Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদন হস্তান্তরকালে পিয়ারসন

সরাসরি গুম-খুনের নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

সরাসরি গুম-খুনের নির্দেশ দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

ছবি: সংগৃহীত

গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সরকারকে মূল কাঠামোগত সংস্কারে জোর দিতে বলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। সংস্থাটি গণগ্রেফতার ও প্রতিশোধমূলক সহিংসতা বন্ধ করার তাগিদ দিয়েছে। আটকের ক্ষেত্রে আইন অনুসরণ ও সমালোচকদের দমনের জন্য ব্যবহৃত আইন বাতিল চায় এইচআরডব্লিউ। বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমে জড়িত থাকায় বিশেষায়িত বাহিনী র‌্যাবকে বিলুপ্তির সুপারিশ করেছে। জুলাই গণ-অভ্যুত্থান এবং বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব সুপারিশ করে সংস্থাটি। ৫০ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম-‘আফটার দ্য মুনসুন রেভল্যুশন : আ রোডম্যাপ টু লাস্টিং সিকিউরিটি সেক্টর রিফর্ম ইন বাংলাদেশ।’

এইচআরডব্লিউর একটি প্রতিনিধিদল এদিন সন্ধ্যায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে প্রতিবেদনটি হস্তান্তর করেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া পরিচালক এলেইন পিয়ারসন প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। এ সময় তিনি বলেন, গুমে জড়িত কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, শেখ হাসিনা বা সরকারের শীর্ষ কর্মকর্তারা নিখোঁজ হওয়ার বিষয়ে জানতেন। অনেক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরাসরি গুম ও হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

র‌্যাব বিলুপ্ত করার সুপারিশ তুলে পিয়ারসন বলেন, ‘গুম ও হত্যার জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা জরুরি।’ জবাবে ড. ইউনূস বলেন, ‘র‌্যাব তাদের অপরাধের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চেয়েছে, তবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং গুমের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের মুখোমুখি হতে হবে এবং শাস্তি পেতে হবে।’

পিয়ারসন বলেন, ‘২০০৯-২০২৪ সাল পর্যন্ত শেখ হাসিনার শাসনামলে নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ছিল এবং তারা শাসক দলের ক্যাডারের মতো আচরণ করত। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার প্রয়োজন। আপনারা এখন পর্যন্ত যে অগ্রগতি করেছেন তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই। সংস্কারগুলোকে দৃঢ় করতে হবে এবং নিরাপত্তা বাহিনীকে যথাযথ নজরদারির আওতায় আনতে হবে।

এইচআরডব্লিউর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে দ্রুত ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টার্জিত অগ্রগতি ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। সংস্কারের ক্ষেত্রে ক্ষমতার পৃথকীকরণ এবং জনপ্রশাসন, পুলিশ, সামরিক, বিচার বিভাগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব দিতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

সংস্কার স্থায়ী করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কারিগরি সহায়তা নিতে বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্বিচারে গ্রেফতার এবং প্রতিশোধমূলক যে সহিংসতার সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, গত বছরের আগস্টে গণবিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর তাতে একটি স্থায়ী সংস্কার করা জরুরি হয়ে পড়েছে। দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন নিশ্চিত করতে জাতিসংঘের সমর্থনকে অন্তর্বর্তী সরকারের স্বাগত জানানো উচিত।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়ার পরিচালক এলেইন পিয়ারসন বলেন, প্রায় এক হাজার বাংলাদেশি গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে, শুরু হয়েছে একটি যুগান্তকারী অধ্যায়ের। বাংলাদেশে একটি অধিকার ও সম্মানজনক ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ভবিষ্যতের সরকারের যে কোনো দমন-পীড়নকে প্রতিহত করতে দ্রুত ও কাঠামোগত সংস্কার করতে না পারলে অন্তর্বর্তী সরকারের কষ্টে অর্জিত অগ্রগতি সফল হবে না।

মার্চে অনুষ্ঠিতব্য মানবাধিকার কাউন্সিলের অধিবেশনে একটি ঐকমত্যের প্রস্তাব আনতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। যাতে সংস্কার প্রক্রিয়াকে সমর্থন করার জন্য জাতিসংঘের অব্যাহত পর্যবেক্ষণ ও প্রতিবেদন নিশ্চিত করা যায়। 

গণগ্রেফতার বন্ধে গাইডলাইন : প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অজ্ঞাতনামা আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করা এবং গণহারে গ্রেফতার নিষিদ্ধে পুলিশের জন্য একটি গাইডলাইন অন্তর্বর্তী সরকারের তৈরি করা উচিত। একই সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়কে সমালোচকদের দমনে ব্যবহৃত আইন সংশোধন করতে হবে। এছাড়া ‘আটক’সংক্রান্ত যত মামলা রয়েছে সেগুলোর বিচারে রিভিউ নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে। আটক যে কোনো ব্যক্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত ও দ্রুত বিচারকের সামনে হাজির করার বিষয়েও সুপারিশ করা হয়েছে।

বিচারবহির্ভূত হত্যা, ক্রসফায়ার ও বন্দুকযুদ্ধ বন্ধ : গত ১৫ বছরে প্রায় দুই হাজারের কাছাকাছি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়েছে উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ক্ষেত্রে ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তের মুখোমুখি করার ঘটনা নেই বললেই চলে। তদন্তের সময় সঠিকভাবে প্রক্রিয়া অনুসরণ করার আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডব্লিউ। একই সঙ্গে তদন্তকালীন বেআইনি মৃত্যু ঠেকাতে প্রয়োজনে মিনেসোটা প্রটোকল অনুসরণ করে অন্তর্বর্তী সরকারকে নতুন নিয়ম প্রতিষ্ঠা করতে সুপারিশ করা হয়েছে। ‘ক্রসফায়ারে হত্যাকাণ্ড’র স্বাধীন তদন্ত করতে জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের প্রযুক্তিগত সহায়তায় একটি স্বাধীন কমিশন গঠন করতে বলেছে মানবাধিকার সংস্থাটি। যেসব কর্মকর্তা এসব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনা হবে-জনসম্মুখে এ ঘোষণা দিতেও আহ্বান করেছে সংস্থাটি।

হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সুপারিশ করেছে, শুধু এই শর্তেই বিলুপ্ত করা হবে যে, র‌্যাবের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা অন্য বাহিনীতে গিয়ে একই ধরনের অপকর্মের চর্চা করতে পারবে না। একই সঙ্গে এই বার্তাও দিতে হবে যে, বাহিনীটিকে ভবিষ্যতে অপব্যবহার করা হবে না এবং পরবর্তী সরকারের দমন-পীড়ন চালানোর হাতিয়ার হবে না বাহিনীটি।

বলপূর্বক অপহরণ ও গুম বন্ধের সুপারিশ : শেখ হাসিনার শাসনামলের হলমার্ক ছিল বলপূর্বক অপহরণ ও গুম। যদিও এ বিষয়টি বারবার অস্বীকার করেছে তার সরকার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে গোপন আটকের স্থানগুলো চিহ্নিত করা এবং প্রমাণ নষ্ট না করার নির্দেশ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারকে আহ্বান জানানো হয়েছে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে যে কোনো ব্যক্তির সঙ্গে গোপনে কথা বলার ক্ষমতা দিতেও সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। বেআইনিভাবে আটক ব্যক্তিদের অবিলম্বে মুক্তি নিশ্চিত করা উচিত মনে করছে সংস্থাটি। আইনের অধীনে একটি স্বতন্ত্র অপরাধ হিসাবে ‘বলপূর্বক গুম’ নিষিদ্ধ করতে আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতি সুপারিশ করা হয়েছে।

কার্যকর ও অধিকারভিত্তিক বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠা : অন্তর্বর্তী সরকারকে বিদ্যমান বিচার বিভাগের নিয়োগের এককালীন পর্যালোচনা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এই প্রক্রিয়া সঠিক ও ন্যায্য হয়েছে-তা নিশ্চিত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। বিচারক বা প্রসিকিউটরদের নিয়োগ বা পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ যাতে না থাকে তা নিশ্চিতে একটি ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুপারিশ করা হয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে। পাবলিক প্রসিকিউটরদের জন্য ভূমিকা এবং নিয়োগ পদ্ধতি পুনর্গঠনের আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রধান বিচারপতির সুপারিশ অনুযায়ী, বিচার বিভাগীয় কার্যক্রমে কোনো রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ নেই এবং যে কোনো মন্ত্রী বা কর্মকর্তা এই চেষ্টা করলে তাকে জবাবদিহি করা হবে তা নিশ্চিত করার জন্য একটি স্বাধীন সচিবালয় তৈরির সুপারিশ করা হয়েছে।

সক্রিয় নাগরিক সমাজ গঠন : অন্তর্বর্তী সরকার নতুন করে ‘সাইবার প্রটেকশন অর্ডিন্যান্স ২০২৪’ অনুমোদন করেছে। তবে এই অধ্যাদেশ নিয়েও সমালোচনা রয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ নাগরিক সমাজের বিশেষজ্ঞ এবং কর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করে খসড়া অধ্যাদেশটি সংশোধন করতে আহ্বান জানিয়েছে। একই সঙ্গে এই অধ্যাদেশটিকে একটি আইনে রূপান্তর করতে সুপারিশ করা হয়েছে। গণমাধ্যমের কার্যালয়ে হামলার তদন্ত ও বিচার করার আহ্বান জানিয়েছে সংস্থাটি। অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগ না থাকলে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহারের সুপারিশ করেছে মানবাধিকার সংস্থাটি। শান্তিপূর্ণ সমালোচকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রত্যাহার করতেও সুপারিশ করেছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম