
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৩:৫৬ পিএম
সেভেন সিস্টার্স নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নতুন নয়: খলিলুর রহমান

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ০৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

আরও পড়ুন
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্প্রতি চীন সফরে গিয়ে ‘সেভেন সিস্টার্স’খ্যাত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় সাতটি রাজ্য নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন, তা নতুন নয়। এর আগেও তিনি একাধিকবার একথা বলেছেন। বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলিসংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমান এসব কথা বলেন। প্রধান উপদেষ্টার ওই মন্তব্য নিয়ে ভারতের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল প্রতিক্রিয়া দেখানোর পর এই ব্যাখ্যা দিলেন তিনি।
২৮ মার্চ বেইজিংয়ের ‘দ্য প্রেসিডেন্সিয়াল’-এ চীনা ব্যবসায়ী নেতাদের সঙ্গে এক সংলাপে ড. ইউনূস বাংলাদেশে ব্যবসার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চীনা ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি এ সময় বঙ্গোপসাগর ঘিরে বাণিজ্য ও ব্যবসা সম্প্রসারণে সম্ভাবনার কথা তুলে ধরেন। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, নেপাল ও ভুটান স্থলবেষ্টিত দেশ, যাদের কোনো সমুদ্র নেই। ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যও স্থলবেষ্টিত। আমরাই এই অঞ্চলের জন্য সমুদ্রের একমাত্র অভিভাবক। তিনি এসব দেশের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের ওপর জোর দেন, যা বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। প্রধান উপদেষ্টার এই বক্তব্য ঘিরেই ভারতে তোলপাড় চলছে। দেশটির বিরোধীসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন। তাদের কেউ কেউ ড. ইউনূসের বক্তব্যকে বিপজ্জনক ও আক্রমণাত্মক বলে অভিহিত করছেন। অনেকেই বিস্ময় প্রকাশের পর, হতাশা জানিয়েছেন। কোনো কোনো রাজনীতিবিদ এই ইস্যুতে বাংলাদেশকেই ভেঙে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। এদিকে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন-ড. ইউনূসের সেভেন সিস্টার্সবিষয়ক বক্তব্যের ভুল ব্যাখ্যা চলছে ভারতের সব মহলে।
বুধবার আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান জানান, প্রধান উপদেষ্টা কথাটি এই প্রথমবার বলেননি। তিনি ২০১২ সালে একই ধরনের কথা বলেছিলেন। ২০২৩ সালেও জাপানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কিশিদা নর্থ-ইস্ট ইন্ডিয়া এবং বাংলাদেশকে একটা ভ্যালু চেইনে আবদ্ধ করার কথা বলেছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে সিঙ্গেল ইকোনমিক জোনের (একক অর্থনৈতিক অঞ্চল) কথাও বলেছিলেন, যেটিকে ‘বিগ বি ইনিশিয়েটিভ’ হিসাবে গণ্য করা হয়।
খলিলুর রহমান বলেন, কানেকটিভিটি (যোগাযোগ) এই অঞ্চলের সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে। বিশেষ করে যাদের জন্য সমুদ্রে অ্যাকসেস (প্রবেশ) পাওয়া খুব কঠিন। আমরা কিন্তু কানেকটিভিটি জোর করে চাপিয়ে দেব না। দেওয়ার অবস্থাও আমাদের নেই। কেউ যদি নেয় ভালো, না নিলে কিছু করার নেই। অত্যন্ত সৎ উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পথে তিনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন। এখন যদি এর অন্য রকম ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, আমরা তো সেই ব্যাখ্যা ঠেকাতে পারছি না। আমরা শুধু এটুকু বলতে পারব, আমরা কানেকটিভিটি সবার ইকুইটিফুল বেনিফিটের (সমান সুবিধা) জন্য দিতে আগ্রহী। কেউ নেবেন তো ভালো, না নিলে নেবেন না।’
এদিকে বেইজিংয়ে ড. ইউনূস সেভেন সিস্টার্স নিয়ে করা মন্তব্যের সমালোচনা করে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির অর্থনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সঞ্জীব সান্যাল, বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি, ত্রিপুরার টিপরা মোথা পার্টির প্রধান প্রাদ্যত মানিক্য, ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতা পবন খের, প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক প্রফুল বকশী প্রমুখ।
নরেন্দ্র মোদির উপদেষ্টা সঞ্জীব সান্যাল তার এক্স পোস্টে ড. ইউনূসের এই মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগকে স্বাগত। কিন্তু ভারতের সাতটি রাজ্যের স্থলবেষ্টিত হওয়ার সঠিক তাৎপর্য কী?
