Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ঢাকা-রাজশাহী রুটে বাসে ডাকাতি

যাত্রীদের মুখে সেই রাতের লোমহর্ষক বর্ণনা

Icon

রাজশাহী ব্যুরো ও নাটোর প্রতিনিধি

প্রকাশ: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

যাত্রীদের মুখে সেই রাতের লোমহর্ষক বর্ণনা

ঢাকায় ফেরি করে সুপারি এবং খেজুরের গুড় বিক্রি করেন সোহাগ হোসেন (২৩) ও ওমর আলী (৫২)। দুজনে ১১ দিনে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা বিক্রি করেছিলেন। গত সোমবার দিনগত রাতে তারা নাটোরের বড়াইগ্রাম যেতে ঢাকার গাবতলী থেকে একটি বাসে উঠেছিলেন। কিন্তু মাঝপথে চলন্ত বাসে তাদের সর্বস্ব লুট হয়েছে। বাসের অন্য যাত্রীরাও ডাকাতদের হাত থেকে রক্ষা পাননি। এ সময় নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানি ও ‘ধর্ষণের’ মতো ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। যাত্রীরা জানিয়েছেন, লোমহর্ষক এই ডাকাতির ঘটনার অভিযোগ নিতে ঠেলাঠেলি করছে দুই থানার পুলিশ। ডাকাতদের সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগে যাত্রীরা বাসের চালক, সুপারভাইজার ও চালকের সহকারীকে নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় সোপর্দ করলেও ওইদিনই তারা আদালত থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন।

ইউনিক রোড রয়েলসের আমরী ট্রাভেলস নামের একটি বাসে (ময়মনসিংহ-ব-১১-০০৬৯) ভয়াবহ এই ডাকাতির ঘটনা ঘটে। বাসের দুই নারী যাত্রীকে ধর্ষণের কথা একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। তাতে বলা হয়েছে, গাজীপুরের চান্দুরা মোড় থেকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকার ভেতরে ডাকাতি হয়েছে। ভুক্তভোগী যাত্রীরা বলছেন, পরদিন সকালে ডাকাতি হওয়া বাসটি নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় পৌঁছানোর পর দুই নারী যাত্রী পুলিশের কাছে শ্লীলতাহানির অভিযোগ করেন। তবে বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলামের দাবি নারী যাত্রীদের নির্যাতন বা ধর্ষণের ঘটনার কথা কেউ তাকে বলেননি। তাই কোনো মামলা হয়নি। বাসটির ভুক্তভোগী যাত্রী সোহাগ হোসেন, ওমর আলী, মজনু আকন্দ (৭৩) এবং তাদের ব্যবসায়িক পার্টনার আবু হানিফ বাস আটকানোর পর থেকে বৃহস্পতিবার বিকাল পর্যন্ত বড়াইগ্রাম থানায় অবস্থান করছিলেন বলে জানা গেছে। তারা মামলা করতে চাইছেন। কিন্তু পুলিশ বলছে, ঘটনাস্থল টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানা এলাকা হওয়ায় সেখানেই মামলা হবে। বৃহস্পতিবার বিকালে ওমর আলী বলেন, ইতোমধ্যে নাটোরের পুলিশ সুপার তাদের বক্তব্য লিপিবদ্ধ করে নিয়ে গেছেন। মির্জাপুর থানার পুলিশ নাটোরের বড়াইগ্রাম থানায় যাবেন বলে তাকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে টাঙ্গাইলের মির্জাপুর থানার ওসি মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘লোকজন বলছেন ঘটনাটি মির্জাপুর থানা এলাকার। আসলে প্রকৃত ঘটনা কী, এটা আমরা জানার চেষ্টা করছি।’

বাসযাত্রীরা অভিযোগে আরও বলেছেন, ৪০ জনের মতো যাত্রী নিয়ে সোমবার রাত ১১টার দিকে ঢাকার গাবতলী বাসস্ট্যান্ড থেকে রাজশাহীর উদ্দেশে বাসটি ছাড়ে। গাজীপুরের চান্দুরা ক্রসিং পার হওয়ার পর রাত ১২টা ৩৫ মিনিটে যাত্রীবেশী ডাকাতদল বাসে ডাকাতি শুরু করে। তিন ঘণ্টা ধরে ডাকাতি শেষে ঘুরিয়ে একই জায়গায় বাসটি নিয়ে গিয়ে রাত ৩টা ৫২ মিনিটে ডাকাতরা নেমে যায়। তখন যাত্রীরা দেখতে পান, তাদের অবস্থান মির্জাপুর থানা এলাকার একটি ফিলিং স্টেশনের কাছে। ওই সময় বাসচালক, তার সহকারী ও সুপারভাইজার গন্তব্যে যেতে অস্বীকার করেন। তবে যাত্রীদের চাপের মুখে তারা রাজশাহীর উদ্দেশে বাসটি ছাড়েন। মঙ্গলবার দুপুরের দিকে বড়াইগ্রামের থানায় নিয়ে যাওয়া হয় বাসটি। এলাকার মানুষজন খবর পেয়ে বাসের চালক, সুপারভাইজার ও চালকের সহকারীকে পুলিশে সোপর্দ করে।

ওই রাতের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে যাত্রী সোহাগ হোসেন বলেন, ‘গাবতলী থেকে বাসটি ছাড়ার সময় পেছনের সিটে তিনজন ডাকাত ওঠে। বাসের লোকজনের সঙ্গে তিনজন কথা বলে কিছুদূর এসে আরও পাঁচজনকে বাসে ওঠায়। এরপরই ডাকাতদের একজন বাসটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। ডাকাতরা প্রথমে একজন যাত্রীকে ছুরিকাঘাত করে। এতে তার জামা রক্তে ভিজে যায়। তখন ওই যাত্রী তার টাকাসহ সবকিছু ডাকাতদের হাতে তুলে দেন। আরেকজনের হাতে ছুরি দিয়ে আঘাত করা হয়। তার হাতের কিছু অংশ কেটে যায়। এভাবে প্রত্যেক যাত্রীর কাছ থেকে সবকিছু লুট করে ডাকাতদলের সদস্যরা।’

সোহাগ হোসেন আরও বলেন, ‘একজন ডাকাত আমাকে বাসের সিটের মাঝখানে ফেলে দিয়ে বুকের ওপর পা তুলে দাঁড়ায়। এ সময় আমার ব্যবসায়িক পার্টনার ওমর আলীর গলায় ছুরি ধরে ২০ হাজার টাকা নেওয়া হয়। ওমর আলীর কাছ থেকে এক লাখ টাকার একটি বান্ডিল সিটের নিচে পড়ে গেলে ডাকাতরা সেই টাকাও নিয়ে নেয়। ডাকাতরা প্রত্যেক যাত্রীর মোবাইল ফোন লুট করে। শুধু আমার ফোনটি নিচে পড়ে যাওয়ায় নিতে পারেনি।’

বাসের আরেক যাত্রী বড়াইগ্রামের মৌখাড়া গ্রামের মজনু আকন্দের ৪৬ হাজার টাকা নিয়ে গেছে ডাকাতরা। তিনি বলেন, ‘ডাকাতরা বাসের নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানি করে। মেয়েরা এমনভাবে চিৎকার দিয়েছে যে, তারা বুঝতে পেরেছেন বড় কিছু ঘটেছে। তিন ঘণ্টা ধরে বাস শুধু ওই এলাকায় ঘুরিয়ে সব যাত্রীর টাকা-পয়সা, স্বর্ণালংকারসহ সবকিছু লুট করে নেওয়ার পর ডাকাতদের নামিয়ে দেওয়া হয়। এরপর বাসের লোকজন টালবাহানা করতে থাকে। তারা জানায়, গাড়িতে তেল নেই। টাকা নেই। যেতে পারবে না। যাত্রীদের সেখানেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। যাত্রীরা নামতে না চাইলে পরে চালক রাজশাহীর উদ্দেশে গাড়ি ছাড়ে।’

যাত্রী মজনু আকন্দ আরও বলেন, ‘বাসের লোকজন প্রথমে বলেছিল তাদের টাকা-পয়সাও ডাকাতরা নিয়ে গেছে। কিন্তু যমুনা সেতুর টোল প্লাজায় ড্রাইভার টোল পরিশোধ করে। যাত্রীদের অভিযোগ, বাসের লোকজনের যোগসাজশেই ডাকাতির ঘটনা হয়েছে।’

ওমর আলী বলেন, ‘দুই নারী যাত্রী তাদের কাছে একাধিকবার বলেছেন যে, ডাকাতরা তাদের শ্লীলতাহানি ঘটিয়েছে। তারা ঘটনাটি বড়াইগ্রাম থানার সেকেন্ড অফিসার শরিফুলের কাছেও বলেছেন।’

এ বিষয়ে বড়াইগ্রাম থানার এসআই শরিফুল ইসলাম বলেন, ‘দুজন নারী যাত্রী তাদের গায়ে হাত দিয়ে গহনাপত্র খুলে নেওয়ার কথা বলেছেন। যেভাবে খুলে নেওয়া হয়েছে, তাতে তাদের শ্লীলতাহানি ঘটেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।’

এদিকে ডাকাতির ঘটনায় আটক বাসের সুপারভাইজার, চালক ও চালকের সহকারী বুধবার নাটোরের একটি আদালত থেকে জামিনে মুক্তি পেয়েছেন। জানা যায়, বড়াইগ্রাম থানার এসআই শরিফুল ইসলাম বুধবার ইউনিক রোড রয়েলস বাসের চালক বাবলু ইসলাম, চালকের সহকারী সুমন ইসলাম ও সুপারভাইজার মাহবুল আলমকে আদালতে চালান করেন। ওইদিন সন্ধ্যায় আদালত শুনানি শেষে তাদের জামিন দেন।

নাটোর আদালতের পুলিশের পরিদর্শক মোস্তফা কামাল বলেন, আসামিদের ৫৪ ধারায় চালান করায় আদালত তাদের জামিন দেন।

বড়াইগ্রাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সিরাজুল ইসলাম জানান, বাসের যাত্রীরা মৌখিকভাবে পুলিশকে ডাকাতির কথা বলেছেন। অনেক যাত্রী রাস্তায় নেমে গেছেন। দুজন নারী যাত্রী এসেছিলেন থানায়। তাদের একজনের বাড়ি নাটোরের লালপুরে, আরেকজনের বাড়ি রাজশাহীর পুঠিয়ায়। তারা তাদের নির্যাতনের ব্যাপারে কোনো কথা বলেননি। তিনি বলেন, ‘বাসে যাত্রী ধর্ষণের খবরটা কীভাবে ছড়িয়েছে বুঝতে পারছি না।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম