Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

ব্যারিকেড ভেঙে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে আহতরা

বারবার কেন রাস্তায় নামতে হচ্ছে

সহায়তায় ২৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ, এ সপ্তাহের মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর-মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা * পুনর্বাসন ও বিদেশে কর্মসংস্থান হবে, ধৈর্য হারাবেন না-হাসনাত আব্দুল্লাহ

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বারবার কেন রাস্তায় নামতে হচ্ছে

‘আমরা এখন পর্যন্ত শুধু আশ্বাসই পাইছি। কোনোটির বাস্তবায়ন হয়নি। গতকাল (শনিবার) রাতে রাস্তায় নামছি, কিন্তু এখনো আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগ করেননি। আমরা চাই, আমাদের দাবিগুলো পূরণ করা হোক। কেউ না এলে আমরা রাস্তা ছাড়ব না। আমাদের কর্মসূচি চলবে।’ কথাগুলো বলছিলেন সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন ও রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির দাবিতে আন্দোলনরত জুলাই বিপ্লবে আহত নাঈম শেখ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে আরও বলেন, আমরা জীবন দিয়ে, রক্ত দিয়ে ফ্যাসিস্টকে বিদায় করেছি। অনেকে অঙ্গ হারিয়েছি। অথচ সুচিকিৎসার জন্য আমাদেরই বারবার রাস্তায় নামতে হচ্ছে। 

রোববার মধ্যরাতে আন্দোলনরত আহতরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে রাজধানীর মিন্টো রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে গিয়ে বিক্ষোভ করেন। তাদের শান্ত করতে সেখানে উপস্থিত হন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। এ সময় তিনি বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহতদের সুচিকিৎসা দিতে পারে নাই, এটা সরকারের ব্যর্থতা। এজন্য সরকারের আমলাতান্ত্রিক পদ্ধতি দায়ী, সচিবরা দায়ী, আমলারা দায়ী। যারা আহত হয়েছেন তাদের আমরা সুচিকিৎসা দিতে পারি নাই, এজন্য আমি নিজে ব্যথিত। হাসনাত আব্দুল্লাহ আরও বলেন, এই সরকার আহতদের পুনর্বাসন নিশ্চিত করবে। যোগ্যতা অনুযায়ী বিদেশে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হবে। কাজ চলছে, ধৈর্য হারাবেন না।

শনিবার রাত থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলনে আহত ব্যক্তিরা রোববার দিনভর রাজধানীর শিশুমেলা মোড়ে মিরপুর সড়ক অবরোধ করেন। সন্ধ্যায় তারা সেখান থেকে যাত্রা করেন প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের দিকে। সন্ধ্যা ৭টা ৩৯ মিনিটে শাহবাগের ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে পৌঁছে পুলিশের ব্যারিকেডে আটকে পড়েন আন্দোলনকারীরা। সেখানে বসেই তারা বিক্ষোভ চালিয়ে যান। পরে রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে ব্যারিকেড ভেঙে যমুনার দিকে অগ্রসর হন। যমুনার সামনে পৌঁছালে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা সেনাসদস্যরা সেখানে অবস্থান নেন। তারা দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার কথা জানান। রাত পৌনে ১টায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত যমুনার সামনে, আহতরা অবস্থান নিয়ে সুচিকিৎসা, পুনর্বাসন, ক্ষতিপূরণের দাবিতে নানা স্লোগান দিচ্ছিলেন।

জানা যায়, দ্রুত সময়ের মধ্যে তাদের পুনর্বাসন, সুচিকিৎসা, রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, হতাহতদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ ও আহতদের ক্যাটাগরি বাদ দেওয়াসহ বিভিন্ন দাবিতে আন্দোলন করছে আহতরা। শনিবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর পঙ্গু হাসপাতাল ও জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে বের হয়ে সড়ক অবরোধ করেন তারা। এতে সড়কের দুপাশে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। একইভাবে রোববারও আন্দোলনের কারণে শ্যামলী, মোহাম্মদপুর ও আগারগাঁও এলাকায় যান চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। এদিন বিকালে আহতদের কল্যাণে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি অধিদপ্তর করা হবে-সরকারের পক্ষ থেকে এমন আশ্বাসের পর সড়ক ছেড়ে হাসপাতালে ফিরে যায় একটি অংশ। তবে অন্যরা দাবিতে অনড় থাকে। 

গত বছরের ১৪ নভেম্বর পঙ্গু হাসপাতালের সামনে এবং চলতি বছরের ২ জানুয়ারি শাহবাগে সড়কে বিক্ষোভ করেন আহতরা।

আন্দোলনরত মনিরুল ইসলাম বলেন, আমদের ৭ মাস ধরে সু-চিকিৎসা, পুনর্বাসনসহ নানা দাবির জন্য রাস্তায় নামতে হচ্ছে। আমরা শেখ হাসিনাকে উৎখাত করে কী লাভ হলো। শেখ হাসিনার আমলের মতোই আমরা বৈষম্যের শিকার হচ্ছি। আমাদের অধিকার নিয়ে বর্তমান উপদেষ্টারা সোচ্চার নন। শনিবার থেকে আমরা সড়কে অবস্থান করছি। অথচ, এ নিয়ে সরকারের কোনো মাথাব্যথা নেই। আজকে (রোববার) বিকাল ৪টার মধ্যে যদি আমাদের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না আসে। তাহলে আমরা বিকাল ৪টার পর সচিবালয় ঘেরাও করতে যাব। 

যাত্রাবাড়ী এলাকায় আহত হাসান বলেন, ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় আমি পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়েছি। বর্তমান সরকার আমাদের ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার ঘোষণা দিলেও হাসপাতালে আমাদের চিকিৎসা দিতে অবহেলা করে। চিকিৎসকরা প্রতিদিন নির্দিষ্ট একটা সময় প্রতিটি ওয়ার্ডে মুখ দেখিয়ে আসেন আর যান। ঠিকমতো তারা কোনো চিকিৎসা দিচ্ছেন না। আমাদের অনেকে আছেন আহত হয়ে চিকিৎসকদের অবহেলার কারণে পঙ্গু হয়ে কর্মক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছেন। অনেকে চিকিৎসা করাতে গিয়ে বিভিন্ন এনজিও থেকে লোন করেছেন। আবার কেউ কেউ বাড়ির ভিটেমাটি বিক্রি করে চিকিৎসা করাচ্ছেন। তাই আমাদের দাবি, আমাদের আহতদের সু-চিকিৎসা, পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানের দ্রুত ব্যবস্থা করতে হবে। এই দাবি নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা রাস্তা ছাড়ব না। 

আন্দোলনরত শাহীন বলেন, আমি ৪ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়েছি। তখন ঠিকমতো কোনো চিকিৎসা পাইনি। আমাকে ডাক্তাররা ঠিকমতো চিকিৎসা দিলে আমাকে পঙ্গুত্ববরণ করে নিতে হতো না। আমি পঙ্গু হয়ে সবকিছু হারালাম। অথচ, এ নিয়ে সরকার কিংবা হাসপাতাল এবং সংশ্লিষ্ট কারও কোনো মাথাব্যথা নেই। সবকিছু আমরা বিসর্জন দিয়ে এখন আমরা মহা বিপদে। আমাদের দ্রুত তিন দফা দাবি বাস্তবায়ন করা হোক। এটাই আমাদের একমাত্র চাওয়া।

এদিকে বিকালে সচিবালয়ে আহতদের চিকিৎসায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা চিকিৎসক দলের সঙ্গে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহাকারী অধ্যাপক ডা. সায়েদুর রহমান বলেন, জুলাই বিপ্লবে আহতদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ১৪ হাজার ১২ জনের মতো ভেরিফাইড (যাচাই-বাছাই করে চিহ্নিত) হয়েছে। যাচাই-বাছাইয়ের পর ১২ হাজার ৯৮১ জনের তালিকা হয়েছে। তালিকাভুক্তদের মধ্যে এখনো ১২৩৮ জনের ক্যাটাগরি নির্ধারণ করা যায়নি। 

স্বাস্থ্য উপদেষ্টা নূরজাহান বেগম বলেন, আহতদের চিকিৎসা পুনর্বাসনে সরকার গুরুত্বের সঙ্গে কাজ করছে। উন্নত চিকিৎসায় ইতোমধ্যে ৩০ জনকে থাইল্যান্ড ও সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়েছে। দেশের হাসপাতালে ৫টি দেশে থেকে বিশেষজ্ঞ এনে সেবা দেওয়া হচ্ছে। তাদের সুচিকিৎসা ও পুনর্বাসন সরকারের মূল লক্ষ্য।

এদিকে সচিবালয়ে পৃথক বৈঠকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ফারুক-ই আজম বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে যারা আহত ও নিহত হয়েছেন, তাদের পরিবারের প্রতি সরকার অনেক বেশি সহানুভূতিশীল। তাদের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছে সরকার। তিনি বলেন, শহিদদের ব্যাপারেও সরকার অতি দ্রুত কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। তাদের তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং সেটা গেজেট আকারে প্রকাশ করা হয়েছে। আহতদের ব্যাপারে ক্যাটাগরি অনুযায়ী তালিকা হচ্ছে। 

এ সপ্তাহের মধ্যে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান অধিদপ্তর গঠন হচ্ছে জানিয়ে এই উপদেষ্টা বলেন, অধিদপ্তরের অধীনে একটা নীতিমালা হচ্ছে। এই নীতিমালার অধীনে হতাহতদের যাবতীয় সহায়তা দেবে সরকার। সরকার এ কাজগুলো যতটা দ্রুততার সঙ্গে সম্ভব সম্পন্ন করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

তিনি আরও বলেন, চলতি অর্থবছরে নিহতদের পরিবারকে এককালীন ১০ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনে দেওয়া হবে এবং আহতদের বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে সহায়তা দেওয়া হবে। আহত-নিহতদের সহায়তায় চলতি অর্থবছরে ২৩২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আহতদের সারা জীবনের জন্য চিকিৎসা এবং অন্যান্য ভাতা দিয়ে দেওয়ার বিষয়টি সরকারের বিবেচনায় আছে।’

এদিকে শনিবার রাত থেকে রোববার দিনভর সড়ক বন্ধ থাকায় ওই এলাকায় অবস্থিত শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল হাসপাতাল, জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, পঙ্গু হাসপাতাল জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল, শ্যামলী ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট টিবি হাসপাতাল ও জাতীয় নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে আসা রোগী ও স্বজনদের চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়। সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে যান চলাচল বন্ধ থাকায় দুর্ভোগে পড়েন সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরাও।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম