জনতা ব্যাংকের ৩শ কোটি টাকা লুটপাট
বিদেশে আ.লীগ নেতার আয়েশি জীবনযাপন

আবুল খায়ের, কুমিল্লা ব্যুরো
প্রকাশ: ০৬ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67c8e2946dbd3.jpg)
কুমিল্লায় জনতা ব্যাংকের ৩শ কোটি টাকা লুটপাট করে অস্ট্রেলিয়ায় আয়েশি জীবন কাটাচ্ছেন এক আওয়ামী লীগ নেতা। সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি সালাউদ্দিন আহমেদ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের টাকা মেরে দিয়ে এখন প্রবাসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। তিনি জেলার নাঙ্গলকোট উপজেলার রাজাপাড়া গ্রামের বাসিন্দা। এদিকে দুর্বল ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বড় অঙ্কের ঋণ দেওয়ায় জড়িত জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তারা এখন বদলি হয়ে পিঠ বাঁচাতে চাইছেন। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এত টাকা লুটের নেপথ্যে কারা তা খতিয়ে দেখার দাবি সচেতন মহলের।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, কুমিল্লার সদর দক্ষিণ উপজেলার জোর কানন এলাকায় আসিফ গ্রুপের দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন সালাউদ্দিন আহমেদ। অজপাড়াগাঁয়ের দুই একর জায়গায় পোশাক তৈরির এ কারখানা গড়ে তোলার রহস্য জানতেন না কেউ। এলাকাবাসীর ধারণা ছিল স্থানীয়দের বেকার সমস্যা দূর করা এবং এলাকার উন্নয়নে হয়তো বা ওই আওয়ামী লীগ নেতা এ শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। দুটি প্রতিষ্ঠান যথারীতি কার্যক্রম শুরু করার দুই-তিন বছর পরই বন্ধ হয়ে যায়। এরই মাঝে জনতা ব্যাংক থেকে প্রায় তিনশ কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করেন প্রতিষ্ঠানের মালিক সালাউদ্দিন আহমেদ। সুচতুর এই আওয়ামী লীগ নেতা ব্যাংক ঋণের পুরো টাকাটাই পাচার করে সপরিবারে বিদেশে পাড়ি জমান। এলাকার লোকজন জানান, দুবাইতেও তিনি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান খুলেছেন। গ্রামে আলিশান বাড়ি নির্মাণ করেছেন।
জনতা ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে জনতা ব্যাংক ঢাকার মতিঝিল শাখা থেকে আসিফ অ্যাপারেলস ১৪৭ কোটি ৮০ লাখ এবং আসিফ ফ্যাশনের নামে ১৩৯ কোটি টাকার ঋণ নেওয়া হয়। এসব ঋণ সুদে-আসলে বেড়ে ৪শ কোটি টাকার ওপরে দাঁড়িয়েছে। ঋণের চাইতে তার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মর্টগেজ মূল্য অনেক কম হওয়ায় তিনি কৌশলে ব্যবসাটি গুটিয়ে নেন। এরপর সপরিবারে অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। বন্ধ প্রতিষ্ঠানগুলোতে কেয়ারটেকার নিয়োগ করে জনতা ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। চার বছর ধরে কেয়ারটেকার হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন জনতা ব্যাংকের গার্ড মাহবুব খান।
স্থানীয়দের দাবি দুটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রায় দুই একর জমি, স্থাপনা ও মালামালের মূল্য ১০০ কোটি টাকাও হবে না। তাছাড়া প্রতিষ্ঠান দুটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভেতরে থাকা মালামাল লুট হয়ে গেছে। জনতা ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের যোগসাজশে প্রতিষ্ঠান দুটির ভেতরে থাকা অধিকাংশ মালামাল বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। এদিকে ওই আওয়ামী লীগ নেতার ঋণ পাশ করার নেপথ্যে জনতা ব্যাংকের কর্মকর্তাদের একটি অসাধু চক্র জড়িত রয়েছে বলে জানা গেছে। তাছাড়া সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সুপারিশও রয়েছে।
স্থানীয়রা জানায়, ব্যাংকের নিযুক্ত কেয়ারটেকার মাহবুব খানের যোগসাজশে ব্যাংকের কতিপয় অসাধু কর্মকর্তা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক পক্ষের একটি সিন্ডিকেট মিলে গত এক বছরে প্রতিষ্ঠানের ১০ কোটি টাকার মালামাল বিক্রি করে দিয়েছে। ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা চলমান থাকায় এখনো প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরের মালামাল অ্যাসেসমেন্ট করা হয়নি। এই সুযোগে ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তারা ও মালিক পক্ষ মিলে মালামাল বিক্রি করে দিয়েছে।
সরেজমিন ওই শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায়, ভেতরের যত যন্ত্রাংশ ছিল সবগুলোই কেটে কেটে বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। ডাইং মেশিন, আয়রন মেশিন, এসি, জেনারেটর, লোহা, স্টিল, তামা, অ্যালুমেনিয়াম, কেবলসহ সব ধরনের মালামাল বিক্রি করে ফাঁকা করে ফেলা হয়েছে।
কেয়ারটেকার মাহবুব বলেন, আমি জনতা ব্যাংকের নিযুক্ত কেয়ারটেকার। চার বছর ধরে এখানে দায়িত্ব পালন করছি। এই ফ্যাক্টরির ভেতর থেকে আনুমানিক ১০ কোটি টাকার মালামাল লুটপাট হয়ে গেছে। এই লুটের সঙ্গে আমি জড়িত নই। এলাকার লোকজন এসব মালামাল লুট করে নিয়ে গেছে। ব্যাংকের কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমি একবার থানায় জিডি করেছি।
স্থানীয় জোরকানন এলাকার বাসিন্দা আবুল হাশেম বলেন, দুই একর জায়গায় আসিফ গ্রুপের দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়েছে। কাপড় তৈরির ফ্যাক্টরি ছিল এগুলো। এই মুহূর্তে দুটি প্রতিষ্ঠান জায়গাসহ বিক্রি করলে ৭০-৮০ কোটি টাকার বেশি পাওয়া যাবে না।
নাঙ্গলকোট উপজেলার রাজাপাড়া এলাকার বাসিন্দা আব্দুল হামিদ খান বলেন, সালাউদ্দিন আহমেদ এই গ্রামে আলিশান একটি বাড়ি করেছেন। গ্রামের লোকজন ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে তার ফোনে যোগাযোগ আছে। জনতা ব্যাংক মতিঝিল শাখার লোন ডিলিং অফিসার খাইরুল বাশার বলেন, প্রায় ৩শ কোটি টাকা ঋণ নিয়ে সালাউদ্দিন আহমেদ খেলাপি হয়ে গেছেন। তার দুটি শিল্পপ্রতিষ্ঠান এখন ব্যাংকের তত্ত্বাবধানে রয়েছে। এই ঋণ যখন অনুমোদন দেওয়া হয়েছে তখন এই দায়িত্বে আমি ছিলাম না। যিনি দায়িত্বে ছিলেন তিনি বদলি হয়ে গেছেন।
জনতা ব্যাংক মতিঝিল শাখার এজিএম শাহিন মাসুদ বলেন, দুটি প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে সালাউদ্দিন আহমেদ এ ঋণ নিয়েছেন। এর আগে যারা এ ঋণের তদন্ত ও অনুমোদন করেছেন তাদের অধিকাংশই বদলি হয়ে গেছে। তিনি জানান, আসিফ গ্রুপের ঋণখেলাপি নিয়ে কুমিল্লার আদালতে মামলা চলছে।