সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের প্রভাব
নৌরুট নয় তবুও ৩৪২ কোটি টাকার খনন প্রকল্প
কাজী জেবেল
প্রকাশ: ২৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
সরকার ঘোষিত কোনো নৌরুট নয়। যাত্রী ও পণ্যবাহী নৌযান চলাচল করে না বললেই চলে। কাছাকাছি উজানে নেই নদীবন্দর এবং স্থলবন্দর। চলে গ্রামীণ ছোটখাটো নৌযান। শুষ্ক মৌসুমেও পানির গভীরতা থাকে ৩.৫-৪ ফুট।
এমন নদী খননে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে ৩৪২ কোটি ২৬ লাখ টাকার একটি প্রকল্প। নৌরুট নয় এরপরও কার্যপরিধি লংঘন করে এটি বাস্তবায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। এত বড় অঙ্কের টাকার প্রকল্প নেওয়ার আগে সমীক্ষা করার নিয়ম থাকলেও তা অনুসরণ করেনি সংস্থাটি। ঠিকাদার নিয়োগেও হয়েছে কারসাজি। তবে এসব কাজের সঙ্গে জড়িতরা অধরাই রয়েছেন।
আলোচিত প্রকল্পটি হচ্ছে- ‘মিঠামইন উপজেলার ঘোড়াউতরা, বোলাই-শ্রীগাং নদীর অংশবিশেষ, ইটনা উপজেলার ধনু নদী ও নামাকুড়া নদী এবং অষ্টগ্রাম উপজেলার ধলেশ্বরী নদীর অংশ বিশেষের নাব্য উন্নয়ন ও পুরুদ্ধার’। এর আওতায় এক কোটি সাত লাখ ঘনমিটার ক্যাপিটাল ড্রেজিং এবং ৯১ লাখ ১৮ হাজার ঘনমিটার সংরক্ষণ ড্রেজিং করার কথা। এ পর্যন্ত প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ১৮ কোটি টাকা। নথিপত্র পর্যালোচনা এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এসব তথ্য জানা গেছে।
প্রকল্পভুক্ত নদী কিশোরগঞ্জ-৪ আসনের অন্তর্ভুক্ত এলাকায় অবস্থিত। ওই আসনে বারবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন মো. আবদুল হামিদ। পরে তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাবস্থায় ২০২২ সালে এ প্রকল্প অনুমোদন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। ‘মহামান্য রাষ্ট্রপতির এলাকা তাই... ডিপিপি তৈরি করতে হবে’-নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের এক চিঠিতে উল্লেখ করা এমন নির্দেশনায় নেওয়া হয় এ প্রকল্প।
সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৫ আগস্ট দেশের পটপরিবর্তনের পর এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিনা-তা খতিয়ে দেখতে ১১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়। কমিটির সদস্যরা এ প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা নেই বলে জানিয়েছেন। কাজ পাওয়া ঠিকাদাররা যাতে মামলা না করেন, সেজন্য কার্যাদেশের মেয়াদকাল পর্যন্ত ড্রেজিং চালানোর সুপারিশ করেছেন। তবে প্রয়োজন না থাকায় কমিটি ৩৪২ কোটি ২৬ লাখ টাকা প্রকল্প ব্যয়ের ২৭২ কোটি ৬ লাখ টাকার নদী খনন কাজ বাতিলের সুপারিশ করেছে।
এ ধরনের প্রকল্প ‘রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়’ বলে মন্তব্য করেছেন নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ড. মনজুর আহমেদ চৌধুরী।
যুগান্তরকে তিনি বলেন, সমীক্ষা ছাড়া এত বড় অঙ্কের টাকার প্রকল্প পাশ করায় প্রতীয়মান হয় আগের সরকার কীভাবে রাষ্ট্রীয় টাকার অপচয় করেছে। দেশের টাকা নষ্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাসহ যারা জড়িত তাদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তিনি বলেন, হাওড় এলাকার নদীতে কাটার সাকশন ড্রেজার ব্যবহার করে ড্রেজিং করায় সেখানে পরিবেশগত ক্ষতি হচ্ছে। আবার যে অংশে ড্রেজিং করা হচ্ছে তা জনগণের উপকারেও আসেনি। অথচ দেশের অনেক এলাকায় নদী ড্রেজিং অনেক বেশি দরকার, সেখানে করা হচ্ছে না। হাওড় এলাকায় ড্রেজিংয়ের আগে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন করা উচিত ছিল বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নৌপরিবহণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ যুগান্তরকে বলেন, আমাদের গঠন করে দেওয়া কমিটির সদস্যরা প্রতিবেদনে বলেছেন, এত টাকা খরচ করে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হলেও সাধারণ মানুষের কোনো উপকার হবে না। এ কারণে কমিটি প্রকল্পের খরচ অনেক কমিয়ে আনার সুপারিশ করেছে। আমরা ওই সুপারিশ প্রকল্পের স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে তুলব। সেখানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে প্রকল্প : নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, অসত্য তথ্যের ভিত্তিতে এ প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পে বাড়তি ব্যয়েরও ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এ প্রকল্প নেওয়ার আগে বাস্তবে কোনো ধরনের সমীক্ষা চালায়নি বিআইডব্লিউটিএ। সংস্থাটির একটি কমিটির তৈরি করা দুই পৃষ্ঠার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে তৈরি করা ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, হাওড়বেষ্টিত ওই অঞ্চলে প্রতিদিন যাত্রীবাহী লঞ্চসহ মালবাহী অসংখ্য জাহাজ চলাচল করে।
নাব্যর বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন অংশ পুরোপুরি শুকিয়ে যায়। এতে নৌযান চলাচল করতে পারে না। ওইসব নৌযান চলাচলের স্বার্থে এ প্রকল্প নেওয়ার সুপারিশ করা হয়। প্রকল্প গ্রহণে সহায়ক হিসেবে জমা দেওয়া সিইজিআইএস নামের এক প্রতিষ্ঠানের প্রতিবেদনে বলা হয়, ওইসব রুটে দৈনিক প্রায় ১৫০০ যাত্রী এবং প্রায় ৫০ টন মালামাল পরিবাহিত হয়।
প্রতিবেদনটির তথ্য সঠিক নয়, তার প্রমাণ মিলেছে নৌমন্ত্রণালয়ের অপর এক প্রতিবেদনে। নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মোহাম্মদ এমরান হোসেনের নেতৃত্বাধীন ১১ সদস্যের কমিটি গত ১৯ ডিসেম্বর প্রকল্প এলাকা নৌপথে পরিদর্শন করেন। পরিদর্শনকালে তারা মাত্র একটি মালবাহী নৌযান চলাচল করতে দেখেছেন। সেখানে যাত্রীবাহি লঞ্চ চলাচল করে না। কাছাকাছি নদীবন্দর বা স্থলবন্দরও নেই। সেখানে শুধু গ্রামীন নৌযান চলাচল করে বলে স্থানীয় ব্যক্তিরা কমিটিকে জানিয়েছেন।
শুস্ক মৌসুমে নদীর নাব্যর বিষয়ে ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুস্ক মৌসুমেও ৩.৫ থেকে ৪ ফুট পানির গভীরতা থাকে। বর্ষাকালে ওই এলাকা পানিতে ডুবে যায়। প্রকল্প নেওয়ার আগের প্রতিবেদনে শুস্ক মৌসুমে শুকিয়ে যাওয়ার যে তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে, তা ওই কমিটির সদস্যরা পাননি। প্রতিবেদনে ড্রেজিংয়ের মাটিতে বালির চেয়ে পলির পরিমান বেশি পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এতে বুঝা যায়, সেখানে বর্ষা মৌসুমে উজান থেকে আসা আকস্মিক বন্যার কারণে নদীগুলো ভরাট হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম। অথচ এ প্রকল্পে নদীভরাটের কথা উল্লেখ করে ১৩৫ কোটি টাকা ধরা আছে। যদিও ওই কমিটির প্রতিবেদনে এ ড্রেজিং প্রয়োজন নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
কাজ দেওয়া হয় পছন্দের ঠিকাদারদের : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এ প্রকল্পে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ও বঙ্গ ড্রেজার্স নামের দুটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বিআইডব্লিউটিএর নিজস্ব ড্রেজার দিয়ে ড্রেজিং চলছে। বেসরকারি দুই প্রতিষ্ঠানকে কারসাজির মাধ্যমে কাজ দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। টেন্ডারের প্রাক্কলিত টাকার চেয়ে ১০ শতাংশ কম দরে ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং ৫২ কোটি ৫২ লাখ ৪০ হাজার টাকায় এবং বঙ্গ ড্রেজার্স ৫২ কোটি ৯২ লাখ টাকায় কাজ পেয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০২৩ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত ওই টেন্ডারে বিআইডব্লিউটিএ থেকে প্রতিষ্ঠান দু’টিকে প্রাক্কলিত গোপন দর সরবরাহ করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। এ কারণে তারা প্রাক্কলিত দরের সঙ্গে মিল রেখে দরপত্র জমা দিতে পেরেছেন। দুটি টেন্ডারের একটিতে পাঁচটি ও আরেকটি চারটি প্রতিষ্ঠান টেন্ডার জমা দিলেও তারা এভাবে মিলিয়ে দর দিতে পারেননি। এই টেন্ডার প্রক্রিয়ার সঙ্গে সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সম্পৃক্ততা ছিল বলেও জানান তারা।
বিষয়টি স্বীকার করেছেন ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক বশির আহমেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, আগের সরকারের আমলে যাকে যে কাজ ভাগ করে দিত, তাকে সেই কাজের টেন্ডারের প্রাক্কলিত গোপন দর দিয়ে দেওয়া হতো। সেই দর অনুযায়ী টেন্ডার জমা হতো। আমিও সেভাবেই টেন্ডার পেয়েছি। কে দর দিয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখনকার প্রতিমন্ত্রীর (খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর) দপ্তরের লোকজনই আমাকে সহযোগিতা করেছে।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য যোগযোগ করা হয় সাবেক নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর সঙ্গে। কিন্তু তিনি পলাতক থাকায় তাকে পাওয়া যায়নি। ফলে তার সঙ্গে কথা বলাও সম্ভব হয়নি।
তবে ওই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মুহাম্মদ হারুন অর রশীদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কাকতলীয়ভাবে প্রাক্কলিত টাকার সঙ্গে ঠিকাদার দু’টি প্রতিষ্ঠানের দর মিলে গেছে।
তিনি বলেন, প্রকল্পের ডিপিপি অনেকের কাছে থাকে। সেখানে দর উল্লেখ করা থাকে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দক্ষ হলে ডিপিপিতে উল্লেখ থাকা টাকার অঙ্ক হিসাব করে এভাবে দরপত্র জমা দিতে পারে।