Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

মুখোমুখি এনসিপি, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবির

টাকার উৎস কোথায় চলছে বাগযুদ্ধ

Icon

শেখ মামুনুর রশীদ

প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

টাকার উৎস কোথায় চলছে বাগযুদ্ধ

রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনে অর্থের উৎস নিয়ে চলছে বাহাস। কোনো দল বা সংগঠন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে টাকা নিয়ে বিপদে তাদের সুরক্ষা দিচ্ছেন। কেউ অর্থের জোগানদাতার ছক অনুযায়ী পালন করছে নানা কর্মসূচি। গোপন উৎসের অর্থে দলের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হলেও তার নাম প্রকাশ হচ্ছে না। অর্থের বিনিময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে কী ধরনের সুবিধা দেওয়া হয় তা থেকে যাচ্ছে পর্দার আড়ালে। এ সুযোগে দলগুলোতে কালো টাকার অবাধ প্রবেশ নিশ্চিত হচ্ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে পেশিশক্তির দৌরাত্ম্য। এসব বিষয়ই উঠে আসছে নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং ইসলামী ছাত্রশিবিরের বাগ্যুদ্ধে। এক দল অপর দলকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাচ্ছেন, এক পক্ষ আরেক পক্ষের কাছে জানতে চাইছেন টাকা আসে কোথা থেকে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলগুলোকে কেউ এমনি এমনি টাকা দেয় না। এজন্য তারা সুবিধা নিশ্চিত করে থাকেন। টাকা উৎসের বিষয়টি নিয়ে দেশের রাজনীতিও এখন সরগরম। 

বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সঙ্গে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এনসিপির কার্যালয় ও নির্বাচনি তহবিলের জন্য ধনীরা অর্থ সহায়তা দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। এর পরপরই চাপা পড়ে যাওয়া ইস্যুটির পালে নতুন করে হাওয়া লেগেছে। বিভিন্ন দল ও সহযোগী সংগঠনগুলো এ নিয়ে আওয়াজ তুলছে। এনসিপির অর্থদাতা কারা-তা জানতে চান বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। একই সঙ্গে তিনি ইসলামী ছাত্রশিবিরের টাকার উৎস নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। জবাবে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম ছাত্রদল নেতাদের উদ্দেশে পালটা প্রশ্ন রাখেন। তিনি বলেন, আমাদের টাকা কোথা থেকে আসে তার সুনির্দিষ্ট খাত আছে, যা আমরা আগেও উল্লেখ করেছি, এখনো করছি। কিন্তু ছাত্রদল বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করে, বিপুল অর্থ ব্যয় করে, তাদের টাকা কোথা থেকে আসে, ছাত্রদল কি তা প্রকাশ করবে। জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন বলেন, দলের আর্থিক বিষয় নিয়ে সমালোচনাগুলো আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ ৫ আগস্টের আগে এই ধরনের সমালোচনা ছিল না। এখন আবার শুরু হয়েছে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, শুধু নির্বাচন নয়, রাজনৈতিক দল এবং তাদের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন পরিচালনায় প্রয়োজন হয় বিপুল পরিমাণ অর্থ। যে রাজনৈতিক দল যত বড়, তাদের খরচও তত বেশি। আর এ অর্থের জোগান দেন শিল্পপতি, সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তি, বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক, দলের নেতাকর্মী, দেশি-বিদেশি শুভার্থী-শুভানুধ্যায়ীরাই। রাজনীতির ভাষায় যাকে বলা হয় ‘ডোনেশন’ বা ‘চাঁদা’। যা দিয়ে দলীয় কার্যালয়ের ভাড়া মেটানো, অফিস স্টাফদের বেতন-ভাতা পরিশোধ, সভা-সমাবেশসহ যাবতীয় সামাজিক এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। তবে কারা এই অর্থদাতা, তা নিয়ে সমাজের নানা পর্যায়ে আলোচনা-সমালোচনা এবং প্রশ্ন থাকলেও তাদের প্রকৃত পরিচয় কখনোই প্রকাশ করার প্রয়োজনবোধ করেনি রাজনৈতিক দলগুলো। বরং এই অর্থদাতাদের বিভিন্ন সময়ে বিপদ-আপদ থেকে আগলে রাখার চেষ্টা করেন তারা, দেন অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা। 

