Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

এলজিইডির প্রকৌশলী নিয়োগে দুর্নীতি

কেঁচো খুঁড়তে সাপ

সরকারি কোনো বিধিবিধানই মানা হয়নি, ভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনা করে ৫ জন নিয়োগ পেয়েছেন প্রকৌশলী পদে

নেসারুল হক খোকন

নেসারুল হক খোকন

প্রকাশ: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

কেঁচো খুঁড়তে সাপ

ছবি: সংগৃহীত

গত সরকারের সময় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তর ও নিয়োগে ভয়াবহ অনিয়ম-দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি। বিশেষ করে প্রাথমিকভাবে ২৫৭ সহকারী প্রকৌশলী নিয়োগে সরকারি কোনো বিধিবিধানই মানা হয়নি। এর মধ্যে কেউ কেউ প্রকল্পের চাকরি ছেড়ে বিদেশে চলে গেছেন। এরপরও তাদের রাজস্ব খাতে যোগ দেওয়ানো হয়েছে। ৫ জন ভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখাপড়া করেও এ সংস্থায় প্রকৌশলী পদে চাকরি পেয়েছেন। এমনকি রাজস্ব খাতে নিয়মিতকরণ ছাড়াই দেওয়া হয়েছে পদোন্নতি। নিয়োগ, জ্যেষ্ঠতা প্রদান ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে অর্থ বিভাগের অনুমোদন নেওয়া হয়নি। গোপনে ২য় দফায় ১৫০ জনকে ৫ম গ্রেডে পদোন্নতির প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এমন সব চাঞ্চল্যকর তথ্য উঠে এসেছে তদন্তে। আদালতের নির্দেশে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ৬ সদস্যের এই তদন্ত কমিটি গঠন করে।

হাইকোর্টের একটি আদেশে ৬ সদস্যের এই কমিটি করা হয়। ৩ মাসের মধ্যে প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে চাকরি স্থানান্তর বিধিবিধান মেনে হয়েছে কিনা তা জানতে চেয়েছেন এই আদালত। এলজিইডির প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে নিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ নথি তলব করেও পায়নি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তদন্ত কমিটির প্রধান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. বাবুল মিঞা যুগান্তরকে বলেন, হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা তদন্ত করছি। তদন্তের প্রয়োজনে যেসব নথিপত্র জরুরি মনে হয়েছে সেগুলো এলজিইডি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখায় চাওয়া হয়েছে। তবে এখনো চাহিদা অনুযায়ী নথিপত্র পাইনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অডিট বিভাগ আপত্তি দিয়েছে শুনেছি। আমরা সব নথিপত্র না পাওয়া পর্যন্ত মন্তব্য করতে পারব না।

সরকারের অডিট বিভাগ নিরীক্ষা মন্তব্যে উল্লেখ করেছে, ‘২৪০ জন সহকারী প্রকৌশলীকে প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে স্থানান্তরের কোনো প্রস্তাব অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা অনু বিভাগে পাঠানো হয়নি। এ ছাড়া ২৪০ জনের মধ্যে ১৮৩ জনের সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী (৬ষ্ঠ গ্রেড) পদে পদোন্নতির বিষয়ে ব্যয় ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ অবগত নয়। অর্থাৎ অর্থ বিভাগের অনুমোদন ছাড়াই ২০১৮ ও ২০১৯ সালে দুই দফায় সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী পদে তাদের পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে।’

অপর অডিট রিপোর্টে বলা হয়, ‘স্থানীয় সরকার অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর কার্যালয় কর্তৃক ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে পদসংশ্লিষ্ট নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে আত্তীকরণপূর্বক পদায়ন/নিয়মিতকরণ করায় বিধি লঙ্ঘন হয়েছে। এ সংক্রান্ত নথি পর্যালোচনায় দেখা যায়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ২০১১ সালের ২৫ আগস্ট উন্নয়ন প্রকল্পে নিয়োজিত ১০৯ জনকে এলজিইডির রাজস্ব খাত ভুক্ত শূন্য পদে সহকারী প্রকৌশলী (পুর)/ উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী পদে পদায়ন বা নিয়মিতকরণ করা হয়। ওই ১০৯ জন সহকারী প্রকৌশলীর মধ্যে ৫ জনের নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়মিতকরণ করা হয়েছে। এরা হলেন, কেএম রেজাউল করিম। তিনি শিক্ষায় মেকানিক্যালে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। অথচ তাকে পুরকৌশল স্নাতক ডিগ্রিধারী সহকারী প্রকৌশলী পদে শুধু নিয়োগই দেওয়া হয়নি ২০১৯ সালে ৬ষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতিও দেওয়া হয়েছে। শিখা ব্যানার্জি কৃষি বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার। তাকেও একই পদে রাজস্ব খাতে অন্তর্ভুক্ত করে ২০১৯ সালে ৬ষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার (যান্ত্রিক) আব্দুস সাত্তারকে সহকারী প্রকৌশলী করা হয়েছে। কৃষি বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার মো. আল আমিন সরকারকে সহকারী প্রকৌশলী করা হয়েছে। তাকেও পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। কৃষি বিষয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার মো. নুরুন্নবীও নির্ধারিত শিক্ষাগত যোগ্যতার বাইরে থেকে সহকারী প্রকৌশলী পদ পেয়েছেন।

এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কেএম রেজাউল করিম যুগান্তরকে বলেন, আমাদের চাকরির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র হাতে আছে। মন্ত্রণালয় তদন্ত করলে করুক। আমাদের কিছু যায় আসে না। এতে কোনো সমস্যাও নেই।

অডিট রিপোর্টের নিরীক্ষা মন্তব্যে বলা হয়েছে, ‘এসআরও নং ২৬৩-আইন/২০০৯ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (কর্মকর্তা ও কর্মচারী) নিয়োগ বিধিমালা ২০০৯ অনুযায়ী সহকারী প্রকৌশলী (পুর)/ উপজেলা সহকারী প্রকৌশলী পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়, ইনস্টিটিউট বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে পুরকৌশলে স্নাতক ডিগ্রি থাকতে হবে। তাছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২০২০ সালে ৩ মার্চ জারিকৃত স্মারকে প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে নিয়মিতকরণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিধিমালা অনুসরণ করতে হবে।’ এ বিষয়ে নিরীক্ষা সুপারিশে বলা হয়েছে. ‘উল্লিখিত নিয়োগ বিধিমালা লঙ্ঘনে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের বিরুদ্ধে দায়দায়িত্ব নির্ধারণপূর্বক প্রশাসিনক ব্যবস্থা গ্রহণ করে অডিট অফিসে প্রেরণ আবশ্যক।’

২৮ অক্টোবর পিএসসির মতামত ছাড়া তিন হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ, ‘এলজিইডির নিয়োগবিধি তছনছ, শিরোনামে দৈনিক যুগান্তরে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর একজন আইনজীবী স্বপ্রণোদিত হয়ে আলোচ্য বিষয়টির তদন্ত চেয়ে হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিট পিটিশনের ওপর শুনানি নিয়ে প্রকল্প থেকে রাজস্ব খাতে চাকরি স্থানান্তরের বিষয়ে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্ত করে আদালতে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশ দেওয়া হয়। এর পরই জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. বাবুল মিয়াকে সভাপতি ও একই মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পিকেএম এনামুল করিমকে সদস্য সচিব করে ৬ সদস্যের কমিটি করা হয়। কমিটির অপর সদ্যরা হলেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিধি-১ অধিশাখার যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ শামীম হোসেন, স্থানীয় সরকার বিভাগের যুগ্ম সচিব (আইন) মো. ওয়াহেদুর রহমান, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মো. রায়হান আখতার ও এলজিইডির অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শেখ মুস্তাফা জাহের। ২৭ জানুয়ারি এই তদন্ত কমিটি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে প্রথম বৈঠক করে। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এলজিইডি কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র তলব করে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব বরাবরে তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব একটি চিঠি দেন। এতে হাইকোর্টের রুলনিশি উল্লেখ করে, ‘প্রকল্পসমূহের জনবল রাজস্ব খাতে স্থানান্তরিত ২৫৫ জন সহকারী প্রকৌশলীর নিয়োগের ক্ষেত্রে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ও ব্যবস্থাপনা অনুবিভাগ, অর্থ বিভাগের সম্মতিপত্র এবং অর্থ বিভাগ কর্তৃক পৃষ্ঠাঙ্কনকৃত প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়ের জিও চাওয়া হয়েছে। এছাড়াও সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) মতামতের আলোকে নিয়মিতকরণের জিও এবং সমাপ্ত উন্নয়ন প্রকল্প থেকে রাজস্ব বাজেটে স্থানান্তরিত পদে পদধারীদের নিয়মিতকরণ ও জ্যেষ্ঠতা নির্ধারণের বিধিমালা বিশেষ এসআরও জারি হয়েছে কিনা? হয়ে থাকলে কপি দিতে বলা হয়েছে।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, ২০১০ সালের ৪ অক্টোবর তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী, ওয়াহিদুর রহমান মোট ১৩১ জনের চাকরির বিবরণী মন্ত্রণালয়ে পাঠান। ওই বিবরণীতে দেখা যায়, ১৩১ জনের মধ্যে ৩৭ জনই ওই সময় কর্মরত ছিলেন না। নথিপত্রে উল্লিখিত বিবরণীর ২৩নং সিরিয়ালে পাওয়া যায় হোসনে আরার নাম। তিনি বর্তমানে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে এলজিইডি সদর দপ্তরে কর্মরত। তার চাকরির বিবরণীতে দেখা যায়, তিনি ২০০৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নে মাটির কাজ প্রকল্পে কর্মরত ছিলেন। প্রকল্প শেষ হওয়ার পর পুনরায় নিয়োগ দেওয়ার জন্য আবেদন করা হলেও নিয়োগ পাননি। পরে ২০১০ সালে তাকে রাজস্ব বাজেটের পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। একই বিবরণীর ২৯নং সিরিয়ালের রতন কুমার ফৌজদারের ক্ষেত্রে দেখা যায়, তিনি ২০০৫ সালের জুন পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। বদলির জন্য চেষ্টা করার পরও বদলি না হওয়ায় চাকরি ছেড়ে দেন। কিন্তু পরে ২০১০ সালে তাকে রাজস্ব বাজেটের পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিবরণীর ৬৭নং সিরিয়ালে আছে মো. রফিকুর রহমান খানের নাম। নথিপত্রে দেখা যায়, প্রকল্প শেষ হওয়ার পর ২০০৬ সালের ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত কর্মরত ছিলেন। পুনরায় ২৪/০৫/২০০৭ তারিখে নিয়োগ দেওয়ার পর যোগদান করেননি। কিন্তু পরবর্তীতে ২০১০ সালে তাকে রাজস্ব বাজেটের পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিবরণীর ৬৯নং সিরিয়ালে আছে মো. সাহাবুল আলমের নাম। তিনি বর্তমানে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে এলজিইডিতে কর্মরত। তার ক্ষেত্রে দেখা যায়, তিনি আরডিপি-২৬ নারায়ণগঞ্জে কর্মরত থাকা অবস্থায় অস্থায়ী চাকরির প্রয়োজনীয়তা না থাকায় তাকে ২০০৮ সালের ২০ মার্চ অব্যাহতি দেওয়া হয়। কিন্তু পরে ২০১০ সালে তাকে রাজস্ব বাজেটের পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই ৪২ জনের মধ্যে অনেকেই চাকরির জন্য দেশের বাইরে, কেউ আবার পড়ালেখা করতে বিদেশে চলে যান। আবার কেউ বিদেশে থেকেও রাজস্ব খাতের চাকরি পেয়েছেন। এদের মধ্যে ২০১১ সালের ২৫ আগস্ট প্রজ্ঞাপনের ৫৬নং সিরিয়ালে থাকা পারভেজ সরোয়ার হোসেন বর্তমানে সিনিয়র সহকারী প্রকৌশলী হিসাবে বান্দরবনে কর্মরত আছেন। তিনি ২০০৮ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত নেদারল্যান্ডসে মাস্টার্স ডিগ্রিতে অধ্যয়নরত ছিলেন। পরে রাজস্ব খাতের চাকরি হলে দেশে এসে যোগদান করেন। যা এলজিইডির ইতিহাসে নজিরবিহীন।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম