অতিরিক্ত র্যাম্পের কারণে প্রকল্পে সুফল মিলবে না
ঢাকার যানজট আরও বাড়বে
নয় হাজার কোটি টাকার ঢাকার এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে অতিরিক্ত র্যাম্প (ওঠানামার রাস্তা) রাখার কারণে এর মূল উদ্দেশ্য ভেস্তে যেতে পারে-এমন আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। তাদের মতে, প্রায় নয় হাজার (৮ হাজার ৯৪০) কোটি টাকার এই প্রকল্প পূর্ণাঙ্গরূপে বাস্তবায়নের পর রাজধানীর ঢাকার যানজট আরও বেড়ে যাবে। নিশ্চিতভাবে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছাবে নগরবাসীর দুর্ভোগ।
বিশেষজ্ঞদের আরও অভিমত-ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের (কাওলা-কুতুবখালী) বিমানবন্দর থেকে হাতিরঝিল পর্যন্ত অংশে অতিরিক্ত র্যাম্পের কারণে বিমানবন্দর সড়ক, বনানী, মহাখালী ও ফার্মগেট এলাকায় যানজট বেড়েছে। এক্সপ্রেসওয়ে ওপর বা নিচ যে কোনো পথেই হতে পারে। তবে এর মূল দর্শন হলো-বাধাহীন দ্রুতবেগে লম্বা দূরুত্বে চলাচল করা। এক্সপ্রেসওয়ে কখনো দুটো শহরকে সংযুক্ত করে। আবার কখনো এক্সপ্রেসওয়ে সড়কের সংযোগ হয় আরেক এক্সপ্রেসওয়ে বা হাইওয়ে সড়কের সঙ্গে। নগর সড়কের সঙ্গে এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগ কোনো বিবেচনায় যৌক্তিক নয়। এজন্য সরকার এখন নির্মাণাধীন শহরে নামার র্যাম্প অপরিহার্য গুটিকয়েক রেখে বাকিগুলো বাদ দিয়ে দিতে পারে। পার্ক, জলাধার ধ্বংস এবং শহরের জন্য যানজট বাড়াবে এমন র্যাম্প করার কোনো মানে হয় না। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটার। আর ঢাকার নগর সড়কের গতিবেগ ৫ কিলোমিটার; যা বিশ্বের সবচেয়ে ধীর গতিবেগের সড়ক। দ্রুতগতির গাড়িগুলো র্যাম্পে এসে আটকে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে ওপরের সড়কে। তখন এক্সপ্রেসওয়ের গতিবেগও কমে যাচ্ছে। ১৯.৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে সর্বোচ্চ ৮ থেকে ১০টি র্যাম্প হতে পারত। কিন্তু তারা এক্সপ্রেসওয়ের দর্শন থেকে সরে গিয়ে টোল আদায় বা বাণিজ্যকে প্রাধান্য দেওয়ায় নকশায় ৩১টি র্যাম্প করা হয়েছে; যার সম্মিলিত দৈর্ঘ্য ২৭ কিলোমিটার। যেটা মূল সড়কের দৈর্ঘ্যরে চেয়েও বেশি। চালু হওয়া কাওলা থেকে ফার্মগেট অংশের ওঠানামার পথে প্রায় তীব্র যানজট থাকছে। সবগুলো র্যাম্প চালু হলে নগরে আরও নতুন নতুন যানজট স্পট তৈরি করবে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সড়ক পরিবহণ ও সেতু উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বুধবার যুগান্তরকে বলেন, প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শেষ পর্যায়ে। ইতোমধ্যে পলাশী সংযোগ সড়ক বাতিলের দাবিতে আন্দোলনও চলছে। আমরা প্রকল্পের সার্বিক দিক পর্যালোচনা করে একটি কমিটি গঠন করার চিন্তা করছি।
এদিকে সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা শহরের যানজটের ভোগান্তি কমাতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পর প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় পরে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে কাওলা থেকে ফার্মগেট পর্যন্ত সাড়ে ১১ কিলোমিটার অংশ চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছ থেকে কাওলা হয়ে রেললাইন ধরে তেজগাঁও, মগবাজার, কমলাপুর দিয়ে যাত্রাবাড়ীর অদূরে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালীতে গিয়ে হাইওয়েতে মিলবে এ সড়ক। গত জুনের মধ্যে প্রকল্পের বাকি কাজ শেষ করার কথা থাকলেও অর্থায়ন জটিলতায় প্রকল্পের কাজ কিছুদিন বন্ধ ছিল। চলতি মাস থেকে মন্থর গতিতে নতুন করে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) মাধ্যমে ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) ভিত্তিক এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্প নির্মাণের চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। ২০১৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর চুক্তি সংশোধন করা হয়। এই প্রকল্পের ৩১টি র্যাম্পের দীর্ঘ ২৭ কিলোমিটার। মূল এক্সপ্রেসওয়ের ২০ কিলোমিটার ও র্যাম্পের দৈর্ঘ্য মিলিয়ে প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৭ কিলোমিটার। প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৯৪০ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক্সপ্রেসওয়ের প্রতি কিলোমিটারের নির্মাণ খরচ হয়েছে প্রায় ১৯১ কোটি টাকা। পিপিপি প্রকল্পে সাধারণ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান পুরো টাকা বিনিয়োগ করে। তবে এ প্রকল্পে বাংলাদেশ সরকারও প্রকল্পের ২৭ শতাংশ বিনিয়োগ করেছে। যার পরিমাণ প্রায় ২ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। প্রকল্প চালু হওয়ার সময় থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায় করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ৩১টি র্যাম্পের মধ্যে ওঠার র্যাম্প ১৫টি এবং নামার র্যাম্প ১৬টি। চালু হওয়া অংশের র্যাম্পের সংখ্যা ১৫টি। সেগুলো হলো-বিমানবন্দরে ২টি, কুড়িলে ৩টি, বনানীতে ৪টি, মহাখালীতে ৩টি, বিজয় সরণিতে ২টি ও ফার্মগেটে ১টি। প্রকল্প চালু হওয়ার সময় থেকে ২৫ বছর পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ের টোল আদায় করবে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান।
অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, তিন থেকে সাড়ে ৩ বছর সময়ে বাস্তবায়নযোগ্য প্রকল্প ১৫ বছরেও শেষ হয়নি। বিদেশি তিন কোম্পানির অর্থনৈতিক জটিলতায় গত বছর প্রায় ১০ মাস বন্ধ থাকার পর ডিসেম্বরে নতুন করে কাজ শুরু হয়েছে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে (পিপিপি) বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের ৫১ শতাংশের মালিকানা ছিল ইতালিয়ান থাই (ইতালথাই) ডেভেলপমেন্ট পাবলিক কোম্পানির। শুরু থেকে এই কোম্পানির অর্থনৈতিক সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন দেখা যায়। শুরুতে ইতালথাই পুরো অংশের মালিকানা থাকলেও পরে ৪৯ শতাংশ চায়নিজ দুটি কোম্পানির কাছে বিক্রি করে দেয়। প্রকল্পে যথানিয়মে তারা অর্থায়ন না করায় আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে তারা হেরে গেছেন। এখন চাইনিজ কোম্পানির তত্ত্বাবধানে প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে।
তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, পিপিপি প্রকল্প হিসাবে যে ধরনের আর্থিক সক্ষমতা থাকা দরকার ছিল ইতালিয়ান কোম্পানির তা ছিল না। যেজন্য শুরু থেকে নানা অজুহাত দেখিয়ে থেমে থেমে কাজ করেছে। এতে করে সময় বেশি লেগেছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিবিএ উপযুক্ত প্রতিষ্ঠান বাছাইয়ে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। একইভাবে পিপিপি প্রকল্প হওয়ায় নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যত্রতত্র র্যাম্প স্থাপন করেছে। যেটা শহরের জন্য নেতিবাচক হয়েছে। শহরকে বাইপাস করার কথা থাকলেও যত্রতত্র র্যাম্প করায় ঢাকা এলিভেটেড প্রকল্প কার্যত ফ্লাইওভারে পরিণত হয়েছে। এ প্রকল্পের র্যাম্প কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে নির্ধারণ এবং জলাভূমি ও পার্ক ধ্বংস করার উদ্যোগ থেকে সরে আসতে আন্দোলন করছেন সংক্ষুব্ধ নগরবাসী, পরিবেশ ও পরিকল্পনাবিদরা।
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা জানায়, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ওঠার র্যাম্পগুলোর মধ্যে রয়েছে-বিমানবন্দর, কুড়িল, আর্মি স্টেডিয়াম, সৈনিক ক্লাব, শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ এভিনিউ, বিজয় সরণি, সোনারগাঁও মোড়, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শনির আখড়া ও পলাশী মোড়। আর নামার র্যাম্পগুলোর মধ্যে রয়েছে-বিমানবন্দর, কুড়িল, সেনানিবাস, আর্মি স্টেডিয়াম, সৈনিক ক্লাব, শহিদ তাজউদ্দীন আহমদ এভিনিউ, সোনারগাঁও রোড, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন, শনির আখড়া, ইন্দিরা রোড এবং পলাশী মোড়।
সরেজমিন গত সপ্তাহের কয়েক কর্মদিবসে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের চালু হওয়া র্যাম্পের পয়েন্টে ঘুরে দেখা গেছে, কর্মব্যস্ত দিনের সকাল, বিকাল ও সন্ধ্যায় তীব্র যানজট থাকে। র্যাম্পের (ওঠা-নামার পথ) যানজট মাড়িয়ে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে উঠতেই অনেক সময় নষ্ট হচ্ছে। কাওলা, ফার্মগেট, বনানী পয়েন্টে নিত্যদিনই র্যাম্পের পয়েন্টে তীব্র যানজট লেগে থাকতে দেখা যায়।
বিশেষজ্ঞ অভিমত : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান যুগান্তরকে বলেন, বিগত সরকারের সময়ে ঢাকার সার্বিক বিষয় পর্যালোচনা না করে ‘ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়’ প্রকল্পের নকশা করা হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নাম দিলেও সেই দর্শনের ছিটেফোঁটা নেই প্রকল্পে। কোনো শহরকে বাইপাস করা অথবা দুটো বড় শহরের মধ্যে দূরত্ব কমানো। যাতে দ্রুত এক শহর থেকে অন্য শহরে যাতায়াত করা যায়। এটা নিচের সড়ক বা উড়ালপথে দুভাবেই করা যায়।
তিনি বলেন, ঢাকায় আমরা যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে দেখছি, এটা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়ন কাজ চলছে। এ ধরনের প্রকল্পের উদ্দেশ্যই থাকে টোল কালেকশন করা। সেই বিবেচনায় তারা এক্সপ্রেসওয়ের দর্শন না মেনে ইচ্ছামতো র্যাম্পের জাল ছড়িয়েছে। সরকার বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে র্যাম্প কমিয়ে আনতে পারে। সেটা করা না হলে ঢাকার যানজট অনেকাংশে বেড়ে যাবে। এক্ষেত্রে ঢাকার নামার র্যাম্প সংখ্যা যৌক্তিক পর্যায়ে কমিয়ে ফেলতে হবে। কেননা ওপরের সড়ক এবং নিচের সড়কের গতির পার্থক্য অনেক বেশি হয়ে যাচ্ছে। বর্তমান ঢাকা শহরের গাড়ির গতিবেগ ৫ কিলোমিটার এবং ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের গতিবেগ ৮০ কিলোমিটার। অর্থাৎ নিচের সড়কের গতিবেগ কম প্রায় ৭৫ কিলোমিটার।
পরিকল্পনাবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের (বিআইপি) সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে অযৌক্তিকভাব র্যাম্প বাড়ানো হয়েছে। শহরের যানজট কমানোর লক্ষ্যে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও যানজট বাড়ছে। এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু হতে পারে না।
তিনি বলেন, হাতিরঝিল থেকে পান্থকুঞ্জ পার্ক হয়ে পলাশী পর্যন্ত সংযোগ সড়কের কারণে হাতিরঝিলের জলাধার এবং পান্থকুঞ্জ পার্ক ধ্বংস হচ্ছে। এটা বন্ধে পরিবেশবিদ, পরিকল্পনাবিদ এবং সচেতন নগরবাসী আন্দোলন করছে। সরকার বিষয়টি নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করার আশ্বাস দিলেও ভেতরে ভেতরে আন্দোলন থেকে সরে যেতে এক ধরনের চাপ দিচ্ছে।
তিনি জানান, বর্তমান সরকারের উচিত পুরো প্রকল্পের কারিগরি মূল্যায়ন করে যেটা শহরের জন্য ইতিবাচক হবে, তা করা। আগের সরকারের ভুল চুক্তিতে শহরের ক্ষতি হলে ওই চুক্তি আর্থিক ক্ষতির কথা বিবেচনা না করে বাতিল করে দেওয়া উচিত অথবা পর্যালোচনা করে ঠিক করা উচিত।
প্রকৌশলী-পরিকল্পনাবিদ মো. নুরুল্লাহ যুগান্তরকে বলেন, ঢাকার সঠিক পরিবহণ পরিকল্পনা নেই। এজন্য যত্রতত্র র্যাম্প তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। যানজট নিরসনের নামে বাস্তবায়নাধীন এই প্রকল্পের কারণে ঢাকার যানজট বাড়বে। বর্তমান সরকার চাইলে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রকল্পটির সার্বিক পর্যালোচনা করে শহরের জন্য ইতিবাচক হয় এমন র্যাম্প রেখে বাকিগুলো কমিয়ে ফেলতে পারে।