প্রবীণ রাজনীতিবিদ, সংবিধানের অন্যতম প্রণেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, রাজনীতি থেকে কালো টাকা এবং পেশিশক্তির দাপট দূর করতে না পারলে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন হবে না। গত ১৬ বছরে আমরা যা দেখেছি কিংবা এরও আগে যা দেখেছি, তারই পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এজন্যই আমরা বারবার বলছি সংস্কার প্রয়োজন। কালো টাকা, পেশিশক্তির প্রভাব দূর করতে চাইলে রাজনৈতিক দলগুলোকে আয়-ব্যয়ের স্বচ্ছ এবং স্পস্ট বিবরণ প্রকাশ করতে হবে। যদিও আইন অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনে (ইসি) দলগুলো প্রতিবছর তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাব দেয়, কিন্তু এই হিসাবে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে যারা মোটা অঙ্কের টাকা দেন, তারা তা এমনি এমনি দেন না। ভাবার কোনো কারণ নেই যে, শিল্পপতি, ব্যবসায়ী কিংবা সমাজের ধনাঢ্য ব্যক্তিরা এমনিতেই টাকা দিচ্ছে। তারা তাদের স্বার্থেই অর্থ দেন। এর বিনিময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা তারা নিশ্চিত করে থাকেন। 

বিশ্লেষকদের মতে, বিভিন্ন সময় রাজনৈতিক দলগুলোর এই অর্থের উৎস নিয়ে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে কিংবা অন্দরমহলে আলাপ-আলোচনা হলেও তা তেমন একটা পাদপ্রদীপের আলোচনায় আসেনি। বিশেষ করে গত ১৬ বছরের বিরামহীন লুটপাট, সীমাহীন অর্থ পাচার, নজিরবিহীন ব্যাংক তছরুপ-ডাকাতি, শেয়ারবাজারে হরিলুটসহ বিভিন্ন আর্থিক খাতে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ কেলেঙ্কারির কারণে এই আলোচনা খুব একটা সামনে আসেনি। গণ-আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যাত্রা শুরু হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের। এ বছরের ডিসেম্বরে, না হয় ২০২৬ সালের প্রথমদিকে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্য সামনে রেখে যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে। ঠিক এমন সময়ে রাজনৈতিক দল এবং তাদের ছাত্র সংগঠনের অর্থের উৎস নিয়ে শুরু হয়েছে বাহাস।

শুক্রবার রাজধানীর নয়াপল্টনে এক সংবাদ সম্মেলনে এনসিপিকে কারা অর্থ দিচ্ছেন এবং ইসলামী ছাত্রশিবির প্রতিদিন তিন লাখ টাকার ইফতার আয়োজনের অর্থ কোথায় পায়-এসব প্রশ্ন তোলেন ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির। তিনি বলেন, দেশের কিছু ধনী ব্যক্তি এনসিপিকে অর্থায়ন করেছেন বলে একটি আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন দলটির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। অন্যদিকে ছাত্রশিবিরের সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম গণমাধ্যমকে তাদের ইফতার কর্মসূচিতে দৈনিক তিন লাখ টাকা ব্যয়ের কথা জানিয়েছেন। নাছির উদ্দীন নাছির প্রশ্ন তুলে বলেন, দেশের কোন ধনী ব্যক্তিরা এনসিপিকে অর্থায়ন করেছেন এবং সেই অর্থায়নের বিপরীতে ওই ধনী ব্যক্তিরা কী ধরনের প্রতিশ্রুতি নিয়েছেন। আর দৈনিক তিন লাখ টাকা ব্যয় হলে ৩০ দিনের ইফতার আয়োজনে শিবিরের অন্তত ৯০ লাখ টাকা লাগবে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের একটি সংগঠন হিসাবে ছাত্রশিবির এ টাকা কীভাবে উপার্জন করেছে কিংবা ওই টাকার উৎস কী। 

ছাত্রদলের এই বক্তব্যের জবাব দিতে গিয়ে ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সেক্রেটারি জেনারেল নুরুল ইসলাম সাদ্দাম তারা কীভাবে ‘ফান্ড সংগ্রহ’ করেন, কোন খাতে কীভাবে খরচ করেন এ বিষয়ে কথা বলেন। তিনি জানান, সংগঠনের সাবেকরা বর্তমান দায়িত্বশীলদের মাধ্যমে অর্থনৈতিক ও অন্যান্য সহযোগিতা করেন। ছাত্রশিবিরের প্রত্যেক সদস্যই বায়তুলমাল দেন, সেখান থেকেও আমাদের আয় হয়। 

এছাড়া সংগঠনের প্রকাশনীর মুনাফা এবং শরিয়ত অনুমোদিত অন্য খাতসমূহ থেকে প্রাপ্ত অর্থ বায়তুলমালের আয়ের উৎস। এসব আয় থেকে সংগঠনের বিভিন্ন কাজে ব্যয় করা হয়। ইফতারের ব্যয়ও তার মধ্যে অন্যতম। তিনি আরও বলেন, আমাদের কর্মীরা তাদের টিউশনির আয় থেকে জমানো টাকা ছাত্রকল্যাণ ফান্ডে দান করে। এমনকি বাড়ি থেকে পাঠানো টাকাও সংগঠনের জন্য ব্যয় করেন। এ সময় ছাত্রদলের উদ্দেশে তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, আমাদের টাকা কোথা থেকে আসে তার সুনির্দিষ্ট খাত আছে, সেগুলো আমরা উল্লেখ আগেও করেছি, এখনো করছি। কিন্তু ছাত্রদল বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করে, বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করে, তাদের টাকা কোথা থেকে আসে? ছাত্রদল কি তা প্রকাশ করবে। 

জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির রোববার যুগান্তরকে বলেন, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির কিংবা অন্যান্য ছাত্র সংগঠন যারা আছে তাদের মধ্যে এক ধরনের প্রতিযোগিতা আছে, থাকবেও। কিন্তু ছাত্রশিবির ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় তাদের কর্মসূচি পালনের সময় যে বিপুল পরিমাণ টাকা খরচ করে তা এক কথায় নজিরবিহীন। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারা প্রতিদিন ইফতার পার্টির আয়োজন করছে। তাদের দাবি প্রতিদিন এই ইফতার আয়োজনের খরচ হচ্ছে তিন লাখ টাকা। তাহলে এক মাসে খরচ হবে ৯০ লাখ টাকা। কিছুদিন আগে তারা বিজ্ঞান উৎসবের আয়োজন করে, সেখানেও কোটি টাকার বেশি খরচ করেছে। এ কারণেই আমরা জানতে চেয়েছি যে, তাদের এই বিপুল পরিমাণ টাকার উৎস কোথায়। এটা আমাদের একটা সহজ সরল প্রশ্ন। কিন্তু তারা এর জবাবে যেভাবে আক্রমণ করে কথা বলেছে তা দুঃখজনক।

তিনি আরও বলেন, আমরা নতুন আত্মপ্রকাশ করা রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে কারা অর্থ দিচ্ছেন তাও জানতে চেয়েছি। কারণ এই দলটির প্রধান নাহিদ ইসলাম নিজেই রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ধনীরা তাদের অর্থ সহায়তা করছেন। আমার প্রশ্ন হচ্ছে, ধনী ব্যক্তিরা যারা তাদের অর্থ সহায়তা করছেন, তাদের তিনি কী প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কারণ কোনো প্রতিশ্রুতি না দিয়ে থাকলে তো তারা অর্থ সহায়তা করার কথা নয়। 

জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব মুশফিক উস সালেহীন রোববার যুগান্তরকে এ প্রসঙ্গে বলেন, দলের আর্থিক বিষয় নিয়ে সমালোচনাগুলো আমরা ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ ৫ আগস্টের আগে এই ধরনের সমালোচনা ছিল না। মানুষ রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এসব আশা করা ছেড়ে দিয়েছিল। এখন এ ধরনের সমালোচনা মানুষের প্রত্যাশা পূরণে আমাদের আরও দায়বদ্ধ করে তুলবে। তিনি বলেন, আমরা খুব শিগগিরই একটা ফিন্যান্সিয়াল পলিসিতে যাব। এই পলিসির মাধ্যমে সমাজের উচ্চ ও নিম্নবিত্তের মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে।

বিশেষ করে যারা আমাদের সহযোগিতা করতে চায় তাদের। এই পলিসি দৃশ্যমান হলে সবাই সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে। আমরা মনে করি আমাদের দলের আর্থিক বিষয়ে মানুষ যে স্বচ্ছতা চাচ্ছে, একই ধরনের স্বচ্ছতা দেশের সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে চাওয়া উচিত। এজন্য জনগণের উচিত সব রাজনৈতিক দলকে চাপ দেওয়া। 


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম