ভাঙছে পদ্মা : কার ভুলে খেসারত দিচ্ছে কারা
ডিসির এক প্রস্তাবে ১৫শ কোটি টাকার কাজ বন্ধ
অনুসন্ধানী প্রতিবেদন
নকশা পরিবর্তন জরুরি হওয়ায় মাঝপথে এসে নদীভাঙন রোধের কাজ আটকে গেল। কিন্তু নদীভাঙন তো থেমে থাকে না। কুষ্টিয়ার দুটি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা পদ্মার ভাঙনে বিলীন হতে চলেছে। অথচ প্রায় ১ হাজার পাঁচশ কোটি টাকার প্রকল্পের কাজ এখনো শুরুই করা যায়নি। এ কারণে ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর বিপদের শেষ নেই। ফসলের খেত-খামারিসহ মানুষের ঘরবাড়ি, বাজারঘাট ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-সবকিছু চলে যাচ্ছে নদীগর্ভে।
এর আগে দরপত্রের মাধ্যমে এ প্রকল্পের ৩৩টি প্যাকেজের ১৮টির কার্যাদেশ দেওয়া হয়। গত বছর জুলাই থেকে কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও প্রস্তুতি নিয়ে সেই কাজও শুরু হয়নি। কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের এক চিঠিতেই আটকে যায় পুরো কাজ। দ্রুতগতিতে ভালোমানের কাজ করার জন্য ডিসির চিঠিতে সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেডকে দিয়ে করানো যেতে পারে বলে মতামত দেওয়া হয়।
এদিকে ডিসির চিঠি আসার পর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে সেনাবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষেকে এ বিষয়ে করণীয় সম্পর্কে জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়। এরপর সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ার ব্রিগেডের বিশেষজ্ঞ টিম নদীভাঙনকবলিত এলাকা পরিদর্শন করে। এরপর বেরিয়ে আসে আসল তথ্য। দেখা যায়, নদীশাসনের কাজ করতে বিলম্ব হওয়ায় নদীভাঙনের দিক পরিবর্তন হয়ে গেছে। ফলে বিদ্যমান নকশা অনুযায়ী কাজ করা হলে কোনো কাজে আসবে না। এমতাবস্থায় ভুক্তভোগী এলাকাবাসী নদীর ভয়াবহ ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পেতে দ্রুত বালির বস্তা (জিও ব্যাগ) ডাম্পিং করার কাজ শুরু করার আহ্বান জানিয়েছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব নাজমুল আহসান শনিবার যুগান্তরকে বলেন, ‘নকশা যদি পরিবর্তন করার প্রয়োজন পড়ে, তাহলে তো করতেই হবে। যেহেতু ভাঙনের গতি তীব্র হচ্ছে, তাই কাজটা যত দ্রুত সম্ভব শুরু করতে বলা হবে। আমি মনে করি, কাজটা শুরু করা এখন জরুরি। এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, এ সংক্রান্ত প্রকল্পে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরে ১ হাজার ৪৭১ কোটি ৯৮ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। প্রকল্পের আওতাভুক্ত এলাকা কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার তালবাড়িয়া, শামুখিয়া, নওদা, রানাখড়িয়া, মির্জানগর ও সাহেবনগর-যা প্রায় ৯ কিলোমিটার। এছাড়া আরও প্রায় দেড় কিলোমিটার এলাকার মধ্যে রয়েছে কুমারখালী উপজেলার কোমরকান্দি।
প্রকল্পের মেয়াদকাল ২০২৩ সালের ১ অক্টোবর থেকে ২০২৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। প্রকল্পটি ইজিপির ওটিএম (ওপেন টেন্ডার মেথড) পদ্ধতিতে ৩৩টি প্যাকেজের মাধ্যমে দরপত্র আহ্বান করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। বড় ১৮টি প্যাকেজে দরপত্রে অংশগ্রহণকারী ঠিকাদারদের দর যাচাই-বাছাই শেষে গত বছরের ২০ জুলাই কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ অবস্থায় অবশিষ্ট ১৫টি প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়নের সময় কুষ্টিয়ার ডিসি মো. তৌফিকুর রহমান ১৪ নভেম্বর মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেন। চিঠিতে মূল বক্তব্যে বলা হয়, ‘বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে কাজটি করা হলে তা সুচারুরূপে ও দৃঢ়তার সঙ্গে সম্পন্ন হবে, যা জনমনে প্রশান্তি এনে দেবে।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. তৌফিকুর রহমান রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘টেকনিক্যাল বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাই না। আমার কাছে মনে হয়েছে, কাজটা সেনাবাহিনীকে দিয়ে করালে আরও ভালো হবে। এজন্য প্রস্তাব দিয়েছি।’
বালির বস্তার ডাম্পিং যথাযথ নয় : সেনাবাহিনীর বিশেষজ্ঞদল সরেজমিন পরিদর্শন শেষে ১২ ডিসেম্বর পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয় অবহিত করে। লিখিত মতামত পত্রে বলা হয়, ‘গত বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে পাউবোর ওয়ার্কিং ডিজাইন (কাজের নকশা) অনুযায়ী জিও ব্যাগ ডাম্পিংয়ের কাজ চলমান আছে, যা বর্তমানে তীব্র ভাঙনকবলিত নদীতীর রক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। এছাড়া নদীর পাড় অত্যন্ত খাড়া। সেখানে পর্যাপ্ত বালির স্তর বিদ্যমান রয়েছে বিধায় নকশাটি পুনর্বিবেচনা সাপেক্ষে বর্ণিত প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা যেতে পারে। এছাড়া তীব্র নদীভাঙনের কারণে ডিপিপিতে উল্লিখিত অ্যালাইমেন্ট থেকে নদীর তীর ৫০-৬০ মিটার (এখন সর্বোচ্চ ৪০ ফুট দূরত্বে ভাঙনের অবস্থান) মহাসড়কের দিকে স্থানান্তরের ফলে সড়কটির স্থায়িত্বও হুমকির মধ্যে রয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে নকশা পরিবর্তন করা যেতে পারে।’
যে কারণে ভাঙনের তীব্রতা : পাবনা জেলার ঈশ্বরদী উপজেলার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রকে ঝুঁকিমুক্ত রাখতে একটি গ্রোয়েন (পানির গতিবেগ পরিবর্তনসংক্রান্ত স্থাপনা) নির্মাণ করা হয়েছে। নদীভাঙনের হাত থেকে ওই ব্যয়বহুল পারমাণবিক স্থাপনা রক্ষায় পদ্মার বাম তীরে নদীর ভেতরের দিকে প্রায় ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্য এই গ্রোয়েন নির্মাণ করা হয়। এ কারণেই নদীর স্রোত পরিবর্তন হয়ে ডান তীরে সরাসরি আঘাত হানছে। এই ডান তীরই হচ্ছে কুষ্টিয়ার ভাঙনপ্রবণ এলাকা। মন্ত্রণালয়ে পাঠানো খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য জানানো হয়।
এদিকে কুষ্টিয়ার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী রাশিদুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, নদীভাঙনের দিক পরিবর্তনের বিষয়টি সঠিক। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু আমরা যদি শুরুতেই ৩৩টি প্যাকেজের কাজ যথাসময়ে শুরু করতে পারতাম, তাহলে এভাবে দিক পরিবর্তন হতে পারত না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি দাবি করেন, মূলত ১৮টি প্যাকেজের কার্যাদেশ শেষ করার পর অবশিষ্ট ১৫টি প্যাকেজের দরপত্র দ্রুত মূল্যায়ন করা দরকার ছিল। কিন্তু ওই সময়ে ডিসি অফিস এবং মন্ত্রণালয়ের মধ্যে চিঠি চালাচালি শুরু হওয়ায় দরপত্র প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা যায়নি।
সরেজমিন : নদীভাঙনের ভয়াল চিত্র সরেজমিন প্রত্যক্ষ করতে যুগান্তর অনুসন্ধান টিম ২১ জানুয়ারি হাজির হয় ভাঙনকবলিত কুষ্টিয়া সদরের মীর্জানগরে। প্রতিবেদক নদীর পাড় ধরে যখন হাঁটছিলেন, তখনও রাক্ষুসে পদ্মার পেটে ধসে পড়ছে ফসলের মাঠ-ঘরবাড়ি। আশপাশের এলাকাবাসীর চোখে-মুখে শুধুই আতঙ্কের ছাপ আর ক্ষোভ। এ সময় বেশ কয়েকজন এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা হয়। আলেয়া বেগম (৩০) নামে এক গৃহবধূর কাছে জানতে চাইলে তিনি নদীর দিকে হাত উঁচিয়ে দেখান প্রায় এক কিলোমিটার দূরে তাদের ঘর ছিল, যা এখন শুধুই স্মৃতি। তিনি বলেন, রাক্ষুসে পদ্মা আমাদের সব কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে দিয়েছে। ছয়-সাত মাস ধরে পদ্মার ভাঙনের তীব্রতা বাড়লেও কেউ তাদের খোঁজও নেয়নি। সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতাও পাননি। আলেয়া বেগম আক্ষেপ করে জানান, তার নিজের বাড়িটি বিলীন হওয়ার পর এখন অন্যের জমিতে খুপরি ঘর করে থাকছেন। দিনমজুর স্বামীর পক্ষে জমি কিনে বাড়ি করার সাধ্য নেই। গত কুরবানির ঈদের পর থেকে পদ্মার ভাঙন শুরু হয়। এরপর বহু মানুষ এলাকা ছেড়ে চলে গেছেন।
আলেয়া বেগমের সঙ্গে কথা বলার সময় পরিচয় জানার পর ভুক্তভোগীদের অনেকে সেখানে জড়ো হন। এ সময় একই গ্রামের উজ্জ্বল বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখছি নদীভাঙন। তবে দুই-তিন বছর ধরে বেশি ভাঙন শুরু হয়েছে। আমরা সাধারণ মানুষ এতকিছু বুঝি না। তবে শুনেছে নদীর ওপারে (ঈশ্বরদী) পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্থাপনা নির্মাণের পর থেকে বড় ধরনের এই ভাঙন শুরু হয়েছে। সবচেয়ে কষ্টের বিষয়-আমাদের পাশে কেউ নেই। আমরা শেষ হয়ে গেলাম।
এদিকে ভাঙনপ্রবণ এলাকায় গিয়ে কথা হয় কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী আল আমিনের সঙ্গে। নদীভাঙনের বর্ণনা দিতে গিয়ে এ কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ভাঙনের ভয়াবহতার কারণেই পদ্মাকে বলা হয় ‘রাক্ষুসে পদ্মা।’ বর্তমানে পদ্মার ভাঙন এতই ভয়াবহ যে যদি একটি বড় গাছ খাড়া অবস্থায় পড়ে, নিমিষেই তলিয়ে যাবে। মুহূর্তের মধ্যে এই গাছ আর দেখা যাবে না। মূলত নদ-নদীর তলদেশ থেকে এই ভাঙন দেখা দিয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যেই মির্জানগর কবরস্থানসহ বেশকিছু স্থাপনা নদীর পেটে চলে গেছে। আর ৪০০ ফুট অগ্রসর হলেই কুষ্টিয়া-পাবনা মহাসড়কের একাংশ নদীগর্ভে চলে যাবে। তখন যোগাযোগব্যবস্থাও বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। নদীতে বিলীন হয়েছে জাতীয় গ্রিডের তিনটি বৈদ্যুতিক টাওয়ার। এক সপ্তাহের মধ্যে সাহেবনগর, মির্জানগর ও তালবাড়িয়া গ্রামের কয়েকশ একর জমিও ভেঙে নদীর আকার বড় হয়ে গেছে।