রমজানুল মুবারক
রমজানে শ্রমিক অসন্তোষ থেকে বেঁচে থাকুন

মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া
প্রকাশ: ১০ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া/ ছবি-সংগৃহীত
রমজান মুসলমানদের জন্য সংযম, আত্মশুদ্ধি ও ইবাদতের মাস। তবে এ মাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং সুস্থ কর্মপরিবেশ বজায় রাখা। দীর্ঘ সময় রোজা রাখার কারণে শ্রমিকদের শারীরিক ও মানসিক অবস্থার পরিবর্তন হয়, যা সরাসরি তাদের মনোবলে প্রভাব ফেলে। শ্রমিক অসন্তোষ এড়িয়ে তাদের পরিপূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করতে কুরআন-সুন্নাহর কোনো বিকল্প নেই।
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তারা (অধীনস্থরা) তোমাদের ভাই। আল্লাহ তাদের তোমাদের অধীনস্থ করে দিয়েছেন। কাজেই আল্লাহ যার ভাইকে তার অধীনস্থ করে দিয়েছেন, তার (মালিক/দায়িত্বশীল কর্মকর্তার) উচিত, তাকে (অধীনস্থকে) তা-ই খাওয়ানো যা সে নিজে খায় এবং তাকে (অধীনস্থকে) তা-ই পরিধান করানো যা সে নিজে পরিধান করে। আর তাকে (অধীনস্থকে) এমন কাজের ভার দেবে না, যা তার সাধ্যের বাইরে। যদি কখনো তার ওপর অধিক কাজের দায়িত্ব চাপানো হয়, তবে যেন (দায়িত্বশীল ব্যক্তি) তাকে সাহায্য করে।’ (বুখারি ও মুসলিম)।
ইসলাম সাম্যের ধর্ম। মানবাধিকার রক্ষার জীবনব্যবস্থা। এখানে মনিব-চাকর, মালিক ও শ্রমিকের মাঝে কোনো তফাত নেই। মালিক যা খাবে, যা পরবে; তার অধীনস্থদের তা খাওয়াবে, তা পরাবে। এটা খাঁটি মুমিনের পরিচয়। মাহে রমজান হলো শ্রমিক ও নিজের অধীনস্থদের প্রতি সদয় হওয়ার মাস। খেটে খাওয়া পরিশ্রমী মানুষগুলো রোজা রেখে সারাদিন উপবাস করে যায়। কঠিন ও কষ্টের কাজগুলো সম্পাদন করে। সেসব মানুষের কষ্ট অনুভব করার শিক্ষা রয়েছে সিয়াম সাধনায়। মাহে রমজানের সম্মানে তাদের কাজের বোঝা কমিয়ে দেওয়া। তাদের দিয়ে পারতপক্ষে সহজ কাজগুলো সম্পাদন করা। এটা ইসলামের বিধান। নবিজি (সা.) বলেন, ‘মাহে রমজানে তোমরা তোমাদের অধীনস্থদের প্রতি সদয় হও। তাদের ওপর কাজের চাপ কমিয়ে দাও। মহান আল্লাহ তোমাদের ক্ষমা করে দেবেন। জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেবেন।’ সাহাবায়ে কেরাম নবিজির কথাগুলো পুরোপুরি মেনে চলেছেন। অন্যদের এর ওপর আমলের উপদেশ দিয়েছেন।
মানুষ ঘাম ঝরানো শ্রমিকের প্রতি সামান্যতম সহানুভূতিও দেখায় না। বরং পুরোটা মাস ঈদের আয়োজনে লাভবান হওয়ার আশায় শ্রমিকের প্রতি রুদ্রমূর্তি হয়ে প্রদর্শিত হয়। অনেকে শ্রমিকের প্রতি এমন কঠোর হয় যে, শ্রমিকের সিয়াম সাধনায় বাধার সৃষ্টি হয়। ইবাদত-বন্দেগিতে সময় কাটানোর কারণে অনেক শ্রমিককে চাকরিচ্যুত করা হয়। অথচ এ ধরনের মালিকের প্রতি আল্লাহ ও তার রাসুলের পক্ষ থেকে অভিশাপ রয়েছে। সাহাবি হজরত আলি (রা.) বলেন, নবিজির সর্বশেষ বাণী ছিল দুটি কথা- একটি হলো-‘(১) নামাজ-নামাজ। (২) অপরটি হলো-তোমরা তোমাদের অধীনস্থদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় করো।’ যারা মাহে রমজানে শ্রমিকের প্রতি কঠিন আচরণ করে, নির্দয় ব্যবহার করে। তাদের প্রতি আল্লাহও কঠিন হয়ে যাবেন। রহমতের পরিবর্তে রাগান্বিত হবেন। মাগফিরাতের পরিবর্তে তাদের পাপের বোঝা ভারী হবে। অপরাধীদের খাতায় তাদের নাম অন্তর্ভুক্ত হবে। আমরা তো বেমালুম ভুলেই যাই-অধীনস্থ শ্রমিক ও গৃহপরিচারিকারাও আল্লাহর বান্দা। যে কারণে এ মাহে রমজানেও তাদের ওপর কাজের বোঝা চাপিয়ে দেই অধিক পরিমাণে। অথচ নবিজি (সা.) বলতেন-‘মাহে রমজানে তোমরা দাস-দাসীদের কাজকর্ম শিথিল করে দাও। ইবাদত-বন্দেগি যথাযথ করতে দাও।’ ঘাম শুকানোর আগে শ্রমিকের প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়ার কথা থাকলেও মাসের পর মাস তাদের বেতন-ভাতা ধরে রাখা হয়। অথচ অভাব-অনটনে বহু শ্রমিকের বহু পরিবার অনাহারে দিন কাটায়। আর মালিকরা ভোগ-বিলাসিতায় মত্ত হয়ে থাকেন। এ ধরনের অসম আচরণ একদিন দুর্ভাগ্যের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। এ অমানবিক বৈষম্যের কর্মফল একদিন প্রকাশ পাবে। তাই আমাদের উচিত অধীনস্থদের প্রতি সদয় হওয়া। ইসলামের নির্দেশনা মতো শ্রমিকের যথাযথ প্রাপ্য বুঝিয়ে দেওয়া। তাহলেই আমাদের এ সিয়াম সাধনা সার্থক হবে। আল্লাহতায়ালা আমাদের তাওফিক দিন। আমিন!
লেখক : প্রিন্সিপাল, জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ, মিরপুর, ঢাকা