সর্বদলীয় ঐক্যের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা
সবার মতামতে হবে জুলাই ঘোষণাপত্র
এই সরকারের জন্ম হয়েছে ঐক্যের দ্বারা যতদিন আছি এই একতা নিয়েই থাকতে চাই * বিভিন্ন বিষয়ে যেসব পরামর্শ প্রয়োজন, সেটা আমরা দিয়েছি -সালাহউদ্দিন আহমেদ
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পাঁচ আগস্টকে ঐক্যবদ্ধের প্রতীক মন্তব্য করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ওইদিন পুরো অনুভূতিটাই ছিল একতার অনুভূতি। তাই এখন কিছু করতে হলে সবার মতামতের ভিত্তিতে করতে হবে। যাতে কেউ বলতে না পারে, তুমি অমুক, তুমি তমুক। কাজেই জুলাই ঘোষণাপত্র সবার মতামতের ভিত্তিতে করতে চাই।
বৃহস্পতিবার বিকালে জুলাই ঘোষণাপত্র তৈরির লক্ষ্যে রাজধানীর বেইলি রোডে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সর্বদলীয় ঐক্যের বৈঠকে তিনি এসব এ কথা বলেন। বিকাল ৪টায় শুরু হয়ে সন্ধ্যা ৬টায় বৈঠকটি শেষ হয়।
বৈঠকে উপস্থিত রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের উদ্দেশে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আপনাদের সবার সঙ্গে দেখা হলে, বসতে পারলে আমার কাছে খুব ভালো লাগে, মনে সাহস পাই। প্রাণসঞ্চার হয়। কারণটা পরিষ্কার, এই সরকারের জন্ম হয়েছে ঐক্যের দ্বারা। যতদিন আছি এই একতা নিয়েই থাকতে চাই।
তিনি বলেন, যখন আমরা নিজেরা নিজেরা কাজ করি, হঠাৎ তখন দেখি একা পড়ে গেছি, আশপাশে আপনারা কেউ নেই; তখন একটু দুর্বল অনুভব করি। আবার যখন আপনারা একসঙ্গে হন, মনের মধ্যে সাহস আসে যে, আমরা একতাবদ্ধ আছি। একতাতেই আমাদের জন্ম, একতাতেই শক্তি। আপনাদের সবার সঙ্গে দেখা হলে প্রাণসঞ্চার হয়।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র ইস্যুর অবতারণা প্রসঙ্গে ড. ইউনূস রাজনৈতিক দলের নেতাদের বলেন, মাঝখানে একদিন ছাত্ররা এসে বলল যে, তারা একটা ঘোষণা দেবে, প্রক্লেমেশন করবে। আমাকেও সেখানে থাকতে হবে। আমি বুঝতে চাইলাম, কী প্রক্লেমেশন, তারা বলল। আমি বললাম, এটা হবে না। সেখানে আমারও যাওয়া হবে না, আর তোমাদেরও এটা করা ঠিক হবে না। তোমরা যদি ৫ আগস্টে ফিরে যেতে চাও। সেদিনের পরিপ্রেক্ষিতে যা হয়েছিল, সেটা রিক্রিয়েট করতে হবে। একা এটা করা যাবে না।
সম্প্রতি ছাত্রদের সঙ্গে আলাপচারিতার বিবরণ তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা আরও বলেন, কেউ সেদিন বলেনি যে, তুমি অমুক, আমি অমুক। কাজেই সেটা যদি করতে চাও, সবাইকে নিয়ে করতে হবে। এটা পরিষ্কার, এটা না করলে সেটা ঠিক হবে না। যে একতা দিয়ে তোমরা ৫ আগস্ট সৃষ্টি করেছিলে, সেটার অবমাননা হবে। তারা খুব খুশি হয়নি আমার কথায়। কিন্তু ক্রমেই তারা বুঝল যে, ৫ আগস্ট যদি রিক্রিয়েট করতে হয়, তাহলে এভাবে করতে হবে। সবাইকে একত্রিত করতে হবে। সে কথা থেকেই এ আলাপ শুরু। আজকের আলোচনাটা এটাকে কেন্দ্র করেই হবে। যেখানে আমরা এটা একতাবদ্ধভাবে করতে পারব না, সেখানে এটার উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তাহলে এটার দরকারও নেই আসলে।
গণ-অভ্যুত্থানের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, আপনাদের দেখলে আমার মনে সাহস আসে। সবার মনেই সাহস আসবে। সবাই যদি আমরা একত্র হই, সারা দেশ একেবারে চমকে উঠবে যে হ্যাঁ, আমরা তো জেগে আছি এখনো। আমরা ভোঁতা হয়ে যাইনি, আমাদের অনুভূতি এখনো ভোঁতা হয়নি, চাঙা আছে। জাতি হিসাবে এখনো ঐক্যবদ্ধ আছি। আপনারা দোয়া করবেন, আমি যতদিন আছি, এই একতা নিয়েই থাকব। আমাদের সেই পথেই চলতে হবে। আপনারা আমাদের সেই সাহসটা দেন, যখন আমরা আপনাদের সঙ্গে একত্রে বসি। আজ আবার নিজেকে খুবই সাহসী মনে হচ্ছে। আপনাদের দেখে। ৫ আগস্টের কথা স্মরণ করে যে, আমরা একতাবদ্ধ আছি। কীভাবে সেই একতাকে মানুষের সামনে প্রকাশ করব, এই ৫ আগস্টকে রিক্রিয়েট করব, সেটাই এখন আলাপের বিষয়বস্তু হবে। বৈঠকে অংশ নেওয়ার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান প্রধান উপদেষ্টা।
বিকাল পৌনে ৪টার দিকে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে প্রবেশ করেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল, উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া এবং প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। সর্বদলীয় বৈঠকে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ও সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আজাদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান ও যুগ্ম মহাসচিব আশরাফুল আলম, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বাম গণতান্ত্রিক জোটের সমন্বয়ক ও বাসদের (মার্ক্সবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের নেতা হাসনাত কাইয়ূম, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) সাধারণ সম্পাদক আসাদুজ্জামান ফুয়াদ, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদউদ্দিন মাহমুদ স্বপন। এ ছাড়া জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী ও সদস্য সচিব আখতার হোসেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল ও মুখ্য সংগঠক আবদুল হান্নান মাসউদও বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন-আসিফ নজরুল : বৈঠক শেষে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল বলেন, বৈঠকে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়নের বিষয়ে সবাই একমত হয়েছেন। সবাই বলেছেন-এ ধরনের একটা ঘোষণাপত্র করার দরকার আছে। তবে এখানে অনেক সাজেশন আসছে-মোটাদাগে হলো-ঘোষণাপত্রে সবার অবদান বলতে হবে, ধারাবাহিকতা ঠিকমতো উল্লেখ করতে হবে। ঘোষণাপত্রের রাজনৈতিক ন্যাচার বা লিগ্যাল ন্যাচার কি হবে সেটা স্পষ্ট করতে হবে। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে-এই ঘোষণাপত্র আরও বেশি আলোচনার ভিত্তিতে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পক্ষের যে রাজনৈতিক দল, শক্তি, ছাত্র-জনতার বিভিন্ন ফোরাম সবার মধ্য আলোচনা করে সর্বসম্মতভাবে এটা প্রণয়ন করতে হবে। এটার জন্য যত সময় প্রয়োজন সময় নেওয়া যেতে পারে। তবে এটাও বলছে যাতে অযথা কালবিলম্ব না হয় সেই মতামত দিয়েছে। সবাই ঐকমত্য হয়েছেন আরও নিবিড় পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে এই ধরনের ঘোষণাপত্র হওয়া উচিত।
জুলাই ঘোষণাপত্র ঘিরে যেন ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি না হয় : বৈঠক শেষে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, জুলাই ঘোষণাপত্র ঘিরে যাতে ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যে ফাটল সৃষ্টি না হয়, সেদিকে অন্তর্বর্তী সরকারকে লক্ষ্য রাখতে বলেছেন তারা। একই সঙ্গে সাড়ে ৫ মাস পরে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্রের কোনো প্রয়োজন ছিল কিনা, সে প্রশ্নও করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিএনপির এই নেতা। তিনি বলেন, যদি কোনো রাজনৈতিক দলিল ঐতিহাসিক দলিলে পরিণত হয়, সেই দলিলটাকে বিএনপি অবশ্যই সম্মান করে। কিন্তু সেটা প্রণয়ন করতে গিয়ে যাতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, তাদের পরামর্শ নেওয়া হয়, সেই পরামর্শ দিয়েছে বিএনপি।
বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আজ আমাদের আহ্বান করেছিলেন, আমরা এসেছি, কথা বলেছি। রাষ্ট্র পরিচালনাসহ বিভিন্ন বিষয়ে যেসব পরামর্শ প্রয়োজন, সেটা আমরা দিয়েছি।
বস্তুনিষ্ঠ সত্য ধারণ করে ঘোষণাপত্র প্রস্তুতে আমরা একমত- অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার : বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেছেন, বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল- ঘোষণাপত্রে জাতীয় ঐক্যের চেতনাকে দৃঢ় রাখার প্রয়োজনে জাতীয় নেতাদের মতামত চাওয়া। সেখানে উপস্থিত রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে সুচিন্তিত মতামত দিয়েছেন। বৈঠকে আমাদের মতামত পেশ করেছি। প্রত্যেক রাজনৈতিক দল অভ্যুত্থানের চেতনা এবং জাতীয় ঐক্য ও বস্তুনিষ্ঠ সত্য ধারণ করে জুলাই অভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করার পরামর্শ দিয়েছেন।
হেফাজতে ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব ও জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি জুনাইদ আল হাবিব বলেন, জুলাই বিপ্লবের পর যে বিপ্লবী সরকার গঠন হয়েছে, আমরা গত ৫ মাসে বিপ্লবী কোনো কিছুই দেখিনি? সুতরাং সরকার বিপ্লবী হবে, পরাজিত শক্তির দোসর এবং তাদের সহযোগী যে যেখানেই আছে প্রত্যেককে ধরে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। আগামী নির্বাচনে পরাজিত শক্তির কেউই অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেছেন, বৈঠকের উদ্দেশ্য ছিল জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি ঘোষণাপত্র কিভাবে তৈরি করা যাবে। গণ-অভ্যুত্থানের যে প্রেক্ষাপট, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে জনগণের চেয়ে আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটেছে, গণ-অভ্যুত্থান ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের যেই দিকনির্দেশনা দেয়, এই বিষয়গুলো একটা দলিলে একত্রিত হতে পারে। তবে সেটার একটা পদ্ধতিগত দিক কি হবে? দলিলটা কীভাবে তৈরি হবে? এই বিষয়ে আমরা আমাদের প্রস্তাবগুলো তুলে ধরেছি। আশা করি-সেই অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার কর্মপন্থা তৈরি করবেন।
বৈঠক শেষে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী সাংবাদিকদের জানান, আমরা সবাই একটি ঐকমত্যে পৌঁছেছি যে একটি ঘোষণাপত্র হবে। অতি দ্রুত পর্যাপ্ত পর্যালোচনাসহ এটি দ্রুত প্রকাশ করা হবে। এর মধ্যে কিছু দৃষ্টিভঙ্গিগত এবং শাব্দিক কিছু চয়নে সবার মধ্যে কিছু আলোচনা প্রয়োজন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সদস্য সচিব আরিফ সোহেল বলেন, যদিও আমরা ১৫ জানুয়ারির মধ্যে ঘোষণাপত্র জারি করতে পারব বলে আশা করেছিলাম। কিন্তু পরবর্তীতে সরকারকে সেভাবে ত্বরিত পদক্ষেপ নিতে দেখিনি।
শুধু ঘোষণাপত্র নয়, ১৬ বছরের আন্দোলনের স্বীকৃতি চায় ১২ দলীয় জোট : এদিকে সর্বদলীয় বৈঠকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বিএনপির মিত্র ১২ দলীয় জোটকে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর পুরানা পল্টনের জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টির (জাগপা) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে ঘোষণাপত্রে শুধু জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ৩৬ দিনের সময় নয় বিগত ১৬ বছরের আন্দোলন ও সংগ্রামের ত্যাগের স্বীকৃতি দাবি করেছে ১২ দলীয় জোট। একই সঙ্গে গণ-অভ্যুত্থানের ‘প্রোক্লেমেশন’ নয়, গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে একটা ‘ডিক্লারেশন’ বা ‘ঘোষণা’ আসতে পারে বলেও জোট নেতারা মনে করেন। জোটের পক্ষে এসব দাবি তুলে ধরেন সমন্বয়ক ও বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা। লিখিত বক্তব্য তিনি বলেন, সাংবিধানিক প্রশ্নে আমাদের স্পষ্ট অবস্থান, ১২ দলীয় জোটসহ বিগত ১৬ বছরে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন ও সংগ্রামে যুক্ত রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ঘোষণাপত্র বাস্তবায়ন করতে হবে।