Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিশ্লেষকদের অভিমত

নিজেদের স্বার্থেই দ্রুত নির্বাচনে আগ্রহ ভারতের

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ১৮ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

নিজেদের স্বার্থেই দ্রুত নির্বাচনে আগ্রহ ভারতের

বাংলাদেশের গত অন্তত তিনটি ‘বিতর্কিত’ নির্বাচনকে সমর্থন দিয়েছিল ভারত। একতরফা আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে দেশটি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখায়নি সম্প্রতি। ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক যাত্রা নিয়ে ভারত যে আগ্রহ দেখাচ্ছে, সেটা ভালো চিন্তা থেকে নয়, বরং তাদের নিজেদের স্বার্থ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, আমরা নিজেরাও চাই দেশে যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার আসুক। কিন্তু ভারতের চাওয়ার ক্ষেত্রে স্বার্থের হিসাব রয়েছে। কারণ গত ১৫ বছর ভারত বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার প্রতি কোনো সম্মান দেখায়নি।

এখন ভারত নির্বাচন চাচ্ছে কারণ-আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের সঙ্গে তারা যে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে, বর্তমান সরকারের কারণে তা হালে পানি পাচ্ছে না। এছাড়া আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনতে একটি নির্বাচন সাহায্য করবে বলে মনে করছে দেশটি। অন্যদিকে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্র্ক এ যাবৎকালের সবচেয়ে নিম্নপর্যায়ে। ফলে তাদের চেয়ে নির্বাচিত সরকার এলে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করতে সুবিধা হবে বলেও মনে করছে ভারত।

বৃহস্পতিবার ভারতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত এরিক গারসেটি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়ই যত দ্রুত সম্ভব বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক নির্বাচন দেখতে চায়। এটি বাংলাদেশকে তার পরবর্তী অধ্যায়ের সূচনা করতে সাহায্য করতে পারে।

এরিক গারসেটি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়েই একটি শান্তিপূর্ণ, গণতান্ত্রিক দক্ষিণ এশিয়া দেখতে চায় এবং আমরা সেই দৃষ্টিভঙ্গি একে উপরের সঙ্গে শেয়ার করি।

এর আগে ১৩ জানুয়ারি ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল উপেন্দ্র দ্বিবেদী দিল্লিতে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘সম্পর্ক নিয়ে নির্বাচিত সরকারের সময় কথা হওয়া উচিত। দুই দেশের সম্পর্ক তখনই স্বাভাবিক হবে, যখন একটি নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসবে।’ এছাড়া ঢাকায় ভারতের সাবেক হাইকমিশনার বিনা সিক্রি একটি গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, যত দ্রুত সম্ভব সে দেশে নির্বাচন আয়োজনের ওপর ভারত জোর দেবে। শুধু তাই নয়, সে নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হতে হবে এবং তাতে সব দল ও মতাবলম্বীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

এ প্রসঙ্গে সিনিয়র সাংবাদিক মাসুদ কামাল যুগান্তরকে বলেন, গত ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের সঙ্গে ভারতের যে সম্পর্ক ছিল এর মাধ্যমে তারা (ভারত) যে সুবিধা ভোগ করেছে, বর্তমান সরকারের কারণে সেটি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। এই নষ্ট হওয়ার আরেকটা কারণ হলো, তারা যাদের কাছ থেকে সুবিধা পেত তারা বর্তমান সরকারের কারণে উৎখাত হয়ে গেছে। এখন দুই ধরনের সমস্যা হচ্ছে, এতদিনের পাওয়া সুযোগ-সুবিধা তারা পাচ্ছে না এবং যে সরকারের কাছ থেকে পেত সেই সরকার না থাকায় তাদের মধ্যে এক ধরনের বেদনাও কাজ করে। এ কারণে বর্তমান সরকারকে তাদের জন্য এক ধরনের অস্বস্তি বলে মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক এ যাবৎকালের সবচেয়ে নিম্নপর্যায়ে মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যে এত খারাপ সম্পর্ক এর আগে কখনো ছিল না। ফলে ভারতের চাওয়াটা হলো যদি একটি নির্বাচিত সরকার বাংলাদেশে আসে তারা তো কমপক্ষে ৫ বছরের ম্যান্ডেট নিয়ে আসবে। সেই সরকার নিজে থেকেই চেষ্টা করবে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য এবং তাদের প্রত্যাশা-সম্পর্ক বর্তমানে যা আছে, অন্তত এর চেয়ে খারাপ হবে না, ভালো হবে। এ কারণেই তারা বারবার নির্বাচিত সরকারের কথা বলছে। এটা বাংলাদেশে গণতন্ত্র চালু হোক এই ভালো মানুষের চিন্তা থেকে বলছে না। এটা থাকলে বিগত ১৫ বছরেই তারা কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা সেটাকে সম্মান দেখাত। সেটা তো তারা দেখায়নি। বিশেষ করে গত ১০ বছরে তো দেখায়ইনি।

মাসুদ কামাল বলেন, ফলে এখন তারা হঠাৎ করে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার প্রতি বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠবে, এ রকম কোনো গণতান্ত্রিক সদিচ্ছা তাদের মধ্যে আছে বলে আমি মনে করি না। এখানে মূলত তাদের সুবিধা প্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির ব্যাপারটা রয়েছে। তারা মনে করছে, আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবে সেই দলগুলো ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য নিজ দায়িত্বে ভারতের সঙ্গে দেনদরবার করবে। এই আশা থেকেই তারা এটা চাচ্ছে। তবে ভারত যেটাই চায় না কেন আমরা নিজেরা চাই, দেশে যত দ্রুত সম্ভব একটা নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার আসুক।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান যুগান্তরকে বলেন, পৃথিবীর যেকোনো দেশই তার স্বার্থ নিয়ে কাজ করে। যেমন ধরুন, আমেরিকা এক সময় ডিকটেটরদের প্রেট্রোনাইজ করেছে। ষাট, সত্তর আশির দশকে। কারণ তখন তারা মনে করেছে ডিকটেটর থাকা তাদের জন্য ভালো। ডিকটেটর না থাকলে কমিউনিজম মাথাচাড়া দেয়। এখন এসে, বিশেষ করে বাইডেনের সময় তারা ডেমোক্রেসির সঙ্গে আছে। কারণ তারা দেখেছে এটা দিয়ে চায়নার সঙ্গে ফাইট করার ক্ষেত্রে তাদের কাজে লাগে। এখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে স্বার্থ। ভারতের ক্ষেত্রেও তাই। ভারত শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশের নির্বাচন, অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের কথা তারা কখনো বলেনি। তারা স্টেবল বাংলাদেশের কথা বলত। কারণ সেটা তাদের স্বার্থের পক্ষে ছিল। শেখ হাসিনা যদি থাকে, সে তাদের যা যা দিচ্ছিল, যেভাবে দিচ্ছিল, সেটা তো আর কেউ দেবে না। সেজন্য তারা টুঁ শব্দ করেনি।

তিনি আরও বলেন, এখন প্রশ্ন হচ্ছে এখন কেন বলছে? এতে তাদের লাভটা কী? তাদের লাভ হচ্ছে-এই মুহূর্তে যদি নির্বাচনি তৎপরতা শুরু হয়, তখন সারা পৃথিবীর মনোযোগ বাংলাদেশের ওপরে থাকবে। আওয়ামী লীগ তাদের কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে এবং তাদের বাধা দিলে সরকার ও নির্বাচন কমিশনের ওপর চাপ পড়বে। আওয়ামী লীগকে রাজনীতিতে ফিরে আসার জন্য একটা নির্বাচন সাহায্য করবে বলে তারা মনে করছে। এছাড়া যে সরকার বেশিদিন থাকবে না, তার সঙ্গে ডিল করার চেয়ে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে ডিল করাকে ভবিষ্যতের জন্য ভালো মনে করছে। অন্যদিকে শেখ হাসিনার পতনের পর যেহেতু ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষমতায় এসেছেন, তার সঙ্গে ভারতের বেশ পালটাপালটি চাপ শুরু হয়ে গেছে। এই সম্পর্কটা খুব সহজে স্বাভাবিক হয়ে উঠবে বলে তারা বিশ্বাস করছে না। এর চেয়ে একটা নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসলে তার সঙ্গে তারা তুলনামূলকভাবে সহজে কাজ করতে পারবে।

এদিকে বাংলাদেশের নির্বাচন ও গণতন্ত্রের পথে যাত্রা নিয়ে ভারতের বক্তব্যকে তাদের ইতিবাচক বোধোদয় হিসাবে দেখতে চান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. রোবায়েত ফেরদৌস। যুগান্তরকে তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বা কূটনীতিতে কোনো জিনিসই ‘ফিক্সড অ্যান্ড ফাইনাল’ নয়। পরিবর্তিত আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে অবস্থানগুলো পালটে যায়। সেখানে ভারতের একটা উপলব্ধি হয়তো হয়েছে যে, জনগণের সরকার, নির্বাচিত সরকার খুবই দরকার। আসলে দিন শেষে শাসকের সঙ্গে শাসকের নয়, কূটনীতি হচ্ছে জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্ক উন্নয়ন করা। সেই উপলব্ধিটা তাদের (ভারতের) হয়তো এসেছে।

তিনি আরও বলেন, এখানে আসলে দুই পক্ষের স্বার্থের ব্যাপার থাকে। সেই অভিন্ন স্বার্থের বিষয়টা যদি অন্য মাত্রায় নিতে হয়, তাহলে নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ঠিক করতে হবে। আমার মনে হয় ভারতের এখন সেই উপলব্ধি হয়েছে এবং এটাকে আমাদের স্বাগত জানানো উচিত বলেই আমার মনে হয়। কারণ জোড়াতালির নির্বাচন দিয়ে সমর্থন দেওয়ার যে বিষয়টা, সেটা যে ভালো ডিপ্লোমেসি নয়, সেই উপলব্ধি থেকেই তারা এই অবস্থানে সরে এসেছে বলে আমার ধারণা।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম