সংস্কার নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মত
আলোচনার টেবিলেই সমাধানের পথ

যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনার টেবিলে সমাধান খুঁজবে রাজনৈতিক দলগুলো। এর আগে তারা নিজ নিজ দলীয় ফোরামে এসব সুপারিশ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা করবে। কমিশনের কোন কোন সুপারিশ এখনই বাস্তবায়নযোগ্য, তা তুলে ধরবে রাজনৈতিক দলগুলো। পাশাপাশি যে বিষয়গুলো নির্বাচিত সরকার করবে, সেগুলোয়ও সুস্পষ্ট মতামত দেবেন নেতারা। বিশেষ করে সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাত দিতে নেতারা আরও চিন্তাভাবনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলছেন। বিষয়টি তারা নির্বাচিত সরকারের হাতেই ছেড়ে দেওয়ার কথা বলেছেন।
শনিবার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব কথা বলেন। তারা বলেন, কমিশনের প্রস্তাবগুলোই চূড়ান্ত নয়। দেখার বিষয়-এসব থেকে কোন কোন প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য সরকার গ্রহণ করে। কেউ বলেছেন, বেশকিছু প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য। অনেকেই বলেছেন-রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কারের সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। প্রায় সবাই সংবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নির্বাচিত সরকারের ওপর ছেড়ে দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছেন। চলতি মাসের মাঝামাঝি সংস্কার প্রতিবেদনগুলো নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরুর সম্ভাবনা আছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ সংলাপের মাধ্যমেই আগামী নির্বাচনের পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হচ্ছে।
সংস্কারের সুপারিশ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন রোববার যুগান্তরকে বলেন, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো আমরা (বিএনপি) আনুষ্ঠানিকভাবে পাওয়ার পর আলোচনা করবো। এছাড়া সরকারও বিষয়গুলো নিয়ে ষ্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে কথা বলবে। তিনি বলেন আমরা প্রস্তাবগুলো দলের নীতিনির্ধারণী ফোরামে আলোচনার পর বিস্তারিত জানাবো।
বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে বলেন, এখন তো কেবল সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলো এসেছে, এটাই চূড়ান্ত নয়। প্রস্তাবগুলো থেকে সরকার কোনটা বাস্তবায়ন করবে, কোনটা গ্রহণ করছে, এটা নিয়ে রাজনৈতিক দল ও স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে সরকার মতবিনিময় করবে। এ ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে আরও যোগ-বিয়োগ হবে, তখন কথা বলব। এটার অর্থ এ নয় যে এটি সরকার গ্রহণ করে নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, প্রস্তাব তো আসতেই পারে। একেকটা কমিশন একেকটা প্রস্তাব দিয়েছে। ওই কমিশনের সদস্য যারা, তারা যেটাকে ভালো মনে করেছেন বা অধিকাংশ কমিশন সদস্য যে মত দিয়েছেন, সেটিকে তারা প্রস্তাব আকারে দিয়েছেন। এখন কোনটা সরকার গ্রহণ করে, এটা বোঝা যাচ্ছে না। গ্রহণ করলে তারা রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত চাইবে।
শনিবার ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো থেকে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কারগুলো পৃথক করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন করা যায়-এমন স্বল্পমেয়াদি সুপারিশ এবং যেগুলোর বিষয়ে ঐকমত্য প্রয়োজন, সেগুলো চিহ্নিত করা হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে এসব বিষয়ে ঐকমত্য স্থাপনে জোর দেওয়া হবে। এরপর নির্বাচিত সরকার দীর্ঘমেয়াদি যেসব সংস্কার করবে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা হবে। পাশাপাশি চলতে থাকবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে গণহত্যার বিচারিক কার্যক্রমসহ এ সরকারের অন্যান্য কর্মকাণ্ড।
ছয় কমিশনের একটি সংবিধান সংস্কার কমিশন। বিদ্যমান ‘প্রজাতন্ত্র’ ও ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দের পরিবর্তন এনে ‘নাগরিকতন্ত্র’ ও ‘জনগণতন্ত্রী বাংলাদেশ’ শব্দ প্রতিস্থাপনের সুপারিশ করেছে এ কমিশন। এছাড়াও রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, সংসদের মেয়াদ চার বছর করা, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ, মোট আসন ৫০৫, এর মধ্যে নারী আসন ১০০, নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ন্যূনতম বয়স ২১, সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে সংশোধন এবং দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়-এমন উল্লেখযোগ্য সুপারিশ করেছে তারা।
এর বাইরে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করেছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ হবে চার মাস, ‘না’ ভোটের প্রচলন, গণভোট, ব্যালটের পাশাপাশি অনলাইন ভোটিং সিস্টেমের প্রস্তাব দিয়েছে তারা। দ্বিকক্ষবিশিষ্ট জাতীয় সংসদে ৫০০ আসন করার সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনও। এছাড়া জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষের সংসদ-সদস্য এবং সব স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বিধান এবং নির্দলীয় ব্যক্তিকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করার সুপারিশও রয়েছে। এছাড়া দুর্নীতি দমন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন এবং জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ দিয়েছে।
রাজনৈতিক দলগুলো বলছে, এ কমিশনের অনেক সুপারিশই গ্রহণযোগ্য। তবে সংবিধানে হাত দেওয়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজটি আরও চিন্তাভাবনার পাশাপাশি জাতীয় ঐকমত্যের আলোকে হতে হবে। বিষয়টি তারা নির্বাচিত সরকারের হাতে ছাড়ার কথাও বলছেন। জানতে চাইলে এ প্রসঙ্গে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না রোববার যুগান্তরকে বলেন, রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা, দুই মেয়াদের বেশি প্রধানমন্ত্রী নয়, সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি নির্বাচন, না ভোটের বিধান, তরুণদের মধ্য থেকে দশভাগ নির্বাচনে মনোনয়ন দেওয়া-এসব গ্রহণযোগ্য সুপারিশ। আমরা তা চাই। তবে এর জন্য সংবিধান সংশোধন প্রয়োজন হবে, যা নির্বাচিত সরকারের হাতেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। তিনি বলেন, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের বিষয়টি স্পস্ট না। উচ্চকক্ষ কীভাবে হবে, তাও পরিষ্কার না। এসব সিদ্ধান্ত নিতে গেলে বৃহত্তর জাতীয় ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হবে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, অধিকাংশ সংস্কার প্রস্তাবকে আমি ইতিবাচক হিসাবেই দেখি। প্রধানমন্ত্রী এবং দলীয় প্রধান একজন ব্যক্তি না হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। দুবার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর তিনি আবার রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন কি না-এগুলো মনে করি, আরও চিন্তাভাবনার বিষয় আছে। সংখ্যানুপাতিক ভোট তো আমাদের পুরোনো অবস্থান। আমরা মনে করি, সংসদকে প্রতিনিধিত্বমূলক করার ক্ষেত্রে বহুচিন্তা, বহুমত প্রয়োজন। এটা সংখ্যানুপাতিক হলে গণতান্ত্রিক হয়, ভালো হয়। তবে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক করা যাবে কি না, সেটা অনেকগুলো ফ্যাক্টরের ওপর নির্ভর করছে। নিম্নকক্ষ পার্লামেন্টের প্রচলিত পদ্ধতিতে হতে পারে, আর দলগুলোর প্রাপ্ত ভোটের সংখ্যানুপাতিক হারে উচ্চকক্ষ পার্লামেন্টের প্রতিনিধিত্ব হতে পারে। এটা আমরা মনে করি। তরুণদের জন্য ১০ ভাগ প্রতিনিধিত্ব রাখাকে আমরা অযৌক্তিক মনে করি। সংসদের মেয়াদ মনে হয় ৫ বছর থেকে কমিয়ে ৪ বছর করার একটা প্রস্তাবনা আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে এটাকে ইতিবাচক মনে করি। তবে প্রস্তুাব যেগুলোই আসুক না কেন, তা ঐকমত্যের ভিত্তিতে করা উচিত। যেসব বিষয়ে আমরা সবাই একমত হব, সেসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি।
এ প্রসঙ্গে গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে আমরা বরাবরই সমর্থন দিয়েছি। সংস্কার কমিশনের কিছু কিছু প্রস্তাব আছে, যেগুলো বাস্তবে অনেক জটিলতা তৈরি করবে। এ প্রস্তাবনাগুলো যদি বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে অন্যদের মধ্যেও একটা নেগেটিভ প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারে। সেক্ষেত্রে যা-ই বাস্তবায়ন করা হয়, সেটুকু রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতে করতে হবে। যেমন: প্রস্তাবনায় ১০ শতাংশ তরুণ প্রতিনিধিদের কথা বলা হয়েছে। আসলে রাজনৈতিক দলের একটা মনোনয়ন বোর্ড থাকে, সেখানে সিদ্ধান্ত নেবে আসলে কাদের মনোনয়ন দেবে। এখন তরুণের সীমাবদ্ধতা কী? কত বয়সের তরুণদের দিবে, এটা সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করতে পারে না। একটা রাজনৈতিক দলের ওপর চাপিয়ে দিতে পারে না। সংসদ নির্বাচনের জন্য ২১ বছরের যে বিধানের সুযোগ থাকা উচিত, কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে খুব কম পাওয়া যাবে। আমার মনে হয়, এ সময়ে পট পরিবর্তনের মাধ্যমে তারা যে ভূমিকা রেখেছে, সেক্ষেত্রে তাদের জন্য এই বিধানটা রাখা যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, একই ব্যক্তি একই সঙ্গে দলীয় প্রধান এবং সরকারপ্রধান না থাকা, দুইবারের বেশি প্রধানমন্ত্রী না থাকা-এমন সিদ্ধান্তকে পজিটিভ মনে করি। একটা গণতান্ত্রিক সংস্কার চাই। আমরা ভালো একটা সুযোগ পেয়েছি। এটাকে কাজে লাগিয়ে পরিবর্তনগুলো যদি করতে না পারি, তাহলে আগামী দিনে আর সম্ভব হবে না।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় জানিয়েছে, এরই মধ্যে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রধানের সঙ্গে বৈঠক করে সংস্কার কার্যক্রম সম্পর্কে ধারণা নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় কমিশনের রিপোর্ট দুইভাগে ভাগ করা হবে। একটি ভাগে আশু সংস্কার, যেগুলো দ্রুত করে ফেলা সম্ভব, সেগুলো থাকবে। অন্য ভাগে কাঠামোগত সংস্কার, যেগুলোর জন্য প্রক্রিয়াগত জটিলতা রয়েছে, সেগুলো থাকবে। যে সংস্কারগুলো সরকার সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করতে পারবে, সেগুলো রাজনৈতিক দলগুলোকে অবহিত করে সংস্কার করা হবে। যে সংস্কারগুলো ব্যাপক, সেগুলোর জন্য জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দল এবং অন্য অংশীদারদের সঙ্গে বৈঠক শুরু হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সমঝোতা সাপেক্ষে এ মাসের মাঝামাঝিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। সেদিন থেকেই জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কাজ শুরু করবে।
এদিকে ছয় সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন প্রকাশের দিন গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছেন, ছয়টি কমিশন তাদের প্রতিবেদন বাস্তবায়নে তিনটি টাইম ফ্রেমে সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছে-আশু করণীয়, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মৌলিক সংস্কারগুলো করার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা নির্বাচন প্রক্রিয়ায় চলে যেতে চাই। তিনি আরও বলেন, অযথা সময়ক্ষেপণ করে ক্ষমতায় থাকার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা বর্তমান সরকারের নেই। চলতি মাসের মাঝামাঝি সংস্কার প্রতিবেদনগুলো নিয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করব। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এ সংলাপের মাধ্যমেই আগামী নির্বাচনের পথে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হচ্ছে।