
প্রিন্ট: ১১ এপ্রিল ২০২৫, ০৭:১২ পিএম

মুফতি শেখ মুজিবুর রহমান
প্রকাশ: ২৯ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মাহে রমজানের উন্নতম শিক্ষা হলো তাকওয়া বা খোদাভীতি আর্জনের সঙ্গে সঙ্গে পারস্পরিক সহমর্মিতা ও ভ্রাতৃত্ববোধ। আজ ২৮তম রমজান। শেষ হয়ে এলো রমজানুল মুবারকের শেষ দশকও। জানি না আল্লাহর দরবারে আমাদের তারাবিহ, তেলাওয়াত, তাসবিহ ইত্যাদি কবুল হয়েছে কি না। অপরাধীদের তালিকা থেকে আমাদের নাম আল্লাহ মুছে দিয়েছেন কি না। রহমত, মাগফিরাত আর নাজাতপ্রাপ্তদের তালিকায় আমরা অন্তর্ভুক্ত হতে পারলাম তো? হাদিস শরিফে আছে, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, অনেক রোজাদার এমন আছে যে, তাদের রোজা থেকে উপোস থাকা ছাড়া আর কিছুই অর্জিত হয় না। আর অনেক রাত জেগে ইবাদতকারী এমন আছে যে, তাদের সে ইবাদত থেকে রাত্রিজাগরণ ছাড়া আর কিছুই থাকে না। (মিশকাত : ১১৭)। হে আল্লাহ তুমি আমাদের সিয়াম ও কিয়ামকে কবুল করে নাও। তোমার প্রিয় বান্দাদের তালিকায় আমাদের যুক্ত করে নাও! ইমান ও হেদায়েতের দৌলতে আমাদের ধন্য কর! আমিন।
সিয়াম সাধনার বিশেষ বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রতি লক্ষ করলে বাহ্যত মনে হয়, এর মূল আবেদন ও চাহিদা হচ্ছে পরকালীন জীবনকেন্দ্রিক। তাকওয়া অর্জন, পুণ্যের কাজে বহুগুণ সওয়াব পাওয়া, ক্ষমাপ্রাপ্তি, জান্নাত লাভ, জাহান্নাম থেকে মুক্তি-সবই মুমিন বান্দার জন্য পরকালীন সফলতার একেকটি সিঁড়ি। কিন্তু রমজান ও রোজার বিভিন্ন আমল-ইবাদত ও করণীয় এর প্রতি গভীর দৃষ্টি দিলে এটাও বোঝা যায় যে, ইহকালীন জীবনেও রয়েছে এসবের ব্যাপক প্রভাব। যেমন : হাদিস শরিফে অপরের সহযোগিতা করা, অন্যায় অশ্লীল কর্মকাণ্ড পরিহার করা, বেশি দান করা, সহমর্মী হওয়া, ধৈর্য ধারণ করা, সহানুভূতি প্রকাশ করা, রোজাদারকে ইফতার করানো, ঝগড়াবিবাদ না করা, মিথ্যাচার থেকে বেঁচে থাকা ইত্যাদি সদাচার ও উত্তম গুণাবলি অর্জনের প্রতি রোজাদারকে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। এটা ইসলামের সামগ্রিকতারই বৈশিষ্ট্য। ইসলাম বরাবরই পরকালীন একান্ত ইবাদতগুলোর সঙ্গেও সৎ ও সৌজন্যশীল পার্থিব জীবনের অনুষঙ্গগুলোকে আবশ্যক করে দিয়েছে।
রোজার পার্থিব আরেকটি সুফলের কথা হাদিস শরিফে বিবৃত হয়েছে এভাবে, আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সবরের মাসের (রমজান) এবং প্রতি মাসের তিন দিনের রোজা অন্তরের হিংসাবিদ্বেষ দূর করে দেয়। (মুসনাদে বাযযার, মুসনাদে আহমাদ)। এ হাদিসে হিংসা দূর করার ক্ষেত্রে রোজার ভূমিকার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সামগ্রিকভাবে রোজার সংযমচিত্র এবং রোজার কর্তব্য ও শর্তগুলোর প্রতি তাকালে এ বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায় যে, একজন পূর্ণাঙ্গ সিয়ামসাধকের সঙ্গে হিংসা বা ঘৃণার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। রোজাদারের অন্তরে ইমান, মানুষ ও দেশের জন্য ক্ষতিকর নয়-এমন কারও প্রতি বিদ্বেষ থাকার সুযোগ নেই। বরং ব্যাপক ভ্রাতৃত্বের বন্ধন ও পারস্পরিক সহযোগিতা, সহমর্মিতাই রোজার মূল আবেদন। রোজা সম্পূর্ণভাবেই আল্লাহতায়ালার সন্তুষ্টির জন্য নিবেদিত ত্যাগ-তিতিক্ষা, ধৈর্য, ক্লান্তি ও কষ্টসাধ্য একটি ইবাদত। কিন্তু এর সঙ্গেই দেখা যায়, অপর কোনো ভাইকে ব্যথিত না করার নির্দেশ, কলহ-বিবাদ এড়িয়ে যাওয়ার বিধান, অপর রোজাদারকে ইফতার করানোর পুরস্কার ঘোষণা, দরিদ্র মানুষের প্রতি সহায়তা করার প্রেরণা এবং রমজানের শেষে সদকাতুল ফিতর প্রদানের বিধান দেওয়া আছে। এর সবই বাহ্যিক ফলাফলের দিক থেকে পরিপূর্ণ মানবিক এবং ভ্রাতৃত্ব জাগিয়ে তোলার আমল। তাই রোজার শিক্ষা ও চেতনার একটি বড় দিক হচ্ছে হিংসা, বিদ্বেষ, প্রতিশোধ পরিহার। রোজার শিক্ষার একটি বড় দিক হচ্ছে অনাবিল ভ্রাতৃত্বের বন্ধন নির্মাণ। যদি এ কাজগুলো আমরা ইমানি চেতনা থেকে করি, তাহলে এর ইহকালীন ও পরকালীন পুরস্কার আমরা অবশ্যই পাব, ইনশাআল্লাহ। রমজানে রোজার পূর্ণাঙ্গতার জন্য এগুলো তো আমাদের করাই উচিত। প্রকৃত সিয়াম সাধকের জন্য এ বিষয়টির প্রতি অমনোযোগী হওয়ার কোনো অবকাশ নেই। রোজার শিক্ষা ও চেতনা হিসাবে এ শিক্ষাকে আমরা বছরের অন্য ১১টি মাস ধরে রাখতে পারলে সেটাও আমাদের জন্য সাফল্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দেবে।
লেখক : শায়খুল হাদিস, জামিয়া আশরাফিয়া পটুয়াখালী