Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বাংলাদেশের ওপর ট্রাম্প সরকারের প্রভাব

দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ রক্ষাই হবে মূলনীতি

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ২১ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ রক্ষাই হবে মূলনীতি

বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রাম্প প্রশাসনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থ রক্ষাই হবে মূলনীতি-এমন মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, বাংলাদেশ প্রশ্নে প্রথমে যুক্তরাষ্ট্র নিজের স্বার্থকে প্রাধান্য দেবে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশকে যতটুকু সহায়তা দেওয়া দরকার তা দিতে কার্পণ্য করবে না। কারণ বঙ্গোপসাগরকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে দীর্ঘমেয়াদি অনেক হিসাব-নিকাশ। এক্ষেত্রে ভারতকেও সঙ্গে রাখতে চায়। বাংলাদেশের কোনো স্বার্থ সুরক্ষা করতে গিয়ে ভারত যদি নাখোশ হয়, সেক্ষেত্রে ভারতকে অগ্রাধিকার দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তবে অনেকের ধারণা-ট্রাম্প প্রশাসনের বিষয়ে আগের থেকে কোনো ধারণা দেওয়া খুবই কঠিন।

এদিকে ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হবে-এমন প্রচারণায় মুখর একটি গোষ্ঠী। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের নানা অভিমত আছে। তাদের প্রায় সবাই মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি অনুযায়ী এই সময়ে বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন না হওয়ার বিষয়ে মত দিয়েছেন। আবার কেউ বলেছেন নানা হিসাব-নিকাশে ‘ভারতের চোখে’ বাংলাদেশকে দেখার প্রবণতা তৈরি হতে পারে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, মোটা দাগে বলা যায় বাংলাদেশ-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের মধ্যে খুব বেশি পরিবর্তন আশা করছি না। দুই দেশই তাদের নিজস্ব স্বার্থের জন্য পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করে। সেক্ষেত্রে মাার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে দেখতে চায় একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিকভাবে সামনে এগিয়ে যাওয়া দেশ হিসাবে। এই অঞ্চলের অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে বাংলাদেশ ইতিবাচক ভূমিকা রাখুক। এসবই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে প্রাধান্যের বিষয়।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের দিক থেকে প্রাধান্যের বিষয়, সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে টেকসই গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরি, অর্থনীতিকে একটি স্থিতিশীল জায়গায় নেওয়া, দেশের বাইরের বিনিয়োগ আকর্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে। দুই দেশের এই বিষয়গুলোকে মেলালে দেখা যায়, এমন কোনো কিছু ঘটার নেই যে, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশের এই বর্তমান অভিযাত্রাকে নেতিবাচকভাবে দেখবেন। কারণ তারাও একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক, অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশ দেখতে চান। তাদের চাওয়া এবং আমাদের চাওয়া দুটো একই। এসব লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে রেখেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কাজ করবে বলে ধারণা করি।

তিনি বলেন, দুই দিক থেকে কাজ করার সাযুজ্যের জায়গায় এটি অব্যাহত থাকবে। সেটি উভয়ের জন্যই লাভজনক। এটিকে অস্থিতিশীল করা, পরিবর্তন করা সেটি কোনো পক্ষই চান বলে মনে করি না। আমরা তো চাই-ই না, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সেটি চাইবে না। তিনি বলেন, অনেকে ট্রাম্প আসার পর আগের জায়গায় ফেরত যাওয়ার মতো রাজনৈতিক পরিবর্তনের চিন্তা করছেন। আমার কাছে এটি যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয় না। পররাষ্ট্রনীতি মোটা দাগে পরিচালিত হয় জাতীয় স্বার্থের আলোকে। যুক্তিসঙ্গত বিচার-বিশ্লেষণ করেই হয়ে থাকে। আবেগ দ্বারা পরিচালিত হয় না।

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলেন, বাংলাদেশ ও আমেরিকার সম্পর্ক অনেক পুরোনো। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে আসছে বিভিন্ন খাতে। অনেক ক্ষেত্রে তারা প্রথম অবস্থানে। করোনার যে ভ্যাকসিন সেটিও সবচেয়ে বেশি এসেছিল আমেরিকা থেকে। রোহিঙ্গাদের জন্য সাহায্যও সবচেয়ে বেশি দিয়েছে তারা। আর্থসামাজিক খাতে তাদের বিনিয়োগ, সহযোগিতা সবচেয়ে বেশি। গার্মেন্ট সেক্টরেও সিংহভাগ রপ্তানি আমেরিকার। তাদের কাছ থেকে আমরা তুলা কিনছি। তুলার ওপর কোনো শুল্ক, ট্যাক্স নেই।

তিনি বলেন, আমেরিকা এতকিছুর বদলে বাংলাদেশে সব সময় চেয়েছে এখানে গণতন্ত্র থাকবে, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে, সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে, কাউকে বাদ দিয়ে নয়। দেশের জনগণও যেন অবাধে ভোট দিতে পারে। তারা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা চায়। স্বাধীন বিচার বিভাগ চায়। যেখানে মৌলিক অধিকার, মানবাধিকার থাকবে। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে এসব কিছুই ছিল না। একটিও সঠিক নির্বাচন হয়নি। আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্কও ভালো ছিল না।

তিনি বলেন, আমেরিকার দুটি প্রধান বিষয় আছে এখানে। প্রথমত, বাংলাদেশে যেন স্থিতিশীলতা বজায় থাকে। দ্বিতীয়ত, তাদের ইন্দো-প্যাসিফিক নীতি অনুযায়ী, চায়না যেন এখানে প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। আমেরিকা চায় না, সার্ক অঞ্চলের দেশগুলো বেশি আকারে চায়নার দিকে ঝুঁকে পড়ুক। সমুদ্রপথে যত জাহাজ চলাচল করে তাতে যেন একটি দেশ একচেটিয়া বাধা সৃষ্টি করতে না পারে। আমরাও চাই ফ্রি নেভিগেশন। ব্রড সেন্সে বললে আমেরিকার সঙ্গে আমাদের চাওয়ার কোনো দ্বিমত নেই।

সাবেক এ রাষ্ট্রদূত যোগ করেন, আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হয়েছে শেখ হাসিনার সময়ে। ন্যক্কারজনক কাজও হয়েছে। দুজন রাষ্ট্রদূতকে ‘হ্যারাস’ করা হয়েছে। তাদের গাড়িবহরেও আক্রমণ করা হয়েছে। তিন বলেন, ড. ইউনূস আমেরিকায়ও অত্যন্ত সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। আমরা শেখ হাসিনর অন্ধকার যুগ থেকে অনেক এগিয়ে এসেছি। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন যখন হবে তখন আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক আরও উন্নত অবস্থায় যাবে।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক মাসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, মনে করা হয় ট্রাম্প এলে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হবে। এই মনে করার অনেক কারণও আছে। ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে ড. ইউনূসের যে সম্পর্ক হিলারি, ক্লিনটন, ওবামা বা বাইডেনের মাধ্যমে হয়েছে সেটি ট্রাম্পের সঙ্গে আছে বলে আমরা শুনিনি এবং দেখিনি। বরং ট্রাম্পকে আমরা শুনেছি ড. ইউনূসকে ইঙ্গিত করে নানা ব্যঙ্গাত্মক কথাবার্তা বলতে। সে বিবেচনায় ট্রাম্প এলে বাংলাদেশের সঙ্গে আমেরিকার সম্পর্ক খুব ভালো হয়ে যাবে এমন ভাবার কোনো কারণ নেই। দ্বিতীয়ত, ভারতের সঙ্গে বা মোদির সঙ্গে ট্রাম্পের খুব ভালো সম্পর্কের কথা বলা হতো। আবার ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক বর্তমানে এযাবৎকালের সবচেয়ে তলানিতে আছে। এগুলোও এক ধরনের ইকুয়েশন। এসবের বাইরে যে ইকুয়েশনকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিই সেটি হলো, আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি সাধারণত খুব একটা পরিবর্তন হয় না। তার চেয়েও বড় কথা ট্রাম্পের নীতি অনুযায়ী, আমেরিকা ফার্স্ট। তিনি শুধু আমেরিকার কথাই ভাবেন আর কিছু ভাবেন না। সারা দুনিয়ায় আমেরিকার মোড়লপনা করতে হবে এটি তিনি মনে করেন না। তিনি মনে করেন তাৎক্ষণিকভাবে আমেরিকার কিসে লাভ কিসে ক্ষতি সেটি উনিই দেখবেন।

তিনি তার ধারণা থেকে বলেন, আগে যেমন বাংলাদেশ ইস্যু নিয়ে আমেরিকার ভারতের সঙ্গে সরাসরি মতবিরোধ ছিল এখন তা হবে না। এখন ভারতের চোখ দিয়ে আমেরিকার বর্তমান প্রশাসন বাংলাদেশকে দেখতে চাইবে। এটি বাংলাদেশের জন্য আতঙ্কের বিষয়।

তিনি বলেন, ভারতের সেনাপ্রধান বলেছেন, বাংলাদেশে একটি নির্বাচিত সরকার এলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক দ্রুতই পরিবর্তন হবে। তার মানে তারাও চাচ্ছে বাংলাদেশে একটি রাজনৈতিক সরকার আসুক। নির্বাচিত সরকার আসুক। নির্বাচিত সরকার যতক্ষণ পর্যন্ত না আসবে ততক্ষণ ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ট্রাম্প প্রশাসনের কাছ থেকে বা ট্রাম্প প্রশাসনের মাধ্যমে ভারতের কাছ থেকে ভালো কিছু পাবে এমন আশা করার কোনো সুযোগ আছে বলে মনে করি না।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম