অপ্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাব, ঘোষণাপত্র ও নতুন দল
তিন ইস্যুতে সন্দেহ বাড়ছে বিএনপিতে
নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা দেখছেন, সরকারের ‘আনুকূল্যে’ দল হলে আপত্তি * নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ না দিলে কর্মসূচির চিন্তা
‘অপ্রয়োজনীয়’ সংস্কার প্রস্তাব, গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র ও নতুন দল গঠন-এই তিন ইস্যুতে সন্দেহ বাড়ছে বিএনপিতে। সম্প্রতি সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্য এবং সরকারের এক উপদেষ্টার পালটা বক্তব্যকে কেন্দ্র করে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে। বিএনপির মহাসচিবের বক্তব্যের পেছনেও তিনটি ইস্যুর প্রভাব রয়েছে বলে মনে করছেন নেতারা। দলটির ভাষ্য, যে কোনো নতুন দল এলে নেতারা স্বাগত জানাবেন। কিন্তু সরকারের ‘আনুকূল্যে’ কোনো দল গঠন হলে তাতে আপত্তি থাকবে। এসবের পেছনে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রলম্বিত করার যোগসূত্রও থাকতে পারে বলে তারা ভাবছেন। এ ছাড়া ইস্যুগুলো যারা সামনে আনার চেষ্টা করছেন বিএনপির সন্দেহ মূলত তাদের ঘিরে। এ পরিস্থিতিতে দ্রুত নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ এবং নতুন দল গঠনের বিষয়ে সরকারের দায়িত্বশীল জায়গা থেকে ব্যাখ্যা চাইবে বিএনপি। পাশাপাশি সমস্যা সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে দ্রুত সংলাপের ওপরও জোর দিচ্ছেন দলের নেতারা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
বিএনপি শুরু থেকেই এ সরকারকে সমর্থন ও সহযোগিতা করে আসছে বলে মনে করেন নেতারা। তারা কখনোই বলেনি সংস্কার চায় না। বিএনপি বলেছে প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচন, যা এখন সব রাজনৈতিক দলও চাইছে।
কিন্তু বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের অনেক ‘অপ্রয়োজনীয়’ প্রস্তাব, এতদিন পর গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির উদ্যোগ এবং নতুন দল গঠন-এসব একই সূত্রে গাঁথা বলে নেতারা মনে করছেন। এর পেছনে তারা নির্বাচন প্রলম্বিত করার চেষ্টা দেখছেন। কাজেই তারা দ্রুত নির্বাচনের রোডম্যাপ চান। সম্ভব নির্বাচনের স্পষ্ট রোডম্যাপ না দিলে কর্মসূচি দেওয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। নেতাদের মতে, দ্রুত নির্বাচন না হলে সংকট আরও বাড়বে। ফ্যাসিবাদের পতন হলেও দেশ ও সরকারকে অস্থিতিশীল করতে তাদের দোসরদের নানামুখী ষড়যন্ত্র অব্যাহত রয়েছে। এর বাইরেও দেশে বিতর্ক সৃষ্টির নানা চেষ্টা আছে। এর আগে সংবিধান বাতিল করার দাবি এসেছে। কেউ কেউ বিদ্যমান সংবিধানকে ছুড়ে ফেলার কথা বলেছে। এর পরপরই জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়টি সামনে চলে এসেছে। রাজনৈতিক মতৈক্য না হলে এটিও এক ধরনের বিতর্ক-বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, নতুন দল গঠন নিয়ে বিএনপি মহাসচিব ঠিক কথাই বলেছেন। সরকারের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক দল গঠন হবে সরকারের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এতে মানুষের মনে সন্দেহ জাগবে। নির্বাচনের দিনক্ষণ যত সামনে আসবে, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারের অবস্থান ততই পরিষ্কার হবে। কাজেই রাজনৈতিক বিভেদ আরো বাড়ার আগেই প্রয়োজন সমস্যা সমাধানে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করা এবং তা দ্রুতই ব্যবস্থা করা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ভারতের দোসর এই আওয়ামী লীগ, তাদের দিকে যারা বিএনপিকে ঠেলে দিতে চায়, আমি বলব তারা নিজের চেহারা আয়নায় দেখুন। দেশবাসীকে ফাঁকি দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। বিএনপিকে যারা ভিন্ন শিবিরে ঠেলে দিয়ে ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন, এটার পরিণতি কিন্তু ভালো হবে না। বরং দেশটাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা উচিত। কোনো দলের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, ‘একটি দল আছে, নাম বলব না। ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য তারা পাগল হয়ে গেছে। তারা এমন ভাব করছে, তারা যেন কিছুই জানে না। সুযোগ পেলেই বিএনপির বিরুদ্ধে কথা বলছেন। তারা কারা এসব জনগণ জানে।’
বুধবার বিবিসি বাংলায় এক সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই সরকার যদি পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা আগামী জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করা পর্যন্ত থাকবে। তা না হলে তো নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে। এর একদিন পর বৃহস্পতিবার আরও কড়া অবস্থানে গিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, বেশ কিছু বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা পালন করতে পারছে না। বিএনপি মহাসচিবের এই বক্তব্যে কঠোর সমালোচনা করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্য-প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধি নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটি এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে।’ বক্তব্য দুটি ঘিরে রাজনৈতিক মহলে নানা আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
এদিকে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও চব্বিশের জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করে পথ চলতে চায় বিএনপি। একই সঙ্গে পচাত্তরের সিপাহি-জনতার বিপ্লব এবং নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনাকে লালন করে সামনে চলতে চায় দলটি। বিএনপির নীতিনির্ধারকদের পর্যবেক্ষণ, একাত্তরের ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ারও নানা ষড়যন্ত্র করছে একটি পক্ষ, যা নিয়ে ভাবাচ্ছে তাদের। সম্প্রতি বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক বৈঠকে সমসাময়িক অনেক বিষয়ে নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়। বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেশকিছু কর্মকাণ্ড দলটির মধ্যে শঙ্কার কারণ হিসাবে দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে, রাষ্ট্রপতির অপসারণ দাবির পর ৭২-এর সংবিধান বাতিলের দাবি- দুটিই উদ্দেশ্যমূলক বলে মনে করছে বিএনপি। পাশাপাশি এও মনে করা হচ্ছে যে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ করা গেলে পরবর্তীকালে সুযোগ পেলে বিএনপিকেও নিষিদ্ধের দাবি তোলা হতে পারে। সেই আয়োজনও দেখতে পাচ্ছে দলটি। বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে এ পর্যন্ত গণতন্ত্রের পক্ষে যা কিছু হয়েছে, এগুলোর কোনোটিকে বাদ দিয়ে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল বা সংগঠন অথবা ব্যক্তির পক্ষে পথ চলা সম্ভব নয়। যারা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ও ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবকে ধারণ করবে তাদের নিয়েই পথ চলবে বিএনপি।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের এক আলোচনা সভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মহান মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি সামনে আনেন। তিনি বলেন, দেশের মূল ইতিহাস একাত্তর থেকে জাতিকে দূরে সরিয়ে দেওয়ার আরেকটা ষড়যন্ত্র চলছে। একাত্তরে শহিদ বুদ্ধিজীবী এবং মুক্তিযুদ্ধের ঘোষক শহিদ জিয়াউর রহমানসহ বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বলেন, ‘একাত্তর আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এখন একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, একাত্তর একটু পেছনে রাখা। যেমন ’৪৭ সালে দেশভাগকে অনেকে বলেন যে, এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল। আমরা মনে করি, এটা ইতিহাস বিকৃতির ষড়যন্ত্র। এ বিষয়ে আমাদের সজাগ থাকতে হবে।’
নেতাদের পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, বিএনপিকে টার্গেট করেই ষড়যন্ত্র চলছে। সাম্প্রতিক ঘটনা যার বড় প্রমাণ। সামনে এসব আরও দেখা যাবে। এর পেছনে একটি রাজনৈতিক দলের ইন্ধন রয়েছে বলেও বিএনপি নেতারা মনে করছেন। নেতারা আরও বলেন, ওয়ান ইলেভেনের কথা টেনে আরও সন্দেহ বাড়িয়েছেন। কেন বললেন তা বোঝার জন্য দলের বিভিন্ন পর্যায়ে পর্যালোচনা চলছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে ওয়ান-ইলেভেনে সবচেয়ে ক্ষতির শিকার বিএনপি। প্রতিটি নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া পর্যন্ত ওয়ান-ইলেভেনের নির্মম রোষানলে পড়েছিলেন।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব অ্যাডভোকেট রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘যখন শুনি আগে সংস্কার পরে নির্বাচন-এ যেন শেখ হাসিনার সেই কথারই প্রতিধ্বনি, আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র। এ ধরনের বক্তব্য অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উপদেষ্টার কাছ থেকে শোভা পায় না।’ সরকারের নিরপেক্ষতার প্রসঙ্গ তুলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো এও শুনছি, সরকারের ভেতরে থেকে কেউ কেউ রাজনৈতিক দল গঠনের চেষ্টা করছেন। তাহলে তো সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণ প্রশ্ন করতেই পারে। যদি এসব কথা আসে, তাহলে গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করা অন্যান্য রাজনৈতিক দল মনে করবে, অন্তর্বর্তী সরকার কোনো ধরনের একটা মাস্টারপ্ল্যানের মধ্যে রয়েছে।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সাংবাদিক মাসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, ‘বিএনপি মহাসচিবের বক্তব্যের সঙ্গে আমি খুবই একমত। যদি সরকারের মধ্যে এমন কেউ থাকেন যারা রাজনীতি করতে চায় অথবা রাজনৈতিক আচরণ করে অথবা রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য রাখেন অথবা পরবর্তীতে নির্বাচন করতে চায় তাহলে তো এই সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে, এটাই স্বাভাবিক। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেছেন, ‘যদি কেউ নির্বাচনে যায়, তাহলে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করে যাবেন।’ এ কথাটাও আমার কাছে অন্য রকম মনে হয়েছে। নির্বাচনের জন্য নানান ছলে বক্তব্য দেবেন, এলাকায় গেলেন, কাজ করলেন অর্থাৎ সে তার এলাকা পুরো গুছিয়ে নির্বাচনের আগে পদত্যাগ করবেন। এটা তো হলো না। তিনি এখন উপদেষ্টা হিসাবে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেবেন শেষ মুহূর্তে পদত্যাগ করবেন-এটা তো বর্তমান সরকারের ধারণাকে সমর্থন করল না।’
মাসুদ কামাল আরও বলেন, ‘কিছুদিন আগে সারজিস বলেছিলেন, নাগরিক কমিটি যেটা আছে, সেটা কোনো রাজনৈতিক দল হবে না। নাগরিক কমিটি রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে থাকবে। এখন আবার আখতার বলছেন, ফেব্রুয়ারিতে তারা দল করবেন। এখন তারা নিজেরাই কনফিউজড কী করবেন? আসলে তারা সুবিধাটা চান কিন্তু কীভাবে চান, সেটা বুঝতে পারছেন না। এখন এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন অথবা উপদেষ্টাদের কেউ কেউ সম্পূর্ণভাবে বর্তমান সরকারের সহায়তা নিয়ে রাজনৈতিক দল হিসাবে নিজেদের গড়ে তুলতে চাচ্ছেন। আমি মনে করি, এই সরকার এরই মধ্যে তাদের নিরপেক্ষতা সন্দেহের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আবার বলছেন, জিয়াবাদ, মুজিববাদ। জিয়াবাদের কথা এই প্রথম শুনলাম। এসব করে কোনো লাভ নেই। আর একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে আড়ালের চেষ্টাও কোনো দিন সফল হবে না। একটি হলো স্বাধীনতার যুদ্ধ, আরেকটি হলো স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান। কাজেই এটা ঠিক করছেন না। সরকারের ঠিক হবে বড় রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে বসা, সব বিষয়ে সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া।’