ডাকসুর সাবেক তিন ভিপির অভিমত
ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি নতুন ষড়যন্ত্র

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি ভুল এবং হঠকারী চিন্তা-এমন মন্তব্য করেছেন ডাকসুর সাবেক তিন ভিপি। তারা বলেন, এটা নতুন ষড়যন্ত্রের অংশ। এতে পরিবেশ আরও খারাপ হবে। তরুণ তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা কিংবা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হওয়ার জায়গা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। যার প্রমাণ চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান। যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছেন, তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য থাকতে পারে। তাদের আরও অভিমত-ছাত্র রাজনীতিকে অবারিত করাই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সুন্দর রাখার পথ। সেখানে নিয়মিত ছাত্র সংসদের নির্বাচন করা অপরিহার্য।
মঙ্গলবার খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) সংঘর্ষের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি বন্ধের দাবি করছে কয়েকটি সংগঠন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বুধবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাবেক তিন ভিপি-মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মাহমুদুর রহমান মান্না ও নুরুল হক নুর যুগান্তরের কাছে এ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।
মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যারা ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছেন, তারা শিক্ষার্থীদের একটা ক্ষুদ্র অংশ। শিক্ষার্থীদের ছাত্র সংগঠন করার অবাধ অধিকার থাকতে হবে। এটি তাদের নাগরিক অধিকারের প্রশ্ন। ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা যারা বলে তারাও তো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বলেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি থাকবে না সেটা তো একটা রাজনৈতিক বক্তব্য। এ দাবি নিয়ে যখন মিছিল করে দাবি তুলে তারাও তো রাজনীতি করছে। এটার নাম হচ্ছে বিরাজনীতিকরণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি না থাকলে মাস্তানি, গুন্ডাবাহিনীর রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করা যায়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সমস্যা ছাত্র রাজনীতি নয়, বরং সমস্যা হলো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতি কম। এর জন্য রাজনীতি অবাধ করে দিলে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি কোথাও কোনো অরাজকতা সৃষ্টি হবে না। সাধারণ ছাত্ররা তার প্রমাণ করেছে গণ-অভ্যুত্থান চলাকালে। সেখানে সাধারণ ছাত্রদের জাগরণ হয়েছিল।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধের দাবি একটা বিভ্রান্তিমূলক ও উদ্দেশ্যমূলক উল্লেখ করে তিনি বলেন, এর পেছনে অবশ্যই ষড়যন্ত্র রয়েছে। সুতরাং রাজনীতি করা যাবে না এ কথা যারা বলে তাদের অবিলম্বে গ্রেফতার করা উচিত। কারণ এটি সংবিধানবিরোধী। প্রত্যেকটি নাগরিকের রাজনীতি করার অধিকার আছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদেরও রাজনৈতিক দল করার অধিকার আছে। কিন্তু এখানে তো রাজনৈতিক দল করার অধিকারকে ছাপিয়ে তাদের কোনো সংগঠন করার অধিকার থাকবে না বলা হচ্ছে। কেন আইনজীবী, চিকিৎসক, সাংবাদিক, পুলিশ, ব্যবসায়ীদের সংগঠন নেই? সবার সংগঠন করার অধিকার থাকবে, তাহলে ছাত্রদের থাকবে না কেন?
ডাকসুর সাবেক এই ভিপি আরও বলেন, সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করে পেশিশক্তির দাপট এবং অর্থশক্তির অশুভ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা উত্থাপন হচ্ছে। কিছু ছাত্রকে বিভ্রান্ত করে এই বলে যে, ছাত্র রাজনীতি বলতে আগের দুঃশাসনের সময়কাল বা স্বৈরাচারী সরকারগুলো ছিল সেই সময়ে ছাত্র রাজনীতির নামে যে কলঙ্কজনক ঘটনাগুলো ঘটেছে, তাতে এই ধরনের একটা ধারণা তৈরি করা হয়েছে- মাস্তানতন্ত্রই হলো ছাত্র রাজনীতি। আসলে তা সত্য নয়। সুতরং মাস্তানতন্ত্র থেকে ছাত্র রাজনীতিকে উদ্ধার করতে হবে। যারা মাস্তানতন্ত্র করে তারাই আজকে দাবি তুলছে ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করো। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ হলে মাস্তানতন্ত্র কায়েম করে তারা প্রশাসনিক সহায়তায় সব রকম দুষ্কর্মের হোতা হিসাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দখলদারিত্ব কায়েম করতে পারবে।
মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, খুব অস্বাভাবিক লাগল জুলাই-আগস্টের মতো এত বড় একটা গণ-অভ্যুত্থানের পরে শিক্ষার্থীরা ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ বা বন্ধের কথা বলছে। অথচ পুরো এই অভ্যুত্থানই রাজনৈতিক ফসল। শুরুটা যেভাবে করেছিল শুধু কোটার আন্দোলন, তাতে কোনো রাজনীতি নেই। এটাকে শেষ পর্যন্ত সরকারের উৎখাতের ডাক দিয়েছিল রাজনৈতিকভাবে। এখন ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা তারা কীভাবে বলেন? এ ঘটনা নিয়ে মারামারি-কাটাকাটি। এমন নয় যে, খুব নিরীহ ছাত্ররা সেটা করছে। তারা বলছে যে, আমরা কোনো লেজুড় নই। লেজুর তো কেউ স্বীকার করে না, কাজে হয়। এতে কোনো সন্দেহ নেই নতুন যে ছাত্র সংগঠনের কথা বলা হচ্ছে তারাও নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত আছে। এটা কোনো দোষের নয়। বরং রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকাই উচিত। এই ভুল ও বিভ্রান্তি দিয়ে যেটা শুরু হলো ব্যক্তিগতভাবে বলব, এখন সময় হচ্ছে আরও বৃহত্তর ঐকমত্যের। যদি গণতন্ত্র নির্মাণ করতে চাই তাহলে নিজেদের মধ্যে লড়াই করে তা পারব না। আমাদের সামনে মিশরের উদাহরণ আছে। এই লড়াই করে মিশরের অভ্যুত্থানটাই শেষ হয়ে গেছে। তিউনিশিয়া বা নেপাল এসব জায়গায় পরস্পরের মধ্যে বোঝাপড়ার বা সমঝোতার ভিত্তিতে গণতন্ত্র নির্মাণে বেশ এগিয়ে যাচ্ছে। আমাদের সেই পথে যাওয়ার চেষ্টা করা উচিত। এ রকম বিভেদ সৃষ্টি করে কারও লাভ হবে না। এতে দেশের ক্ষতি হবে।
মাহমুদুর রহমান মান্না আরও বলেন, রাজনীতি তো থাকবেই। যারা বলছে তারাও রাজনীতিই করবে। তারা আসলে কী চায়? শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন চাইলেও তো রাজনীতির কথা বলতে হবে। ছাত্র রাজনীতি বন্ধ করার কথা তারা না বুঝে বলছে, আবেগ থেকে বলছে। অথবা কল্পিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে এ ধরনের কল্পিত বক্তব্য দিচ্ছে।
সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর মনে করেন, কিছু ছাত্র ও শিক্ষক বুঝে না বুঝে ছাত্র রাজনীতির বিরোধিতা করছে, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা বলছে। আর এটার সুযোগ নিয়ে যারা আন্ডারগ্রাউন্ড ও গোপনে সংগঠন করে তারা আবার ফায়দা নেওয়ার জন্য সুর মিলাচ্ছে, যেন সুবিধাটা পায়। সেক্ষেত্রে সেটা কখনোই সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এবং সঠিক দৃষ্টিভঙ্গিও নয়। মাথাব্যথা হলে তো মাথা কেটে ফেলা তো কোনো সমাধান নয়। সমাধান রোগ নির্ণয়ের জন্য আমাদের চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে, ওষুধ দিতে হবে। ক্যাম্পাসগুলো ১৬ বছরের সামগ্রিক জাতীয় রাজনীতিতেই যে অধঃপতন ও কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থার উত্থান হয়েছে, ছাত্র রাজনীতিও তার বাইরে ছিল না। তার মধ্যে থেকেই কিন্তু এই ছাত্র সমাজ জাতিকে মুক্ত করেছে। ছাত্রদের যে মুক্ত জ্ঞানচর্চা ও মুক্তচিন্তার জায়গাটা তা হচ্ছে এই ছাত্র রাজনীতি, ছাত্র সংগঠন করা। এ সুযোগ দিতে হবে। সেক্ষেত্রে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন করাও জরুরি।
তিনি আরও বলেন, ছাত্র রাজনীতি বন্ধের কথা যারা বলছেন তাদের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা আছে। কেউ আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনকে সুবিধা দিতে বা কেউ আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠনকে প্রসারিত করার জন্য এ বিষয়ে সপক্ষে কথা বলছেন। কিন্তু ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি থাকতে হবে।