অজ্ঞাত প্রতিষ্ঠানকে ২৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা
ডোনাল্ড ট্রাম্পের এক মন্তব্যে তোলপাড়

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
-67bb8884bbfca.jpg)
বাংলাদেশের অজ্ঞাত সংস্থাকে ২৯ মিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়া হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এ মন্তব্যে তোলপাড় চলছে। তবে এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কেউ মুখ খুলতে চাইছে না। এ ব্যাপারে ইতোমধ্যে দুটি নাম আলোচনায় এসেছে। এর মধ্যে রয়েছে-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আইনুল ইসলাম এবং হাঙ্গার প্রজেক্টের বদিউল আলম মজুমদার। এনজিওবিষয়ক ব্যুরো বলছে, তাদের মাধ্যমে এ ধরনের কোনো অর্থ আসেনি। এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে গেছেন ঢাকায় যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন। যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডির কেউ মুখ খুলতে রাজি নয়। ডোনাল্ড ট্রাম্প যে প্রজেক্টের কথা উল্লেখ করেছেন, ওয়েবসাইট থেকে ওই প্রজেক্টের তথ্য গোপন করে রাখা হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, তারা বিস্তারিত তথ্য জেনে সাংবাদিকদের জানাবেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই দাবি অস্বাভাবিক।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়ন নিয়ে সম্প্রতি একটি মন্তব্য করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল শক্তিশালীকরণে ২৯ মিলিয়ন ডলার অর্থ দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের নাম স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ (এসপিএল)। যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থা ইউএসএইডের মাধ্যমে বাংলাদেশের অজ্ঞাত একটি ফার্ম পেয়েছে এই তহবিল। এই অর্থ ব্যবহার করা হয়েছে উগ্র বামপন্থি কমিউনিস্টদের ক্ষমতায় আনতে। শনিবার ওয়াশিংটনে কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সের শেষদিনে ট্রাম্প এ মন্তব্য করেন। তবে বাংলাদেশে এসপিএল বাস্তবায়ন করছে ‘ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল।’ এর আগে শুক্রবার ওয়াশিংটনে গভর্নরদের এক অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে ফার্মকে ২৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হয়েছে, সেটিতে মাত্র দুজন লোক কাজ করেন। এই সংস্থার নাম কেউ কোনোদিন শোনেনি। কিন্তু তারা চেক পেয়েছে। গভর্নরদের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেন, ‘আপনারা ভাবতে পারেন? আপনার একটি ছোট সংস্থা আছে। সেখানে আপনি ১০ হাজার ডলার পান, ওইখানে এক লাখ ডলার পান। কিন্তু কীভাবে ২৯ মিলিয়ন ডলার দেওয়া হলো।’ তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি ওই সংস্থায় কাজ করা দুজন লোক খুব খুশি, তারা খুবই ধনী। কয়েকদিন পর মহান ব্যক্তি হওয়ার জন্য বড় কোনো ম্যাগাজিনে তাদের ছবি প্রকাশ হবে।’
এ ব্যাপারে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এটি (ট্রাম্পের দাবি) একটি অস্বাভাবিক দাবি। আমার মনে হয় ইউএসএআইডির অর্থায়ন বাতিলকে বৈধতা দিতে এখানে বাংলাদেশের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ এভাবে কোনো সংস্থার অর্থ নেওয়ারই সুযোগ নেই।’ তিনি বলেন, ২৯ মিলিয়ন ডলার যদি এমন কোনো সংস্থাকে যুক্তরাষ্ট্র দিয়ে থাকে, তাহলে সেটি যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের দুর্বলতা। কারণ ১ ডলারই হোক আর ২৯ মিলিয়ন ডলারই হোক-সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো অর্থ ছাড় হওয়া অসম্ভব। আর এককভাবে কোনো সংস্থার ২৯ মিলিয়ন ডলার পাওয়ার খবরটিই অস্বাভাবিক।
এদিকে যেসব প্রতিষ্ঠান রাজনীতি, গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে গত কয়েক বছর কাজ করছে এখন তাদের অনেকের দিকেই আঙুল তুলতে শুরু করেছেন অনেকে। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থ বাংলাদেশের ক্ষমতা বা সরকার পরিবর্তনে ব্যবহার হয়েছে কি না তা নিয়ে আলোচনা চলছে।
যুগান্তরের অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশে পরিচালিত ইউএসএআইডির এ প্রকল্পের নাম এসপিএল (স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ)। ৭ বছর মেয়াদি এ প্রকল্প ২০১৭ সালের মার্চে শুরু হয়। শেষ হয়েছে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে। প্রকল্পে ব্যয় ২৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্রতি ডলার ১২০ টাকা হিসাবে স্থানীয় মুদ্রায় যা প্রায় সাড়ে ৩শ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ‘ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল’, এই প্রকল্পের আওতায় দেশের সব মহানগর ও ২৪ জেলায় দেশের যুব-রাজনীতিবিদদের গণতন্ত্র ও নেতৃত্বের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপি, আওয়ামী লীগ এবং জাতীয় পার্টির ইউনিয়ন, উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ের নেতারা রয়েছেন। প্রকল্পের আওতায় ৫ শতাধিক রাজনীতিবিদ এবং ৮ শতাধিক যুবক সরাসরি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মিলিয়ে সুবিধা পেয়েছেন ৩০ হাজারের বেশি মানুষ। ইউএসএআইডি সূত্র জানায়, নিজেদের মধ্যে একতা বজায় রেখে রাজনৈতিক দলগুলো যাতে জনগণের কল্যাণে কাজ করতে পারে, সেটিই ছিল এর লক্ষ্য। ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনাল এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। প্রকল্পের আওতায় ২৫ থেকে ৪৫ বছর বয়সি নেতাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে যারা পদে আছেন এবং ১০ বছরের বেশি রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা রয়েছে, এদেরকেই বেছে নেওয়া হয়। প্রতি মাসে ৩ থেকে ৫ দিন চলেছে এ কার্যক্রম। বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকায় এনে আবাসিক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আইনুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যে প্রকল্পের কথা বলেছেন, সেটি হচ্ছে ‘স্ট্রেনদেনিং পলিটিক্যাল ল্যান্ডস্কেপ’ (এসপিএল)। এটি ২০১৭ সাল থেকে চলছে। এই প্রকল্পের সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমি একটি প্রকল্পে গবেষণার কাজ করছি। সেটি হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশন ফর ইলেকট্রোরাল সিস্টেম’ (আইএফইএস)। ২০১৩ সাল থেকে এখানে জড়িত। আমার কিছু শিক্ষার্থীকে সম্পৃক্ত করে এখানে কাজ করি। আপনার প্রকল্পে জনবল দুজন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি কোনো এনজিও নই। গবেষণার জন্য কাজ করছি। ফলে জনবলের প্রশ্ন আসবে কেন?
এনজিও ব্যুরো সূত্র জানায়, বর্তমানে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে ৮৮টি এনজিও পরিচালিত হয়। কিন্তু এই প্রকল্পের টাকা কোনো এনজিও পায়নি। জানতে চাইলে এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর ভারপ্রাপ্ত মহাপরিচালক মো. আনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, গণমাধ্যমে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য প্রচারের পর আমি এনজিও ব্যুরোতে খোঁজ নিয়েছি। এখানে এই নামে কোনো প্রজেক্ট পাইনি। অর্থাৎ এই অর্থের অনুমোদন ও ব্যবহারের সঙ্গে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো সম্পৃক্ত নয়। তিনি বলেন, এটি ইউএসএআইডির প্রজেক্ট। আর এই ইউএসএআইডি যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের প্রতিষ্ঠান। তারা সরাসরি বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে কাজ করে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে বেশ কিছু বিদেশি এনজিও রয়েছে। এগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্থ আসে। এই অর্থ ছাড়ের জন্য আমাদের অনুমোদন লাগে। কিন্তু ইউএসএআইডির কাজ করার জন্য আমাদের অনুমোদন লাগে না। এগুলো ইআরডি (অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ) দেখে।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স (সিডিএ) ট্রেসি অ্যান জ্যাকবসন পররাষ্ট্র সচিব এম জসিম উদ্দিনের সঙ্গে রোববার বৈঠক করেন। বৈঠকে চলমান গণতান্ত্রিক রূপান্তর, বাণিজ্য, বিনিয়োগ, উন্নয়ন সহযোগিতা এবং জ্বালানি নিরাপত্তা ইত্যাদি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি তুলে ধরেন। পাশাপাশি রোহিঙ্গা ইস্যুর মতো পারস্পরিক স্বার্থের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক জোরদারে মার্কিন প্রশাসনের প্রতিশ্রুতিও ব্যক্ত করেন তিনি। তবে বৈঠক শেষে সাংবাদিকরা তাকে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্যের ব্যাপারে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো জবাব দেননি। এছাড়া সাংবাদিকরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করলে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ ব্যাপারে বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে তারা কথা বলবেন।