মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ‘মব জাস্টিস’
সাতকানিয়ায় জামায়াতের দুই কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা
পাঁচজন গুলিবিদ্ধ, অস্ত্র ও গুলির খোসা উদ্ধার

চট্টগ্রাম ব্যুরো
প্রকাশ: ০৫ মার্চ ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

চট্টগ্রামের সাতকানিয়ায় সালিশের জন্য ডেকে নিয়ে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে ‘মব জাস্টিস’ তৈরি করে জামায়াতের দুই কর্মীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। নিহত নেজাম উপজেলার কাঞ্চনা ইউনিয়নের মধ্যম কাঞ্চনা এলাকার মাহমুদুল হকের ছেলে ও আবু ছালেক একই ইউনিয়নের গুরগুরি এলাকার আবদুর রহমানের ছেলে। হামলায় তাদের পুরো শরীর ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত হয়ে গেছে। এ সময় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন আরও অন্তত পাঁচজন। সোমবার মধ্যরাতে উপজেলার এওচিয়া ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডে চূড়ামণি গ্রামের ছনখোলা এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
সাতকানিয় উপজেলা জামায়াতের আমির কামাল উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, হামলায় নিহত দুজন তাদের সক্রিয় কর্মী। তাদের সালিশের নামে ডেকে নিয়ে পরিকল্পিতভাবে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে হত্যা করা হয়।
স্থানীয়রা জানান-সোমবার রাতে একটি পক্ষকে ঘিরে ফেলার ঘটনায় দুপক্ষের মধ্যে গুলি ও হামলা-পালটাহামলার ঘটনা ঘটেছে। একপক্ষ নেজাম ও আবু ছালেককে কুপিয়ে হত্যা করেছে। গুলিবিদ্ধদের মধ্যে ওবায়দুল হক, নাসির উদ্দিন, আব্বাস উদ্দিন ও মো. মামুনুর রশিদের নাম পাওয়া গেছে। তাদের রাতেই চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, আটটি গুলির খোসা ও একটি অটোরিকশা জব্দ করেছে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত এওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মানিকের সঙ্গে জামায়াত কর্মী নেজামের বিরোধ ও আধিপত্য বিস্তারের জের ধরেই এ ঘটনা ঘটেছে বলে পুলিশ, এলাকাবাসীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (শিল্পাঞ্চল ও ডিবি) রাসেল যুগান্তরকে বলেন, প্রাথমিকভাবে দুপক্ষের আধিপত্য বিস্তার ও পূর্বশত্রুতার জের ধরেই এমন ঘটনা ঘটেছে বলে তারা জানতে পেরেছেন। তবে তদন্তের পর বিস্তারিত বলা যাবে। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, সোমবার তারাবির নামাজের পর একটি মোটরসাইকেল ও আট-নয়টি অটোরিকশায় কাঞ্চনা ইউনিয়ন থেকে এওচিয়া ইউনিয়নে যান নেজামের নেতৃত্বে ৩০-৩৫ জন। তাদের উপস্থিতি দেখে ডাকাত এসেছে বলে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে গ্রামের লোকজন জড়ো করা হয়। তারা নেজাম ও তার সহযোগীদের ঘিরে ফেলেন। এ সময় তারা নেজাম ও আবু ছালেককে ধরে কুপিয়ে হত্যা করে। আর গুলিবিদ্ধ হন পাঁচজন। একটি সূত্র বলেছে, আধা ঘণ্টা ধরে গোলাগুলিতে শতাধিক রাউন্ড গুলি বিনিময় হয়।
ঘটনার পর রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যায় সেনাবাহিনী ও সাতকানিয়া থানা পুলিশের একটি টিম। চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম, সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিল্টন বিশ্বাস ছাড়াও জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি টিমও রাতেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।
মর্গ সূত্র জানিয়েছে, দুজনকে উপর্যুপরি কোপানো হয়েছে। কোপানোর কারণে নেজামের মগজ বেরিয়ে গেছে। তাদের শরীরে শতাধিক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। বেশিরভাগ আঘাতই মাথা আর ঘাড়ে। নেজামের মুখ বিকৃত হয়ে গেছে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে নেজামের পায়ের রগও কেটে দেওয়া হয়েছে।
স্থানীয় জামায়াত নেতা শাহাদাত হোসেন যুগান্তরকে বলেন, দুজনকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে সালিশের নামে ডেকে নিয়ে হত্যা করেছে। তারা দুজনই জামায়াতের কর্মী ছিলেন। মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত দুজনের মাথায় আঘাত করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত দাবি করছি।
জামায়াতের বিবৃতি-হত্যাকাণ্ড পরিকল্পিত : সাতকানিয়ার ছনখোলা গ্রামের দুজন হত্যার ঘটনায় বিভ্রান্তিমূলক সংবাদ প্রচারে জামায়াত নেতারা প্রতিবাদ ও ক্ষোভ জানিয়ে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়েছেন। বিবৃতিদাতারা হলেন-সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের আমির মাওলানা কামাল উদ্দিন ও সেক্রেটারি মুহাম্মদ তারেক হোছাইন, কাঞ্চনা ইউনিয়ন জামায়াতের আমির মাওলানা আবু তাহের ও সেক্রেটারি জায়েদ হোসেন, এওচিয়া ইউনিয়ন জামায়াতের আমির আবু বক্কর ও সেক্রেটারি ফারুক হোসাইন।
বিবৃতিতে নেতারা বলেন, সোমবার রাতের ঘটনা একটি পরিকল্পিত নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এওচিয়া ইউনিয়নের ছনখোলা গ্রামটি বহু আগে থেকেই সন্ত্রাস কবলিত এলাকা। এওচিয়া ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও সন্ত্রাসী নজরুল ইসলাম ওরফে মানিক চেয়ারম্যান ছনখোলা গ্রামের পাহাড়, পাহাড়ি গাছ ও ইটভাটাগুলো নিয়ন্ত্রণে নিতে একাধিকবার সন্ত্রাসী হামলা ও হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। মিথ্যা ও ভিত্তিহীন অসংখ্য মামলা দিয়ে সাধারণ মানুষের পাহাড়, ভূমি জবরদখল করেছিল। এলাকার মানুষ তার অত্যাচার-নিপীড়নে অতিষ্ঠ হয়ে তাকে বয়কট করে। তৎকালীন আওয়ামী সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতার কারণে তার বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করতে পারেনি।
৫ আগস্ট ফ্যাসিস্ট হাসিনার পতনের পর সে এলাকা ছেড়ে আত্মগোপন করলেও তার বাহিনী ধরাছোঁয়ার বাইরে। মানিকের ভাই হারুন ও মমতাজের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই সন্ত্রাসীরা এখনো নানা অপকর্মে জড়িত। সোমবার রাতে পরিকল্পিতভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে আওয়ামী দুঃশাসনে নির্যাতিত ব্যবসায়ী নেজাম উদ্দিন ও আবু ছালেককে বিচারের কথা বলে ডেকে এনে মাইকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে ঘোষণা দিয়ে ডাকাত আখ্যা দিয়ে গণপিটুনির নামে মূলত চেয়ারম্যান মানিকের নির্দেশে তার ভাই মমতাজ ও হারুনের পরিকল্পনায় কুপিয়ে দুজনকে হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে ২০১৬ সালে মানিক চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে জামায়াতের কর্মী কাঞ্চনার আবুল বশরকে ছনখোলাতে হত্যা করা হয়েছিল। চিহ্নিত খুনিদের গ্রেফতার, ঘটনার গডফাদারদের বিরুদ্ধে মামলা ও বিচারের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত না করে আসল হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয় বিবৃতিতে। মঙ্গলবার রাত ৮টায় সাতকানিয়া উপজেলা জামায়াতের প্রচার সেক্রেটারি আইয়ুব আলী এ বিবৃতি পাঠিয়েছেন।
লাশ দাফন : নেজাম ও আবু ছালেকের লাশ ময়নাতদন্তের পর পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয় বিকাল ৫টার দিকে। বাদ মাগরিব সাতকানিয়া উপজেলার কাঞ্চনা আনওয়ারুল উলুম ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা মাঠে নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে তাদের লাশ দাফন করা হয়।