গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা
সংস্কার কম হলে নির্বাচন ডিসেম্বরে বেশি হলে জুনে

বাসস
প্রকাশ: ১৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, দেশের রাজনৈতিক দলগুলো ‘সংক্ষিপ্ত সংস্কার প্যাকেজ’ নিয়ে একমত হলে জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরেই হতে পারে। তবে ‘বৃহৎ সংস্কার প্যাকেজ’ চাইলে নির্বাচন আগামী বছরের জুনে অনুষ্ঠিত হবে। শুক্রবার ঢাকার তেজগাঁওয়ে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে বৈঠকে অধ্যাপক ইউনূস এসব কথা বলেন। বৈঠকে বাংলাদেশের অন্তর্র্বর্তী সরকারের সংস্কার কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস।
এ গুরুত্বপূর্ণ সময়ে বাংলাদেশ সফর করায় গুতেরেসকে ধন্যবাদ জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আপনার সফর (গুতেরেস) শুধু রোহিঙ্গাদের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের জন্যও সময়োপযোগী। রোহিঙ্গারা যাতে সম্মানের সঙ্গে তাদের জন্মভূমি পশ্চিম রাখাইন রাজ্যে ফিরতে পারে সেজন্য তার (গুতেরেস) সহযোগিতা চান অধ্যাপক ইউনূস। গুতেরেসকে সংস্কার প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবহিত করে ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের ওপর ১০টি রাজনৈতিক দল এরই মধ্যে মতামত দিয়েছে। ‘সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ নিশ্চিত করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে জুলাই সনদ স্বাক্ষর করা হবে। যা দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের পাশাপাশি রাজনৈতিক, বিচারিক, নির্বাচনসংক্রান্ত, প্রশাসনিক, দুর্নীতি দমন এবং পুলিশ সংস্কারের রূপরেখা হবে।
বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যদের প্রশংসা করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, এ মিশনে কাজ করার ফলে সেনাবাহিনী এক অনন্য অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। শান্তিরক্ষী বাহিনীতে কাজ করা আমাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রাম অঞ্চলে একাধিক বন্দর নির্মাণ প্রকল্প সম্পর্কে তিনি বলেন, যা নেপাল ও ভুটানসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে দেশকে ‘একটি অর্থনৈতিক কেন্দ্র’ হিসাবে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে।
অর্থনীতি প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা ইউনূস বলেন, তার সরকার উত্তরাধিকারসূত্রে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও ভঙ্গুর ব্যাংকিং খাত, সংকুচিত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে পড়া অবস্থায় পেয়েছে। অর্থনীতি এখন সুসংহত হয়েছে। রপ্তানি কয়েক মাস ধরে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও ভালো অবস্থানে রয়েছে। বলেন, আগামী বছর স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে আসবে বাংলাদেশ। তিনি বলেন, আমরা এলডিসি উত্তরণের জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুতি নিচ্ছি। তিনি বলেন, পূর্ববর্তী সরকারের শাসনামলে লুটপাট হওয়া কয়েকশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ফেরত আনার জন্য সরকার চেষ্টা করছে।
ঘণ্টাব্যাপী বৈঠকে জাতিসংঘ মহাসচিব গুতেরেস বলেন, আপনাদের সংস্কার প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিতে এখানে এসেছি। আপনাদের সর্বোত্তম সফলতা কামনা করছি। যে কোনো ক্ষেত্রে সহযোগিতা করার আশ্বাস দিয়ে তিনি বলেন, এ সংস্কার প্রক্রিয়া একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন এবং দেশের একটি ‘বাস্তব রূপান্তর’ নিশ্চিত করবে। তবে সংস্কার প্রক্রিয়াটি জটিল হতে পারে। তিনি আরও বলেন, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করতে তিনি রমজান মাসে বাংলাদেশে এসেছেন। তিনি বলেন, পৃথিবীতে এতটা বৈষম্যের শিকার অন্য কোনো জনগোষ্ঠী আমি দেখিনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের ভুলতে বসেছে। রোহিঙ্গাদের জন্য মানবিক সহায়তা হ্রাস নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘মানবিক সহায়তা হ্রাস করা একটি অপরাধ।’ তিনি বলেন, পশ্চিমা দেশগুলো এখন প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় দ্বিগুণ আর বিশ্বজুড়ে মানবিক সহায়তা সংকুচিত করছে।
রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের প্রতি জাতিসংঘের ‘অপরিসীম কৃতজ্ঞতা’ প্রকাশ করেন গুতেরেস। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রতি অত্যন্ত উদারতা দেখিয়েছে। তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আমার জন্য একটি বিশেষ বিষয়। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে তিনি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন এবং তাদের জন্য সহায়তা সংগ্রহকে অগ্রাধিকার দেবেন। বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর ভূমিকার প্রশংসা করেন গুতেরেস। বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনীর কার্যক্রম ‘অসাধারণ’ এবং বাংলাদেশ ন্যায়সঙ্গত বিশ্ব প্রতিষ্ঠার অগ্রভাগে রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের শান্তিরক্ষী বাহিনী আমাদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
বৈঠকে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন, প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা সমস্যা ও অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত বিষয়াবলীসংক্রান্ত হাই রিপ্রেজেনটেটিভ ড. খলিলুর রহমান এবং এসডিজিবিষয়ক সিনিয়র সচিব লামিয়া মোরশেদ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল রাবাব ফাতিমা ও বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গুইন লুইস বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
এদিকে, শুক্রবার সকালে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন আলাদাভাবে সাক্ষাৎ করেন।
আমরা যথেষ্ট ভাগ্যবান, কারণ আমাদের সমুদ্র আছে-প্রধান উপদেষ্টা : প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের মানুষ যথেষ্ট ভাগ্যবান। কারণ আমাদের একটি সমুদ্র আছে, যা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে উদ্বুদ্ধ করে। শুক্রবার কক্সবাজারে বিআইএএম অডিটোরিয়ামে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি একথা বলেন।
সামুদ্রিক সম্ভাবনার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, বাংলাদেশের একটি দীর্ঘ সমুদ্র তীর রয়েছে এবং চট্টগ্রামের সমুদ্র তীরের যে কোনো স্থানে সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করা সম্ভব। কক্সবাজারে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। এটি শুধু একটি পর্যটন শহরই নয়, বরং অর্থনীতিরও কেন্দ্র। নেপাল ও ভারতের সেভেন সিস্টার্সের কোনো সমুদ্র নেই উল্লেখ করে ড. ইউনূস পারস্পরিক সুবিধার্থে বাংলাদেশের সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন। তিনি বলেন, আমরা ব্যবসা করতে পারলে সবার ভাগ্য বদলে যাবে। পাইলট ভিত্তিতে কক্সবাজারে বায়ু বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি বায়ুশক্তির (বায়ুপ্রবাহের শক্তি কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন) সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি খোঁজ নেন।
স্থানীয় জনগণকে ভবিষ্যতে সুযোগগুলো কাজে লাগানোর আহ্বান জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, কক্সবাজার অর্থনীতির একটি বৃহৎ শক্তি এবং এটি তথ্যপ্রযুক্তিরও একটি শহর হতে পারে। স্থানীয় জনগণের কাছে তিনি তাদের ওপর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চান। মতবিনিময় সভায় কক্সবাজারের উন্নয়নে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রধান উপদেষ্টার সামনে বিভিন্ন প্রস্তাব ও দাবি পেশ করেন।
রোহিঙ্গাদের ফেরাতে প্রয়োজনে সারা দুনিয়ার সঙ্গে লড়াই করব : প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের তাদের দেশে ফেরাতে সারা দুনিয়ার সঙ্গে প্রয়োজনে লড়াই করতে হবে। শুক্রবার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনে গিয়ে তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গাদের দুঃখ দেখে সমাধান করতে জাতিসংঘ মহাসচিব এসেছেন। এ ঈদে না হোক আগামী ঈদে রোহিঙ্গারা নিজের দেশে ঈদ করতে পারবেন সেই প্রত্যাশা করি।
বিমানবন্দরের দুটি সাইট পরিদর্শন : জাতিসংঘ মহাসচিবের বিদায়ের পর মুহাম্মদ ইউনূস কক্সবাজারের নির্মাণাধীন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের দুটি সাইট পরিদর্শন করেন। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) বিমানবন্দরের কাজের অগ্রগতি ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তাকে অবহিত করে। বেবিচক জানায়, বিমানবন্দরের নির্মাণ কাজের ৯৫ শতাংশ ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। বাকি কাজ চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে
বিমানবন্দর পরিদর্শন শেষে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস কক্সবাজার শহরের অদূরে ২৫৩ একর জায়গাজুড়ে গড়ে ওঠা খুরুশকুল জলবায়ু পুনর্বাসন প্রকল্প পরিদর্শন করেন। প্রকল্প পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিরাজুল ইসলাম প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন। তিনি জানান, প্রকল্পের আওতায় ১২৯টি ভবনে মোট ৪ হাজার ২১৮টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে।