মেলার মাঠে পবিত্র ঈদুল ফিতরের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। এরপর সবাইকে নিয়ে বের হয় এই বর্ণাঢ্য আনন্দ র্যালি। এটি আগারগাঁও থেকে শুরু হয়ে মানিক মিয়া এভিনিউতে জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজার সামনে গিয়ে শেষ হয়। পরে সেখানেই অনুষ্ঠিত হয় একটি সংক্ষিপ্ত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সেখানে সেমাই ও মিষ্টি দিয়ে আগত সবাইকে আপ্যায়ন করা হয়। এই জামাত ও আনন্দ র্যালিতে অংশ নেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া। পরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মঞ্চে তিনি গণ-অভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের স্মরণ করেন। তিনি বলেন, এবারের ঈদটাকে সত্যিকার অর্থেই ঈদ মনে হচ্ছে। ঢাকার যে ঐতিহ্যবাহী ঈদ মিছিল, সেটা হয়তো কয়েকশ বছর পর আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে। আগামী দিনে প্রতিবছর এভাবেই নগরবাসী এক হয়ে ঈদ উদযাপন করবেন।