Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি বঞ্চিতদের

এসএসবি ছাড়া ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রশ্নবিদ্ধ!

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

এসএসবি ছাড়া ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি প্রশ্নবিদ্ধ!

শেখ হাসিনার শাসনামলে বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত ৭৬৪ কর্মকর্তাকে সম্প্রতি ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি দিয়েছে সরকার। সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ডের (এসএসবি) সুপারিশ ছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের এসব কর্মকর্তাকে চার স্তরে পদোন্নতি দেওয়ার বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে-এমন মন্তব্য করেছেন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিবঞ্চিত কর্মকর্তারা। তাদের মতে, এসএসবির সুপারিশ ছাড়া উপসচিব, যুগ্মসচিব, অতিরিক্ত সচিব এবং সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়ার বিধান কোথাও নেই। পদোন্নতি বিধি অনুযায়ী সরকারের এসব পদে পদোন্নতি দিতে এসএসবির সুপারিশ বাধ্যতামূলক। 

তাদের আরও অভিমত-অন্য ক্যাডার থেকে প্রশাসনে যারা নির্ধারিত কোটায় ঢুকেছেন, তাদের কাউকে পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। এমনকি ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মামলার আসমি হওয়া সত্ত্বেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার পদোন্নতি হয়েছে। এমনকি ফ্যাসিবাদ হাসিনা সরকারের মন্ত্রী রাশেদ খান মেননের পিএস (একান্ত সচিব)-এরও পদোন্নতি হয়েছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বঞ্চিতদের অনেকেই বিধি মোতাবেক পদোন্নতি পেতে উচ্চ আদালতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। 

যদিও এসএসবির সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি-প্রয়োজনীয় সব যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বিগত সরকারের আমলে বিভিন্ন স্তরের বিপুলসংখ্যক কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। এরই মধ্যে তারা অবসরে চলে গেছেন। বঞ্চনার শিকার এসব কর্মকর্তার বিষয়টি পর্যালোচনা করার জন্য বর্তমান সরকার উচ্চপর্যায়ের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে। ওই কমিটির সুপারিশের আলোকেই তাদের পদোন্নতি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে এসএসবির সুপারিশের প্রয়োজন নেই। কারণ, এসএসবি শুধু কর্মরত কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিষয়ে সুপারিশ করে থাকে। অবসরপ্রাপ্তদের জন্য প্রয়োজন নেই। 

এদিকে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আরও প্রশ্ন-সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে এক লাফে এক আদেশে সচিব পদে পদোন্নতির বিধান কোথায় আছে? পর্যালোচনা কমিটির সদস্য ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমান নিজেই তার পদোন্নতির জন্য সুপারিশ করেছেন-এটা কি বিধিসম্মত? এছাড়া বঞ্চিত অবসরপ্রাপ্ত অন্য ক্যাডারের একাধিক সংগঠন ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি বাতিলের দাবি জানিয়েছে। প্রশ্নবিদ্ধ এ ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিতে শুধু প্রশাসন ক্যাডারের ৭৬৩ জন কর্মকর্তা পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. ওবায়দুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, বঞ্চিতরা রিভিউর জন্য আবেদন করতে পারেন এবং ইতোমধ্যে বেশকিছু আবেদন জমা দিয়েছেন। ইচ্ছা করে কাউকে বঞ্চিত করা হয়নি। ভুলক্রমে হয়তো কারও নাম বাদ যেতে পারে এবং সরকার সে বিষয়গুলো দেখবে। তিনি আরও বলেন, সংক্ষুব্ধ কেউ উচ্চ আদালতে যেতে চাইলে যেতে পারেন। এক প্রশ্নের জবাবে এপিডি বলেন, আগামী সপ্তাহে জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির সুপারিশ সংবলিত রিপোর্ট সবার জন্য উম্মুক্ত করে দেওয়া হবে। তখন সবাই জানতে পারবেন কে, কেন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (বিসিএস) ১৯৮৪ ব্যাচের কর্মকর্তা আবুল কাশেম তালুকদার (৩৬৪৬) গত ৯ ফেব্রুয়ারি যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব হিসাবে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি পেয়েছেন। তার বিরুদ্ধে দুদকে একটি মামলা চলমান। তিনি চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা প্রার্থী ঘোষণা করেননি। পরে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন এবং জাল মুক্তিযোদ্ধা সনদ সংগ্রহ করেন। এ সংক্রান্ত মামলা চলমান থাকা অবস্থায় তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শৃঙ্খলা অনুবিভাগের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যাচাই বাছাই করে ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিযোগ্যদের তথ্য জাকির আহমেদ খানের কমিটিকে দেওয়া হয়েছে। ভুলে কিছু হতে পারে, তবে ইচ্ছা করে কিছু হয়নি।

আরও জানা যায়, সাবেক সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের পিএস এটিএম নাসির উদ্দিনকে অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এসময় তার পদোন্নতি পাওয়া নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলছেন। 

বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারের দশম ব্যাচের কর্মকর্তা সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. মাহবুব কবির মিলন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, একজন কর্মকর্তা অতিরিক্ত সচিব পর্যন্ত পদোন্নতি পেয়ে অবসরে গেলে তাকে কেন সচিব করা হলো না, সে বিষয়ে তিনি সরকারকে প্রশ্ন করতে পারবেন না। জনপ্রশাসনে এটি একটি সাধারণ নিয়ম। কারণ, সবাইকে সচিব করতে হবে-সেরকম বিধান বা সুযোগ কোনোটাই নেই। প্রশ্ন করতে পারবেন তারা, যারা বারবার পদোন্নতিবঞ্চিত হয়েছেন বা ওএসডি ছিলেন। মাহবুব কবিরের প্রশ্ন-ভূতাপেক্ষ পদোন্নতির মাধ্যমে সচিব হওয়া ১১৯ জনের মধ্যে ৫১ জন অফিসার অতিরিক্ত সচিব পদে নিয়মিত পদোন্নতি পেয়ে অবসরে গেছেন, তারা কী করে সচিব হলেন? তিনি আরও বলেন, বিসিএস ১৯৮২ ব্যাচ (নিয়মিত ও বিশেষ) থেকে ৫০ জনকে ভূতাপেক্ষভাবে সচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানও রয়েছেন। মাহবুব কবির আরও বলেন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তো কখনো পদোন্নতিবঞ্চিত হননি। তাহলে তিনি কী করে সচিব পদে পদোন্নতি পেলেন। মাহবুব কবির আরও বলেন, জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটিকে কি এসএসবির সভা করার এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে? এসএসবির সভাপতি ও অন্য সদস্যদের অংশগ্রহণ ছাড়া কীভাবে সভা হলো এবং পদোন্নতির সুপারিশ করা হলো। এভাবে যদি প্রশাসনের সুনাম ও ঐতিহ্য বিনষ্ট করা হয়, তাহলে গণমানুষের কাছে প্রশাসন সম্পর্কে ভুল বার্তা যাবে। তিনি আরও বলেন, এ বিষয়ে প্রতিকারের জন্য তিনিসহ বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা শিগ্গিরই উচ্চ আদালতে যাবেন এবং জাকির আহমেদ খানের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির দেওয়া পদোন্নতি চ্যালেঞ্জ করবেন। 

এদিকে বিসিএস পরিবার কল্যাণ, বিসিএস পরিসংখ্যান, বিসিএস কৃষিসহ একাধিক সংগঠন ভূতাপেক্ষ পদোন্নতি বাতিলের দাবি জানিয়ে বলেছে, উপসচিব বা তদূর্ধ্ব পদগুলোয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে আদার্স ক্যাডারের কর্মকর্তাদের থেকে নেওয়ার বিধান উপেক্ষিত হয়েছে। তাই এ পদোন্নতি কোনোভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। 

প্রসঙ্গত, ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৪ আগস্ট পর্যন্ত নানাভাবে হয়রানি ও পদোন্নতিবঞ্চিত হয়ে অবসরে যাওয়া কর্মকর্তাদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধা ও ক্ষতি পুষিয়ে দিতে গত বছর ১৬ সেপ্টেম্বর পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে কমিটির সভাপতি এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. মো. মোখলেস উর রহমানকে কমিটির সদস্য সচিব করা হয়। এক মাস সময় বেঁধে দিয়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হয়। পরে আরও তিনদিন সময় বাড়িয়ে আবেদন গ্রহণ করা হয়। 

কমিটিকে ৯০ দিন সময় দিয়ে একসঙ্গে অথবা কেস টু কেস আবেদনগুলো পর্যালোচনা সময় বেঁধে দেওয়া হয়। কমিটির বিবেচনার জন্য সর্বমোট ১৫৪০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে পাঁচ স্তরে ৭৬৪ জনকে রোববার চার স্তরে অর্থাৎ সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্মসচিব এবং উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম