মাঠের প্রস্তুতি শুরু দলগুলোর
ডিসেম্বরে সংসদ নির্বাচন

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

দ্রুত বদলে যাচ্ছে দেশের রাজনীতির দৃশ্যপট। প্রকাশ্যে যে যাই বলুক, পর্দার আড়ালে জোর কদমে শুরু হয়েছে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি। সোমবার প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ভোট সম্ভবত এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। মঙ্গলবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীন বলেছেন, ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচন ধরেই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। সেক্ষেত্রে অক্টোবরের দিকে তফশিল, ডিসেম্বরে ভোট এবং জানুয়ারিতে সরকার গঠন-এমন লক্ষ্য নিয়ে নির্বাচনি রোডম্যাপ সাজানোর প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
এ অবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলো জোরেশোরে মাঠে নেমেছে। ভোটের মেরুকরণ কী হবে, কোন দলের সঙ্গে কার জোট হবে; কার সঙ্গে কোথায় আসন সমঝোতা হবে-এসব বিষয়েও আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে। নতুন দলসহ অনেকেই তিনশ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা বলছে। সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও ১৮ মাসের মধ্যে নির্বাচনের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন সময় এ বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের কথা বলেছেন।
সোমবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ইইউ কমিশনার আদজা লাবিব। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ভোট সম্ভবত এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে। এদিকে মঙ্গলবার সিইসি এএমএম নাসির উদ্দীন বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা অনুযায়ী সংসদ নির্বাচন আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে কমিশন। ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরে নিয়ে প্রস্তুতি চলছে। মঙ্গলবার আগারগাঁও নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সিইসি এ কথা বলেন। নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) জাতীয় নির্বাচন ও গণপরিষদ নির্বাচন একসঙ্গে করার কথা বলছে। এ বিষয়ে সাংবাদিকরা দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিইসি বলেন, কমিশন এখন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। রাজনৈতিক দল অনেক কথা বলবে, কমিশন রাজনৈতিক বিতর্কের মধ্যে যেতে পারবে না। তিনি বলেন, সরকারপ্রধান যেখানে একটি টাইম ফ্রেম ঘোষণা করেছেন। হয় আগামী ডিসেম্বর, না হয় ২০২৬ সালের শুরুর দিকে। আমরা ডিসেম্বরকে ধরে নিয়েই প্রস্তুতি নিচ্ছি। সুতরাং এখন পর্যন্ত ডিসেম্বরে জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরেই আমাদের চিন্তাভাবনা।
ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন দিতে আরও ছয় মাস সময় লাগলে, তাদের বাস্তবায়নযোগ্য সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে অনেক সময় লাগবে। সেক্ষেত্রে জাতীয় নির্বাচন ডিসেম্বরে হবে কি না-জানতে চাইলে সিইসি বলেন, কোন ধরনের সুপারিশ আসে না দেখে আমরা বলতে পারব না। আমরা ঐকমত্য কমিশনের প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত কোনটা বাস্তবায়নযোগ্য, কোনটা যোগ্য নয় তা বলতে পারব না। আমরা জাতীয় নির্বাচনের জন্য বিদ্যমান যে আইন-কানুন আছে সেভাবে প্রস্তুতি নিচ্ছি।
পতিত আওয়ামী লীগ ও তাদের শরিকরা না থাকায় এবার ভোটের মাঠে বিএনপি ও জামায়াত এখন একে অপরকে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছে। সে অনুযায়ী চলছে মাঠ দখলের নীরব প্রতিযোগিতাও। দুই দলই প্রাথমিকভাবে ৩০০ আসনেই প্রার্থী ঠিক করে রাখছে। নির্বাচন সামনে রেখে নতুন করে যুক্ত হয়েছে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন থেকে গড়ে ওঠা নবগঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তারাও ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়ার কথা জানান দিয়েছে। ভোটের রাজনীতিতে সাফল্য আনতে তৃণমূলে নিজেদের আরও শক্তিশালী করার পরিকল্পনা রয়েছে তারুণ্যনির্ভর দলটির। চরমোনাই পির মুফতি মাওলানা সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার কথা ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে। এর বাইরে বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা ১২ দলীয় জোট, গণতন্ত্র মঞ্চ, গণতান্ত্রিক বাম ঐক্য, বাম গণতান্ত্রিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোট যে যার মতো নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। বসে নেই ইসলামি এবং ধর্মভিত্তিক অন্য রাজনৈতিক দলও। তারাও জোট করে ভোটের মাঠে নামার প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে।
জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল সোমবার যুগান্তরকে বলেন, বিএনপি সব সময় মনে করে দেশ পরিচালিত হবে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে। নির্বাচন হবে, জনগণ যাদের নির্বাচিত করবে, তারা দেশ পরিচালনা করবে-এটাই গণতন্ত্রের আসল সৌন্দর্য। তিনি আরও বলেন, বিএনপি শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে যৌক্তিক সময়ে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। পাশাপাশি নির্বাচনের প্রস্তুতিও নিয়ে রাখছে। আমরা আশা করছি, দ্রুত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে এবং দেশ গণতন্ত্র অভিমুখে যাত্রা করবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরে নির্বাচন ধরেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। ডিসেম্বরে ভোটের বিষয়টি সোম ও মঙ্গলবার আরও স্পষ্ট হয়েছে। সোমবার প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন ডিসেম্বরে ভোট, মঙ্গলবার সিইসি ডিসেম্বরে ভোটের কথা বলেছেন। এ ধরনের বক্তব্যের পর ভোট পেছানোর তেমন কোনো কারণ দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না সোমবার যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচিত সরকার দেশ পরিচালনা করবে, এটাই দেশবাসীর চাওয়া। একটি ঐতিহাসিক প্রয়োজনে এবং ক্রান্তিকালে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা তাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে যাচ্ছি। যাতে দ্রুত সময়ের ভেতরে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষ করে তিনি নির্বাচনের পথে যাত্রা করেন। ইতোমধ্যে সেই আলামত দেখা যাচ্ছে। নির্বাচন কমিশন তাদের প্রস্তুতির কথা জানিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের মতো করে নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু করেছে। আমরাও বসে নেই, আমাদের মতো করে ভোটের প্রস্তুতি শুরু করেছি।
রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, একটি বিষয় ইতোমধ্যে পরিষ্কার, সেটি হচ্ছে-অন্তর্বর্তী সরকার ও নির্বাচন কমিশন আগামী দিনে নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনার পথে যাত্রা শুরু করেছে। সবার প্রত্যাশা অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এ চাওয়া পূরণে সবার আগে প্রয়োজন নির্বাচনের প্রস্তুতি। সেটি সরকার, নির্বাচন কমিশনসহ রাজনৈতিক দলগুলো যে যার মতো শুরু করেছে। আগামী দিনের ভোটের মেরুকরণ কী হবে, কোন দলের সঙ্গে কার জোট হবে; কার সঙ্গে কোথায় আসন সমঝোতা হবে-এসব বিষয়ে ফয়সালা হবে নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক দিন-তারিখ ঘোষণার পর। তাই আপাতত চলছে নিজেদের মধ্যে প্রস্তুতিপর্ব। পবিত্র মাহে রমজানের পর দলগুলো তাদের নির্বাচনি প্রস্তুতি আরও জোরেশোরে শুরু করবে।
এ প্রসঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষ নেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সোমবার যুগান্তরকে বলেন, দেশের মানুষের এ মুহূর্তে প্রধান চাওয়া একটি নির্বাচিত সরকারের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা। আর এটি সম্ভব হবে তখনই, যখন একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আমরা প্রথম থেকেই বলে আসছি, নির্বাচন অনুষ্ঠানে যত সময়ক্ষেপণ হবে, সমাজে তত সংকট বাড়বে, অস্থিরতা বাড়বে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ সামগ্রিক পরিবেশ অবনতির দিকে যাবে। ইতোমধ্যে এর আলামত শুরু হয়ে গেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণে প্রয়োজন দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা অর্পণ। তিনি আরও বলেন, বিএনপি-জামায়াতসহ সব রাজনৈতিক দলই এখন নির্বাচনমুখী কর্মকাণ্ড শুরু করেছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, আমাদের এ মুহূর্তে লক্ষ্য হচ্ছে সাংগঠনিক ভিত্তি মজবুত করা। বিশেষ করে দলের মূলনীতি ঠিক করা এবং জেলা-উপজেলা পর্যায়ে দলকে আরও বিস্তৃত করা। এগুলো আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। এ কাজগুলো শেষ করলে আমরা দলকে শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যেতে পারব। এরপর আমরা নির্বাচনের দিকে মনোযোগ দেব।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল সোমবার যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচন আয়োজনের মূল কাজ নির্বাচন কমিশনের। এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজনে নির্বাচন কমিশনকে সব রকম সহায়তা করা। আশা করি, সরকার তাই করবে। তিনি বলেন, নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। রাজনৈতিক দলগুলো এতে অংশ নেবে। জনগণ যাদের ভোট দেয়, তারা সরকার গঠন করবে। আমার জানামতে, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের জন্য মুখিয়ে আছে। তারা যার যার অবস্থান থেকে প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার নজিরবিহীন অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর শান্তিতে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। গত ১৬ ডিসেম্বর জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতীয় নির্বাচনের একটি সম্ভাব্য সময়ের কথা বলেন। তিনি বলেছিলেন, অল্প সংস্কার করে নির্বাচন চাইলে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব।