
প্রিন্ট: ১৫ মার্চ ২০২৫, ০১:১৯ পিএম

বিশেষ প্রতিনিধি
প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
আরও পড়ুন
লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বিদ্যুতের মুখ না দেখলেও বায়ুবিদ্যুৎ (উইন্ডমিল) প্রকল্পের নামে এ খাত থেকে সরকারের শতকোটি টাকার বেশি গচ্চা গেছে। এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রীয়ভাবে মাত্র ২ মেগাওয়াটের দুটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নিমাণ হয়েছে। যদিও উৎপাদনের ২ বছর পর প্রথমটি এবং পরীক্ষামূলক উৎপাদন চলাকালে দ্বিতীয় কেন্দ্রটিও বন্ধ হয়ে গেছে। কেন্দ্র দুটির পেছনে সমীক্ষা, স্থাপন, সংস্কার, মেরামত-সব মিলে সরকারের এই অর্থ গচ্চা গেছে। এর মধ্যে ফেনীর সোনাপুর গ্রামের কেন্দ্রটিতে গেছে ৫০-৬০ কোটি এবং কক্সবাজারের কুতুবদিয়া কেন্দ্রের জন্য ৩০-৪০ কোটি টাকা। গত সরকার রেন্টাল-কুইক রেন্টাল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় এ খাতে নজর কমে যায়। ফলে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদের প্রথমদিকে বায়ুবিদ্যুৎ খাত সেভাবে বিকাশলাভ করেনি। নানাভাবে নানা নামে রেন্টাল-কুইক রেন্টাল থেকে লুটপাট শেষ হওয়ার পর গত নির্বাচনের আগে এদিকে দৃষ্টি ফেরায়।
সরকার বায়ুশক্তি থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১১৫৩ মেগাওয়াট এবং ২০৩০ সালের মধ্যে ১৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। কিন্তু নানা অনিয়ম, দুর্নীতি আর লুটপাটের কারণে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের ৩ বছর পেরিয়ে গেলেও উৎপাদন হয়েছে মাত্র ৬০ মেগাওয়াট। সেটা সরকারি নয়, বেসরকারিভাবে স্থাপিত কেন্দ্র থেকে এসেছে। যেখান থেকে সর্বোচ্চ ৩০ মেগাওয়াটের মতো বিদ্যুৎ যোগ হচ্ছে জাতীয় গ্রিডে। অপরদিকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে বাগেরহাটের মোংলায় ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন একটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করার জন্য সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেছে মোংলা গ্রিন পাওয়ার কোম্পানি। চুক্তি স্বাক্ষরের দুই বছরের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন শুরু করার কথা থাকলেও খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এখনো কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এছাড়া বিগত আওয়ামী লীগ সরকার শেষ মাসে ৩/৪টি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প অনুমোদনের জন্য চূড়ান্ত করে রেখে গেলেও বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় এসে ওইসব প্রকল্প বাতিল করে দিয়েছে। জানা যায়, ওই প্রকল্পগুলোর সঙ্গে সাবেক সরকারের মন্ত্রী, এমপি ও দলীয় প্রভাবশালীদের মালিকানার সম্পর্ক ছিল।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সিস্টেম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বিভাগের পরিচালক ও পিপিপি সেলের সাবেক পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম মোল্লা যুগান্তরকে বলেন, সরকারিভাবে দেশে মাত্র ২টি বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ করা হয়েছে। দুটি কেন্দ্রই বর্তমানে অচল অবস্থায় হয়ে পড়ে আছে। তবে বেরসরকারি উদ্যোগে কক্সবাজারে ৬০ মেগাওয়াটের একটি কেন্দ্র চালু আছে। মোংলায় একটি কেন্দ্র নির্মাণাধীন আছে। নষ্ট কেন্দ্রগুলো মেরামতে আরও অনেক টাকা লাগবে। তিনি বলেন, মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ২০৩০ সালের মধ্যে ১৩৭০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের টার্গেট আছে।
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, ১৯৮২ সালে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রথম একটি গবেষণা জরিপ চালানো হয়। ওই জরিপের প্রাথমিক গবেষণায় দেশের ৩০টি আবহাওয়া তথ্য স্টেশন থেকে বাতাসের তথ্য নেওয়া হয়। তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বায়ুর গতি প্রকৃতি অনুসারে ৯টি স্থানকে বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য চিহ্নিত করা হয়। এরপর আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ২০০৫ সালে একটি পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় ফেনীর মহুরি নদীর তীর ও সোনাগাজী চরাঞ্চল ঘেঁষে খোয়াজের লামছি মৌজায় ৬ একর জমির ওপর বাংলাদেশের প্রথম বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়। কিন্তু ২০০৭ সালে কারিগরি ত্রুটি, অব্যবস্থাপনা ও পর্যাপ্ত বাতাস না থাকায় এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তী সময়ে মোটা অঙ্কের টাকায় সংস্কার করে ২০১৪ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে তা পুনরায় চালু হয়। চালু হওয়ার পর ২০১৪ সালে মোট উৎপাদন হয়েছিল প্রায় ২ লাখ ২ হাজার ৪৩৯ ইউনিট। তখন গড় উৎপাদন ছিল দৈনিক ১৬ হাজার ৮৩০ ইউনিট। পরবর্তী সময়ে পিডিবির প্রজেক্টের আওয়তায় প্যান এশিয়া পাওয়ার সার্ভিস লিমিটেডের মাধ্যমে চারটি টারবাইন দিয়ে বাতাসকে কাজে লাগিয়ে ২২৫ কিলোওয়াট করে ৯শ কিলোওয়াট বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়। এটির সর্বোচ্চ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ০.৯০ মেগাওয়াট। কিন্তু সংস্কারের কিছুদিন পর ফের বন্ধ হয়ে যায় কেন্দ্রটি। বর্তমানে অচল অবস্থায় পড়ে আছে।
২০০৪ সালের ২৩ জানুয়ারি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয়। ৯০০ কিলোওয়াট (প্রায় এক মেগাওয়াট) উৎপাদনক্ষমতাসম্পন্ন এ বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে তখন ব্যয় হয় ৭ কোটি ৩০ লাখ টাকা। ২০০৫ সালের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনও শুরু হয়। চালু অবস্থায় সর্বোচ্চ উৎপাদন রেকর্ড হয় ২৫০ কিলোওয়াট। বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ার, জেনারেটর, কন্ট্রোল প্যানেল, সাবস্টেশন, ব্লেড, ম্যাচিং গিয়ার এলিমেন্ট স্থাপনসহ প্রায় ৫০ মিটার উঁচু টাওয়ারের মাথায় দেড় টন ওজনের পাখা বসানো হয়। যাতায়াতের জন্য মুহুরী সেচ প্রকল্প থেকে বিদ্যুৎকেন্দ্র পর্যন্ত সড়কও নির্মাণ করা হয়। কেন্দ্রটি পরিচালনায় স্থানীয় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে ১১/০.৪ কেভি লাইনের একটি সংযোগ টানার পাশাপাশি টু-ওয়ে মিটারও স্থাপন করা হয় উৎপাদিত বিদ্যুৎ কেনাবেচার জন্য। কিন্তু উৎপাদন শুরুর কয়েক মাস পরেই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে পরিবেশবান্ধব ও দৃষ্টিনন্দন কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর প্রায় আট বছর কেটে গেলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুনরায় চালুর উদ্যোগ নেয়নি সরকার কিংবা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। অযত্ন-অবহেলায় বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিণত হয়েছে গোচারণ ভূমিতে। জানা যায়, ১ মেগাওয়াটের মতো উৎপাদনক্ষম কেন্দ্রটি চালাতে গিয়ে এ পর্যন্ত সরকারের ৬০ কোটি টাকার বেশি অর্থ গচ্চা গেছে।
১ মেগাওয়াটের অপর আরেকটি বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র রয়েছে কক্সবাজারের কুতুবদিয়ায়। ২০০৮ সালের ১ বৈশাখে এ কেন্দ্র থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ ৬০০ গ্রাহকের মধ্যে পরীক্ষামূলকভাবে বিতরণও করা হয়েছিল। ৫০টি টারবাইনের মাধ্যমে কেন্দ্রটি চালু করা হয়। প্রতিটির ক্ষমতা ছিল ২০ কিলোওয়াট করে। অর্থাৎ এ কেন্দ্রের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ১ মেগাওয়াট। জানা যায়, পরীক্ষামূলকভাবে বিদ্যুৎ বিতরণের পরপরই যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে কেন্দ্রটি বন্ধ হয়ে যায়। প্রথম দফায় সংস্কারের পর কিছুদিন চলে। একপর্যায়ে পুরো কেন্দ্রটি অচল হয়ে পড়ে। জানা যায়, নির্মাণ, সংস্কারসহ বিভিন্ন খাতে কেন্দ্রটির জন্য সরকারের ৩০ থেকে ৪০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কাজে না লাগায় সরকারের পুরো টাকাই গচ্চা গেছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এরপর দীর্ঘদিন এ সেক্টরের প্রতি কোনো ধরনের নজর ছিল না সরকারের। কারণ হিসাবে সেক্টরের বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ওই সময়ে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার রেন্টাল আর কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে ব্যস্ত ছিল। তবে ২০১৬-২০১৮ সালের মধ্যে তিনটি পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি কর্তৃক সাইট স্প্যাসিফিক উইন্ড রিসোর্স অ্যাসেসমেন্টের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০১৬ সালে কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড কক্সবাজার জেলার মহেশখালী উপজেলার মাতারবাড়ী দ্বীপে একটি উইন্ড ফার্ম স্থাপনের জন্য তথ্য আহরণ ও সম্ভাব্যতা যাচাই করে। ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত উইন্ড ডেটা সংগ্রহ করা হয়। এতে মিন উইন্ড স্পিড পাওয়া যায় ১০০ মিটার উচ্চতায় ৫.৭৬ মি./সে.। এরপর ইলেকট্রিসিটি জেনারেশন কোম্পানি অব বাংলাদেশ (ইজিসিবি)-এর উদ্যোগে ফেনীর সোনাগাজী উপজেলায় একটি উইন্ড রিসোর্স স্টাডি হয়। উইন্ড মেজারমেন্ট ইনস্ট্রুমেন্ট হিসাবে লাইডার ব্যবহার করা হয়। ২০১৭ সালে নর্থ-ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি লিমিটেড চীনের ফুজিয়ান ইলেকট্রিক পাওয়ার সার্ভে এবং ডিজাইন ইনস্টিটিউটকে পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলায় নর্থ ওয়েস্ট পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি পায়রা থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্টের কাছে ৫০ মেগাওয়াট উইন্ড পাওয়ার প্ল্যান্ট স্থাপনের জন্য বায়ুর তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ২০১৯ সালের নভেম্বরে ওই স্থানে ফেডি কর্তৃক দাখিলকৃত এক জরিপে দেখা যায়, ১২০ মিটার উচ্চতায় মিন উইন্ড স্পিড ৫.৪৬৬ মি./সে.।
নিয়ম হলো-কোনো স্থানে বায়ুবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করতে হলে সেই স্থানের বায়ুপ্রবাহের গতিবিধি ও পর্যাপ্ততা সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত দীর্ঘমেয়াদে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করতে হবে। সে হিসাবে উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের ৯টি স্থানে বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশ্যে ‘উইন্ড রিসোর্স ম্যাপিং প্রকল্প’-এর আওতায় বায়ুপ্রবাহের তথ্য-উপাত্ত (ডেটা) সংগ্রহ করা হয়। ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে এসব স্থানের উইন্ড ম্যাপিং কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। ওই প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা বিশেষত খুলনার দাকোপ, চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং চাঁদপুরের নদীমোহনার এলাকাগুলোয় ১০০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের গড়বেগ ৬ মি./সে. এর বেশি, যা বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। ওই প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে প্রায় ২০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা রয়েছে, যেখানে বাতাসের বেগ ৫.৭৫-৭.৭৫ মি./সে.। যার মাধ্যমে প্রায় ৩০ হাজার মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব। এরপরই তৈরি করা হয় দীর্ঘমেয়াদি মাস্টার প্ল্যান। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৈরি করা এসব জরিপ রিপোর্ট কোনো কাজে আসছে না। এগুলো ফাইলবন্দি হয়ে পড়ে আছে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে। যে কারণে ২০২১ সালের টার্গেট বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তাদের বক্তব্য-এভাবে চলতে থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে বায়ুবিদ্যুৎ প্রকল্পের যে টার্গেট ধরা হয়েছে, সেটিও বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না।