Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

জনপ্রশাসন সংস্কার : বিশেষজ্ঞ অভিমত

বাস্তবায়নযোগ্য নয় অধিকাংশ সুপারিশ

জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের খবরদারি বন্ধ হলেই সব সমাধান পাওয়া যাবে -আবু আলম মো. শহীদ খান

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাস্তবায়নযোগ্য নয় অধিকাংশ সুপারিশ

জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের দেওয়া দুই শতাধিক সুপারিশের অধিকাংশই বাস্তবায়নযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, পরীক্ষার মাধ্যমে প্রশাসন ও অন্য ক্যাডার বা প্রস্তাবিত সার্ভিসের কর্মকর্তাদের ৫০:৫০ পদোন্নতি, এটা আদালতের রায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করে প্রাদেশিক সিস্টেমে গেলে স্বাধীনতা আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে এটা হবেই। এছাড়া প্রাদেশিক সিস্টেম চালু করতে কয়েক লাখ কোটি টাকার দরকার। সেই সামর্থ্য কি রাষ্ট্রের আছে। শুধু তাই নয়, প্রদেশ বা সিটি গভর্নমেন্ট করলে মাথাভারী প্রশাসন এবং সরকারের কলেবর বেড়ে যাবে। কাজের কাজ কিছুই হবে না।

বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত-স্বাধীন জনপ্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ এবং সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর সরকারের খবরদারি শূন্যের কোঠায় নিয়ে এলেই অধিকাংশ সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। আর ক্যাডারগুলো ভেঙে ছোট করা হলে জনপ্রশাসনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা থাকবে। এছাড়া পরীক্ষার মাধ্যমে পদোন্নতি পদ্ধতি বাস্তবায়ন হলে সবাই পরীক্ষার পেছনে পড়ে থাকবে, এতে জনসেবা মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। শুধু তাই নয়, সব সুবিধাসহ ১৫ বছর চাকরি করার পর অবসরের সুবিধা রাখার বিরোধিতা করেন তারা।

বুধবার জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন দুই শতাধিক সুপারিশ সংবলিত প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়। এ সুপারিশমালার ওপর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনজন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ যুগান্তরের কাছে প্রায় অভিন্ন সুরে উল্লিখিত মন্তব্য করেন। তার হলেন সিনিয়র সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান, সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক এবং সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া।

আবু আলম মো. শহীদ খান যুগান্তরকে বলেন, স্বাধীন জনপ্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা হলেই অধিকাংশ সমস্যার সমাধান পাওয়া যাবে। এ তিনটি বিভাগের ওপর সরকারের খবরদারি শূন্যের কোঠায় নিয়ে আসতে হবে। এর বাইরে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকেও সরকারের প্রভাবমুক্ত করতে হবে। এ চারটি ক্ষেত্রে সংস্কার জরুরি। তিনি আরও বলেন, আমরা একটি উপজেলা পরিচালনা করতে গিয়ে গলদঘর্ম। অথচ দেশকে চারটি প্রদেশে ভাগ করার সুপারিশ করেছে কমিশন। প্রদেশ করলে স্বাধীনতা আন্দোলন মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। বিশেষ করে পাহাড়ি অঞ্চলে স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সুতরাং, এ পথেই হাঁটা বিপজ্জনক। দ্বিতীয় বিষয় হচ্ছে, চারটি প্রাদেশিক সরকার, একটি সিটি গভর্নমেন্ট এবং কেন্দ্রীয় সরকার-এ ছয়টি সরকার পরিচালনার মতো আর্থিক সামর্থ্য কি রাষ্ট্রের আছে। প্রাদেশিক সরকারের সংসদ ভবন, গভর্নর হাউজ, প্রদেশিক সরকারের বিভিন্ন দপ্তর-সংস্থার জন্য অবকাঠামো এবং জনবল নিয়োগে কয়েক লাখ কোটি টাকা লাগবে। সেই টাকার উৎস কী? যেখানে একটি উপজেলা পরিষদ ঠিক মতো পরিচালনা করতে হিমশিম খেতে হয়, সেখানে প্রদেশ প্রতিষ্ঠার চিন্তা আসে কোথা থেকে। প্রদেশ করতে গেলে নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

তিনি আরও বলেন, সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিসে ঢুকতে (এসইএস) উপসচিব পদে প্রশাসন ৫০ এবং অন্য ক্যাডার ৫০ পদোন্নতির সুপারিশ বাস্তবায়ন অযোগ্য। কারণ, এ বিষয়ে আদালতের রায় ও পর্যবেক্ষণ রয়েছে। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, পাকিস্তান ও ইন্ডিয়ায় প্রশাসন ক্যাডার রয়েছে। সেখানে পদোন্নতি কি পরীক্ষা দিয়ে হয়। যে কর্মকর্তা যে ক্যাডারে ঢুকেছেন, তিনি সেই ক্যাডারে পদোন্নতি পাবেন এবং পদায়িত হবেন। তিনি আরও বলেন, যারা সুপারিশ করেছেন, তারা কি লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে পদোন্নতি পেয়েছেন? এসবকিছু বাস্তবায়নের অযোগ্য বলে মনে করেন সাবেক এই আমলা। পৃথিবীর কোনো দেশে লিখিত পরীক্ষায় পদোন্নতির নিয়ম নেই।

উপসচিব ও তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি সুবিধা বাতিল করার সুপারিশ প্রসঙ্গে আবু আলম শহীদ খান বলেন, কেন এই সিস্টেম চালু করা হলো, তা জানা থাকা দরকার ছিল। সরকারি যানবাহন অধিদপ্তর ও মেরামত কারখানায় হরিলুট হতো। সরকারি গাড়ির কোনো যত্ন ছিল না। সরকার বছরে কোটি কোটি টাকা গচ্চা দিয়েছে। পরবর্তী সময়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে নিজস্ব পরিবহণ থাকলে কর্মকর্তারা গাড়ির যত্ন নেবেন এবং সে সিদ্ধান্তের আলোকে সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি দেওয়া হবে। এখন যদি সুদমুক্ত ঋণে গাড়ি সুবিধা বাতিল করা হয়, তাহলে আবার সরকারি পরিবহণপুল থেকে গাড়ি দিতে হবে। সেখানে কোটি কোটি টাকা তছরুপ হবে। গাড়ির তেল, পার্টস, টায়ার, টিউবসহ যাবতীয় কেনাকাটায় হরদম লুটপাট হবে।

আবু আলম মো. শহীন খান আরও বলেন, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রমাণের আগে এবং আদালতে চার্জশিট গ্রহণের আগে কাউকে ওএসডি করা যাবে না। এরপর বিচার হবে। এর আগে কাউকে ওএসডি করলে তার প্রতি অবিচার হয়। সংস্কার কমিশনের সুপারিশে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠানোর কালাকানুন বাতিলের সুপারিশকে তিনি সাধুবাদ জানান।

সাবেক সচিব আনোয়ার ফারুক যুগান্তরকে বলেন, কমিশনের মৌলিক সুপারিশের সঙ্গে আমি দ্বিমতপোষণ করছি। কারণ, সরকারের আকার বা সাইজ ছোট করতে হবে। আগের সরকার কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ সাত লাখ থেকে সতেরো লাখে উন্নীত করেছে। এখন অবসরে যাওয়া কর্মচারীদের পেনশন দিতে পারছে না। এ ধরনের ভুল আর করা যাবে না। এত ছোট দেশে প্রাদেশিক সরকারের কোনো প্রয়োজন নেই। কমিশনের রিপোর্টে সরকারের আকার ছোট করার কোনো সুপারিশ নেই। এসইএসে নন-ক্যাডারদের ঢুকতে দেওয়া যাবে না। তাহলে ক্যাডার কর্মকর্তাদের এত প্রশিক্ষণ দিয়ে লাভ হলো কী? দুর্নীতি দমনে কমিশনকে শক্তিশালী করার বিষয়ে কোনো সুপারিশ নেই। দুর্নীতি দমনে করণীয় বিষয়ে একটি গাইডলাইন দেওয়া দরকার ছিল। কমিশনের রিপোর্টে জেলা প্রশাসককে (ডিসি) সিআর মামলার অভিযোগ গ্রহণের এখতিয়ার দেওয়া, বাধ্যতামূলক অবসরের কালাকানুন বাতিল করা, উপজেলা ব্যবস্থা শক্তিশালী করাসহ ভালো কিছু সুপারিশ রয়েছে বলে মনে করেন সাবেক এই আমলা। এছাড়া তিনি সরকারের মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও উপমন্ত্রী এবং সংসদ-সদস্যদের বার্ষিক সম্পদবিবরণী দাখিলের সুপারিশকে স্বাগত জানান।

আরেক বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া যুগান্তরকে বলেন, কমিশনের অনেক সুপারিশ বাস্তবায়ন অযোগ্য। এতে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ফিরোজ মিয়া বলেন, ক্যাডার সার্ভিসগুলো এভাবে ভেঙে ফেলার কোনো মানে হয় না। ক্যাডার ভেঙে ফেলার প্রভাব কী, তা প্রতিবেদন জমা দেওয়ার আগে বিশ্লেষণ করা হয়নি। কোন দেশের মডেল অনুসরণ করে কমিশন রিপোর্টে দিল, তা উল্লেখ করা হয়নি। ১৫ বছর চাকরি করার পর সব সুবিধাসহ স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুবিধা প্রসঙ্গে ফিরোজ মিয়া বলেন, সরকারের এ ধরনের আর্থিক সামর্থ্য আছে? একজন কর্মকর্তাকে রাষ্ট্র লেখাপড়া করিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করল, এরপর ১৫ বছর চাকরি করে তিনি অবসরে গিয়ে রাষ্ট্রীয় অর্থে অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগিয়ে লাভবান হবেন-এমন সুযোগ দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য কি রাষ্ট্রের আছে। তাছাড়া এলজিইডির প্রকৌশলীরা নন-ক্যাডার, নন-ক্যাডার প্রকৌশলীদের ক্যাডারভুক্ত করা এবং নন-ক্যাডারদের কর্মচারীদের সুপিরিয়র এক্সিকিউটিভ সার্ভিস (এসইএস) পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ রাখার ফলে প্রশাসনে বিশৃঙ্খলা হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এছাড়া প্রস্তাবিত ভাঙাগাড়ার ফলে হাজার হাজার পদ সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রের কি হাজার হাজার নতুন পদে জনবল নিয়োগের সামর্থ্য আছে। এসইএসে পরীক্ষা প্রসঙ্গে ফিরোজ মিয়া বলেন, একজন কর্মকর্তা কি সারা বছর লেখাপড়াই করবে। সে পরবর্তী পদোন্নতির জন্য পড়বে, না জনসেবা করবে। যদি লেখাপড়ার চাপ থাকে, তাহলে জনসেবা কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় হবে না। তিনি আরও বলেন, আমার বিবেচনায় জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট কম মেধাবী একজন ছাত্রের থিসিস পেপার মাত্র।

Jamuna Electronics
wholesaleclub

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম