বিশেষ শ্রেণির কর্মকর্তাদের দুর্নীতি
অনুসন্ধানে অনীহা দুদকের

মাহবুব আলম লাবলু
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ফাইল ছবি
ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের সাত মাস চলে গেলেও দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাজে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি। সবকিছু চলছে পুরোনো ধারায়। একদিকে পতিত সরকারের দোসরদের বিরুদ্ধে ধারাবাহিকভাবে অনুসন্ধান ও মামলা করা হলেও দায়ের হচ্ছে গৎবাঁধা এজাহার। যা আইনের দৃষ্টিতে খুবই দুর্বল। ফলে আদালতে প্রমাণ করে আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত করা কঠিন হবে। অন্যদিকে একটি বিশেষ ক্যাডারের সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তফশিলভুক্ত অপরাধের অভিযোগ পেয়েও তা অনুসন্ধানে অনীহা দেখাচ্ছে সংস্থাটি। এক্ষেত্রে অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটির (যাবাক) ভূমিকা মারাত্মকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। দুদক আইন ও বিধিভঙ্গ করে তফশিলভুক্ত অপরাধ অনুসন্ধান না করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে পাঠানো হচ্ছে ব্যবস্থা নিতে। একাধিক সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন-একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধের অভিযোগের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) অনুরোধ করা হয়েছে। এমনকি ডিসি অফিসের কর্মচারীর দুর্নীতির বিষয়ে ব্যবস্থা নিতেও ডিসিকেই অনুরোধ করেছে দুদক। আবার অনেক ক্ষেত্রে জেলা প্রশাসক কিংবা বিভিন্ন দপ্তর-অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হচ্ছে। এসব ঘটনা দেখে সংশ্লিষ্টদের মন্তব্য-‘শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা দিচ্ছে দুদক।’
ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলেও যারা দুদক নিয়ন্ত্রণ করতেন তারাও একই নীতি অনুসরণ করেছেন।
জানতে চাইলে টান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, ‘একটি সরকারি প্রকল্পের দুর্নীতির অভিযোগ দুদকের তফশিলভুক্ত অপরাধ। এটা অনুসন্ধান না করে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রেরণ করা সমীচীন হয়নি। ক্ষেত্রবিশষ অভিযোগের মাত্রা বিবেচনায় অনেক সময় বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য পাঠানো যেতে পারে। তবে তফশিলভুক্ত অপরাধ অনুসন্ধানে দুদকের দায়িত্ব রয়েছে। বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার প্রবণতা ঢালাওভাবে করা হলে তা দুদকের জন্য বিব্রতকর। বিশেষ শ্রেণির কাউকে সুরক্ষা দিতে যাতে এমনটা করা না হয়।’
দুদক সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর গোপালগঞ্জ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মহসিন উদ্দিন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) উপজেলা প্রকৌশলী এসএম জাহিদুল ইসলাম ও স্থানীয় উরফি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মনির গাজীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ জমা হয় দুদকের গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়ে। অভিযোগে বলা হয়, অভিযুক্তরা উৎকোচের বিনিময়ে ক্ষমতার অপব্যবহার করে আদালতের স্থিতাদেশ থাকা ভূমি জবরদখলে নিয়ে ব্যক্তিস্বার্থে এডিবির প্রকল্প বাস্তবায়ন করেন। এমনকি প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রতিবাদ করায় ভূমি মালিক কেএম সাইফুর রহমানের (শারীরিক প্রতিবন্ধী) বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে হয়রানি করা হয়। এ বিষয়ে প্রতিকার চেয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন সাইফুর রহমান। জেলা প্রশাসকের দপ্তর থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে নির্দেশ দেন। কিন্তু উপজেলা প্রশাসন কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় ভুক্তভোগী সাইফুর রহমান দুদকের দ্বারস্থ হন। দুদকের গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয় অভিযোগটি অনুসন্ধানের অনুমতি চেয়ে প্রধান কার্যালয়ে পাঠায়। কিন্তু প্রধান কার্যালয়ের যাচাই-বাছাই কমিটি অভিযোগ অনুসন্ধানের অনুমতি দেয়নি। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি দুদক থেকে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসককে এ সংক্রান্ত একটি চিঠি পাঠানো হয়। দুদকের দৈনিক ও সাম্প্রতিক অভিযোগ সেলের পরিচালক (প্রশাসন ক্যাডার থেকে প্রেষণে আসা উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা) ঈশিতা রনির সই করা চিঠিতে প্রাপ্ত অভিযোগের (অভিযোগ নং ১২৫/২০২৪) বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ডিসিকে অনুরোধ করা হয়।
আরও জানা যায়, আইন অনুযায়ী একই ব্যক্তির একসঙ্গে দুটি প্রতিষ্ঠানে সরকারি চাকরি করার সুযোগ নেই। কিন্তু প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে ব্যক্তিগত তথ্য গোপন করে সোহাগ হাওলাদার নামের এক ব্যক্তি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) পরিচ্ছন্ন পরিদর্শক পদে চাকরি করেন। একই সঙ্গে গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অফিস সহকারী পদেও তিনি কর্মরত। গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার কাজুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা আওলাদ হোসেন হাওলাদারের ছেলে সোহাগের এই দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধানের অনুমতি চায় দুদকের গোপালগঞ্জ জেলা কার্যালয়। এ বিষয়েও অনুসন্ধানের অনুমতি দেয়নি দুদকের প্রধান কার্যালয়। একইভাবে দুদক পরিচালক ঈশিতা রনি গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক বরাবর চিঠি দিয়ে বলেন, ‘কমিশনের সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রেরিত অভিযোগের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।’ এর আগেও প্রশাসন ক্যাডার এবং গণপূর্ত অধিদপ্তরের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক কর্মকর্তা ও প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনুসন্ধান না করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠায় দুদক।
জানতে চাইলে দুদকের দৈনিক ও সাম্প্রতিক সেলের পরিচালক ঈশিতা রনি যুগান্তরকে বলেন, ‘এগুলো কমিশনের সিদ্ধান্ত। আমি ডেস্ক অফিসার হিসাবে সই করেছি মাত্র। তারপরও বলব, এগুলো এখানেই শেষ নয়। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়ে আমাদের অবহিত করবেন। সেটা সন্তোষজনক না হলে ফের দুদক গোয়েন্দা ইউনিটের মাধ্যমে গোপন অনুসন্ধান বা প্রকাশ্যে অনুসন্ধানের সুযোগ রয়েছে।’ দুদকের এই পদক্ষেপকে অনেকেই ‘শেয়ালের কাছে মুরগি বর্গা’ দেওয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন-আপনি এটাকে কী বলবেন-জবাবে তিনি বলেন, ‘এই প্রশ্ন আমাকে না করে ওপরের পর্যায়ে করলে ভালো হয়।’
জানা গেছে, দুদক বিশেষায়িত পৃথক আইন দ্বারা গঠিত সংবিধিবদ্ধ, স্বাধীন তদন্তকারী সংস্থা হলেও গুরুত্বপূর্ণ এই প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্বশীলরা কখনো স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি কিংবা করেনি। আটটি মহাপরিচালক পদের মধ্যে তিনটি ছাড়া শীর্ষ আর কোনো পদেই দুদকের নিজস্ব কোনো কর্মকর্তা নেই। প্রেষণে নিয়োগ পাওয়া কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণে চলছে দুদকের কাজ। এতে সৃষ্টি হচ্ছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব। এসব কর্মকর্তার বেশির ভাগের মামলা তদন্তসংক্রান্ত কাজের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। দুদক সংস্কার কমিশন সংস্থাটিকে ঢেলে সাজানোর সুপারিশ করলেও সংস্কারের কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। বিশেষ করে দুদকের অভিযোগ যাচাই-বাছাই কমিটির (যাবাক) নিয়ন্ত্রণ সব সময় থেকে প্রশাসন ক্যাডার থেকে আসা কর্মকর্তাদের হাতে। যাবাকের বর্তমান সভাপতি মহাপরিচালক (মানি লন্ডারিং) মো. মোকাম্মেল হক। তিনি অতিরিক্ত সচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। আরেক প্রভাবশালী সদস্য দৈনিক ও সাম্প্রতিক সেলের পরিচালক ঈশিতা রনি। তিনি উপসচিব পদমর্যাদার কর্মকর্তা। অপরাধ তদন্তের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলেও এই দুজনই কার্যত যাবাকের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অভিযোগ আছে।
আরও অভিযোগ আছে-পরিকল্পিতভাবে সাজানো এই যাবাক কমিটি প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পেলেও তা ফেলে দেন কিংবা নিষ্পত্তি করে দেন বা ইনডেমনিটি দেওয়া হয়। যা সম্পূর্ণ বেআইনি ও বিধিবহির্ভূত। এছাড়া দুদকের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় কার্যালয় থেকে অনুসন্ধানের অনুমতির জন্য যেসব অভিযোগ প্রাথমিকভাবে নির্বাচন করা হয় সেগুলো প্রধান কার্যালয়ের যাবাক কমিটি পুনরায় স্ক্যানিং করে প্রশাসন ক্যাডারের কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকলে সেগুলো বাদ দেওয়া হয়।
এদিকে ৫ আগস্টের পর ঝড়ের গতিতে লোক দেখানো কাজ শুরু করে মো. মঈনুদ্দীন আব্দুল্লাহর কমিশন। তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও দোসর হিসাবে পরিচিত সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে। এই তালিকায়ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের নাম নেই বললেই চলে। বর্তমান কমিশনের কাজেও তেমন কোনো চমক নেই। আগের কমিশনের আমলে শুরু করা অনেক মন্ত্রী-এমপির বিরুদ্ধে শুরু করা অনুসন্ধানের অনেকগুলো শেষ করে তারা ইতোমধ্যে মামলা করেছেন। কিন্তু মামলার এজাহার দুর্বল হওয়ায় আসামিরা আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ার শঙ্কা রয়েছে বলে জানা গেছে।