হিমন্ত বিশ্বশর্মা এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে এক পোস্টে বলেন, ড. ইউনূস সেভেন সিস্টার্সকে স্থলবেষ্টিত বলে উল্লেখ করেন এবং বাংলাদেশকে মহাসাগরে এ অঞ্চলের একমাত্র অভিভাবক হিসাবে স্থান দেন, তা আপত্তিকর এবং কঠোরভাবে নিন্দনীয়। এ মন্তব্য ভারতের কৌশলগত ‘চিকেনস নেক’ করিডরবিষয়ক স্থায়ী দুর্বলতার বয়ানকে তুলে ধরেছে।
ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বীণা সিক্রি বলেন, প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের এ মন্তব্য খুবই বিস্ময়কর (ভেরি শকিং)। এমন মন্তব্য করার কোনো অধিকার নেই তার। তিনি ভালো করেই জানেন যে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। উত্তর-পূর্ব ভারতের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশাধিকার নিয়ে আমরা বাংলাদেশের সরকারের সঙ্গে নিবিড় আলোচনা করেছি।
এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক চুক্তিও রয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি উত্তর-পূর্ব ভারতের জন্য সংযোগ সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী না হয়, তাহলে এর বিপরীতে নদীর পানি সম্পর্কিত কোনো অধিকারও তারা আশা করতে পারে না। আমাদের অবশ্যই এ মন্তব্যের নিন্দা করা উচিত।
এদিকে প্রাদ্যত মানিক্যে তার মন্তব্যে বাংলাদেশ ভেঙে দেওয়ার হুমকি দেন। তিনি বলেন, উদ্ভাবনী ও চ্যালেঞ্জিং প্রকৌশল ধারণার পেছনে কোটি কোটি ডলার খরচ না করে বাংলাদেশ ভেঙে আমাদের সাগরে প্রবেশের সুযোগ করা উচিত।
অন্যদিকে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক প্রফুল বকশী বলেন, আমরা বাংলাদেশ তৈরি করেছি। সেসময় আমরা কোনো ভৌগোলিক সুবিধা গ্রহণ করিনি। সম্প্রতি বাংলাদেশ, চীন ও পাকিস্তান চিকেনস নেক (শিলিগুড়ি করিডর) নিয়ে আলোচনা করছে এবং ভারতের টুঁটি চেপে ধরে সুবিধা নেওয়ার কথা বলছে। এখন বাংলাদেশ চীনকে ভারতের সাতটি স্থলবেষ্টিত রাজ্যে ঢুকে যেতে বলছে, যা শিলিগুড়ি করিডরের ওপর নির্ভরশীল। পবন খেরা বলেন, ভারতকে ঘিরে ধরতে চীনকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকারের এ মনোভাব আমাদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে খুবই বিপজ্জনক।
এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ড. ইউনূসের বক্তব্যকে ভুলভাবে ব্যাখ্যা করা হচ্ছে। নোবেল বিজয়ী ড. ইউনূস আঞ্চলিক উৎকর্ষের স্বার্থে বাংলাদেশে চায়নার বিনিয়োগ কতটা গুরুত্বপূর্ণ, সে বিবেচনায় সেভেন সিস্টার্সের প্রসঙ্গে বলেছেন। কিন্তু ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তার বলা কথাগুলোকে ভিন্ন মোড়ক দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের চলমান সম্পর্কের অজুহাতে এটিকেও ব্যবহার করা হচ্ছে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেছেন ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় ৭টি প্রদেশ এবং ভুটান ও নেপাল বাংলাদেশ লকড। মানে, তাদের সাগরে যেতে হলে বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। প্রকৃতপক্ষে তারা বাংলাদেশ লকড। এটি তিনি বলেছেন পুরোপুরি অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে তরুণ কর্মীর সংখ্যা অনেক বেশি। এখানে চায়না বিনিয়োগ করলে তাদের লাভ হবে। যেহেতু আমেরিকা চীনের ওপর শুল্ক বাড়িয়ে দিয়েছে, সেহেতু চীনের এক্সপোর্ট কমে যাবে। সেদিক থেকে অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেছেন, আমাদের ইকোনমিক জোনে চীন যদি বিনিয়োগ করে এবং তাদের উৎপাদনের হাব হয়, তাহলে নেপাল, ভুটানসহ ভারতের সাতটি প্রদেশ সুফল পাবে। তিনি কেনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কথাগুলো বলেননি। বলেছেন এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য।
এম সফিউল্লাহ বলেন, এ কথাগুলো তিনি আগেও বলেছেন। ২০০৪ সালের ৭ সেপ্টেম্বর এক আলোচনায় আমি নিজে ছিলাম, যেখানে তিনি পানিবিষয়ক এক আলোচনায় এ কথাগুলো বলেন। বীণা সিক্রিও সেখানে ছিলেন। পানির দিক থেকে বাংলাদেশ একদিকে ইন্ডিয়া লকড। আবার সেভেন সিস্টার্স বাংলাদেশ লকড। তার মানে আমরা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এম শাহীদুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ভারত নিজেই সেভেন সিস্টার্স বিষয়ে চুক্তির বাস্তবতার বাইরে এসে মন্তব্য করছে। ২০১০ সালেই ভারতের সঙ্গে চুক্তি ছিল যে, ভারত ও বাংলাদেশ মিলে ভবিষ্যতে যে বাণিজ্য সম্পর্ক গড়বে, সেটা তারা স্বাগত জানাবে। এ বিষয়গুলো তারা বেমালুম চেপে যাচ্ছে। অধ্যাপক ড. ইউনূস যা বলেছেন, সেটি বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে চুক্তি হয়েছিল সেখানে চীনকেও সুস্পষ্টভাবে সম্পৃক্ত করার কথা বলা হয়। সেই স্পিরিটেই ড. ইউনূস কথা বলেছেন। সেখানে কোনো রাজনীতি ছিল না। ছিল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার কথা, যেখানে ভারত নিজেও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটার অজুহাতে এটিকে খারাপ দৃষ্টিতে ব্যবহার করছে ভারত।
তিনি বলেন, ড. ইউনূসের বক্তব্যকে নেতিবাচকভাবে না দেখে একজন অর্থনীতিবিদের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক সহযোগিতার মানসিকতা হিসাবে দেখলে ভালো হবে। কোনো বিচ্ছিন্নতাবাদ বা ভারত থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতকে আলাদা করে দেওয়ার কেনো ইঙ্গিত তিনি দেননি। ভারত নিজেই এটিকে সেদিকে টেনে নিচ্ছে।