জাতিসংঘের অনুসন্ধান
নিরাপত্তা বাহিনী ও বিচার বিভাগ দলীয় রূপ নেয়

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পনেরো বছরের শাসন আমলে দেশের নিরাপত্তা বাহিনী (সামরিক-বেসামরিক) ও বিচার বিভাগকে দলীয় প্রতিষ্ঠানে রূপ দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। এর মধ্যে আছে-প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনএসআই, পুলিশের বিভিন্ন সংস্থা এবং বিশেষ বাহিনী র্যাব অন্যতম। এ সময়ে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে রাজনীতির সঙ্গে মিশে গেছে। বিভিন্ন বাহিনী এবং গোয়েন্দা সংস্থার উচ্চপদে নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে পেশাগত যোগ্যতা বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা বিবেচনায় দেওয়া হতো এসব নিয়োগ। এমনকি তাদের আত্মীয়স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয় চেক করা হতো। উচ্চ ও মধ্যম স্তরের নিয়োগ সাবেক প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) নিজেই অনুমোদন দিতেন। নিয়োগ পাওয়ার পর এসব কর্মকর্তা শাসক দলের অপরাধে সহায়তা করতেন। বিনিময়ে নিজেদের অপরাধ এবং দুর্নীতির দায়মুক্তি পেতেন। বেশ কিছু ক্ষেত্রে আইন করে সরকারি কর্মকর্তাদের সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের (ওএইচসিএইচআর) ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে এ তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি বলছে, ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৩২ অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। এছাড়া ওই কর্মকর্তা সৎ-ভাবনা থেকে কাজ করেছেন এমন বিবেচনায় অপরাধ আইনে দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়। এ ধরনের আইন অপরাধীদের সুরক্ষা দেয়। অন্যদিকে পুলিশকে নিজেদের অপরাধ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। বিচার ব্যবস্থায়ও দুর্নীতি ও রাজনৈতিক চাপ ছিল ব্যাপক। বিশেষ করে বিচারকদের নিয়োগ ও পদোন্নতি দিত আইন মন্ত্রণালয়। বুধবার জেনেভা কার্যালয় থেকে এই রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে একক একটি রাজনৈতিক দলের ১৫ বছরের শাসন। এ সময় রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে রাজনীতির সঙ্গে মিলেছে। এতে দেশের নিরাপত্তা খাত ও বিচার বিভাগ ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছে। অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে পেশাদারিত্ব, সততা ও যোগ্যতার ভিত্তিতে নয়, আওয়ামী লীগ কিংবা এর সমর্থিত ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য বা সম্পৃক্ততা বিবেচনায় নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতিতেও একই বিবেচনা। সরকারি শীর্ষ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই, জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এবং পুলিশের বিশেষ শাখার উচ্চ থেকে মধ্যস্তর পর্যন্ত দলীয় সম্পৃক্ততায় নিয়োগ হয়েছে। এই পদগুলোর প্রতিটি নিয়োগে প্রার্থী এবং তাদের আত্মীয়স্বজনের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা যাচাই করা হয়। প্রধানমন্ত্রী (শেখ হাসিনা) ব্যক্তিগতভাবে ডিআইজি (ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল) বা তার চেয়ে উচ্চতর পদে নিয়োগ অনুমোদন দিতেন। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটগুলোতে নিয়োগ দেওয়া হয়। তবে অনেকে বলেছেন, পুলিশ নিয়োগে রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আগের সরকারেও ছিল।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও রাজনীতিতে জড়িত থাকার ইতিহাস রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে প্রকাশ পেয়েছে। তবে অন্যান্য নিরাপত্তা বাহিনীর তুলনায় সেনাবাহিনীর রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা কম। সেনাবাহিনীর ভেতরের কর্মকর্তারা জাতিসংঘের তদন্ত দলকে জানিয়েছেন, তাদের (সেনাবাহিনী) ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দীর্ঘদিন ধরে দলীয় রাজনীতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে এসেছেন। রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তিতে তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ঢাকা এবং গুরুত্বপূর্ণ সেনানিবাসের বিভিন্ন পদে নিয়োগ করা হয়েছে। যারা অবিশ্বস্ত হিসাবে বিবেচিত হয়েছেন, আটকে দেওয়া হয়েছে তাদের পদোন্নতি। বদলি করা হয়েছে দূরবর্তী স্থানে। কিছু ক্ষেত্রে জোরপূর্বক সেনাবাহিনী ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এভাবে সেনাবাহিনী, আধা-সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অপব্যবহারকে সহজ করেছে আওয়ামী লীগ। এসব সংস্থার শীর্ষ কর্মকর্তারা সরাসরি প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অধীনে কাজ করতেন।
প্রাতিষ্ঠানিক দায়মুক্তি ও রাজনৈতিক অনুগত বিচার ব্যবস্থা : নিরাপত্তা খাতের একটি নেতিবাচক সহাবস্থান তৈরি করেছিল আওয়ামী লীগ। পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনী শাসক দলের অপরাধ দমন করেনি। এমনকি কোনো হস্তক্ষেপ করেনি। এর বিনিময়ে পুলিশ এবং অন্যান্য সংস্থার সদস্যরা নিজেদের গুরুতর অপরাধ ও দুর্নীতির জন্য দায়মুক্তি পেয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দেশের নাগরিক সংগঠনগুলোর তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ২৫৯৭টি বিচারবহির্ভূত হত্যা হয়েছে। গুমের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে ৭০৮টি। এর মধ্যে শুধু র্যাবই ৮ শতাধিক হত্যাকাণ্ড এবং ২২০টি গুমের ঘটনায় জড়িত। এরপরও র্যাব কর্মকর্তাদের শুধু একটি হত্যা মামলায় দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগীদের একজন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী স্থানীয় নেতা। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আলোচ্য সময়ে, ডিজিএফআই কর্মকর্তারা ১৭০টিরও বেশি গুমের ঘটনায় জড়িত ছিলেন। কিন্তু এখনো পর্যন্ত ডিজিএফআইর একজন কর্মকর্তারও বিচার হয়নি। প্রতিবেদনে বলা হয়, নাগরিকদের নির্যাতনের মাধ্যমে বিভিন্ন ঘটনার স্বীকারোক্তি এবং তাদের কাছ থেকে ঘুস আদায় করা হতো। জাতিসংঘের নির্যাতনবিরোধী কমিটিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এ ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে। সরকার ২০১৩ সালে নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিষিদ্ধকরণ) আইন পাশ করে। কিন্তু এরপরও কমপক্ষে ১০৩ জন বন্দি নির্যাতনে নিহত হয়েছেন। এ আইনের অধীনে সরকার মাত্র ২৪টি মামলা নথিভুক্ত করেছে। এর মধ্যে শুধু একটি মামলায় হেফাজতে নির্যাতন করে হত্যার জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের দায়ী করা হয়েছে। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দায়মুক্তির এই প্রবণতা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে। আইনের মাধ্যমে এর সুরক্ষা দেওয়া হয়। যেমন, ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা ১৩২ অনুযায়ী, সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে হলে সরকারের অনুমোদন প্রয়োজন। আবার ওই আইনে বলা আছে, তারা সৎ ভাবনা থেকে অপরাধ করলে, তবে দায়মুক্তি পাবে। এসব বিধান অপরাধীদের পক্ষে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সহজ করে তোলে। এছাড়াও পুলিশকে নিজেদের অপরাধ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এর ফলে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ একই অঞ্চলের পুলিশ কর্মকর্তাদের মাধ্যমেই তদন্ত করা হয়। ২০০৯ সালে পুলিশের অভ্যন্তরীণ নজরদারি ইউনিট গঠন করা হয়। কিন্তু এটি শুধু নিুপদস্থ কর্মকর্তাদের সামান্য অসদাচরণ বিষয়ে কাজ করতে পারে। এরপরও এটি শৃঙ্খলাবদ্ধ কাঠামো থেকে স্বাধীন নয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে স্বাধীন ও পেশাদারভাবে পুলিশের বা অন্য অপরাধ তদন্ত করতে পারে, এরকম কোনো অভিযোগ তদন্ত (প্রসিকিউশন) পরিষেবা নেই। নির্দিষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ মানদণ্ড ছাড়াই আইনজীবীদের এডহক ভিত্তিতে আদালতে পুলিশের প্রস্তুত করা মামলা উপস্থাপনের জন্য নিয়োগ দেওয়া হয়। এসব প্রসিকিউটরের মাধ্যমে মামলার বিচারিক প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়।
বিচার ব্যবস্থা : পুরো বিচার ব্যবস্থা অর্থায়নের অভাবে ভুগছে। বর্তমানে আদালতে ৪২ লাখ মামলা চলমান। এর মধ্যে ফৌজদারি মামলা ২৪ লাখ। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিচার ব্যবস্থার স্বাধীনতা ক্ষয় হয়েছে। এটি ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক প্রভাবিত। একদিকে দুর্নীতিগ্রস্ত অপরদিকে রাজনৈতিক চাপ ও ভয়ভীতির শিকার। বিচারকদের বদলি ও পদোন্নতি দেয় আইন মন্ত্রণালয়। এ ধরনের কাজ বিচারকদের ওপর সরকারের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব তৈরি হয়। কারণ এই প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও নির্দিষ্ট মানদণ্ডের অভাব রয়েছে। ২০১৬ সালে, সংসদ একটি সাংবিধানিক সংশোধনী পাশ করে। এর মূল কথা হলো-বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সরাসরি সরকারের হাতে থাকবে। তবে ২০২৪ সালের ২০ অক্টোবর ওই রায় বাতিল করেন সর্বোচ্চ আদালত।
অন্যান্য নজরদারি সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। স্বাধীনতার অভাব, ক্ষমতাহীনতা ও রাজনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে। বিশেষ করে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন জাতিসংঘের প্যারিস নীতিমালার মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। পূর্ববর্তী সরকার (আওয়ামী লীগ) কমিশনের সদস্যদের স্বাধীনতা ছাড়াই নিয়োগ দিয়েছিল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অপরাধ করলে তা এই সংস্থাকে তদন্তের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, অপরাধীরা দায়মুক্তি পাওয়া মানে হলো গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন। অপরদিকে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচার ও প্রতিকার পাওয়া থেকে বঞ্চিত। এতে অপরাধ পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা তৈরি হয়। সামগ্রিকভাবে এ ধরনের কাজে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক অবিশ্বাসকে আরও গভীর করে। সৃষ্টি করে ধ্বংসাত্মক রাজনৈতিক পরিস্থিতির। একই সঙ্গে সামাজিক সংহতি দুর্বল হয়।