সরবরাহ ঋণে বাড়ছে চাপ কমছে বায়ার্স ক্রেডিট
ঋণের বিপরীতে ৩ শতাংশ বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে এবং ডলার কিনতে হচ্ছে ৩৬ টাকা বেশি দিয়ে এতে ডলারের পাশাপাশি টাকার ওপর চাপ বাড়ছে
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৪ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সরকারি খাতের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট বা সরবরাহ ঋণের চাপ বাড়ছে, বেসরকারি খাতে বায়ার্স ক্রেডিটের চাপ কমছে। সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে নেওয়া সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের চুক্তি অনুযায়ী এখনো বিভিন্ন উপকরণ সরবরাহ করা হচ্ছে। পরিশোধ কমে গেছে। ফলে এর স্থিতি এখন বেড়ে যাচ্ছে।
এদিকে বেসরকারি খাতের আমদানিতে নেওয়া বায়ার্স ক্রেডিটের (আমদানিকারক পণ্যের বিপরীতে নেওয়া ঋণ) সরবরাহ যেমন কমেছে, তেমনই পরিশোধ বেড়েছে। এতে এ ঋণের স্থিতি কমেছে। দুই ধরনের ঋণের সুদের হারই বাজারভিত্তিক। ফলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সুদের হার বাড়ায় এসব ঋণের বিপরীতে বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে।
সূত্র জানায়, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নেওয়া হয় মূলত সরকারি খাতে। সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে যন্ত্রপাতি বা কাঁচামাল আমদানি করে। এর বিপরীতে সরকার থেকে নগদ কোনো বৈদেশিক মুদ্রা দেওয়া হয় না। উপকরণের মূল্য সংশ্লিষ্ট দেশ সরকারকে ঋণ হিসাবে সরবরাহ করে। চুক্তি অনুযায়ী বিভিন্ন দফায় এসব ঋণ শোধ করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের সরবরাহ বেড়েছে। কিন্তু পরিশোধ কমেছে। সরকারি খাতের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের যন্ত্রপাতিসহ জ্বালানি তেল ও সার আমদানি হচ্ছে সরবরাহ ঋণে।
বিগত সরকার যেসব বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, সেগুলোর বিপরীতে বিভিন্ন ধরনের উপকরণ আমদানি করতে গিয়ে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের পরিমাণ বেড়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও উন্নয়ন প্রকল্পের বিপরীতে বিভিন্ন উপকরণের জোগান এখন বন্ধ হয়নি। সেগুলো এখনো আসছে। এসব কারণে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতিও বেড়ে যাচ্ছে
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতি ছিল ১৫ কোটি ১২ লাখ ডলার। ২০২৩ সালের জুনে তা কমে দাঁড়ায় ১২ কোটি ২৭ লাখ ডলারে। একই বছরের সেপ্টেম্বরে আবার বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ কোটি ১৭ লাখ ডলারে। ওই বছরের ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ কোটি ৪০ লাখ ডলারে। গত বছরের মার্চে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতি আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৭ কোটি ৫২ লাখ ডলারে। জুনে তা আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৮ কোটি ৭৯ লাখ ডলারে। গত অক্টোবরে আরও বেড়ে দাঁড়ায় ১৯ কোটি ২৪ লাখ ডলারে, যা মোট ঋণের দশমিক ২০ শতাংশ।
সূত্র জানায়, ডলারের সংকটের কারণে এর আগে সরকারি খাতের ঋণ পরিশোধ ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ কারণে ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। সরকারি খাতে আমদানি করা জ্বালানি তেল ও সার আমদানির অনেক দেনা পরিশোধ স্থগিত করা হয়েছিল। এ কারণে এসব পণ্য সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার হুমকিও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংক খাতের মাধ্যমে টাকা পাচার যেমন বহুলাংশে কমেছে, তেমনই ব্যাংক খাতের দুর্নীতিও কমেছে। এর বিপরীতে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে। এসব কারণে বাজারে ডলারের প্রবাহ বাড়ায় সরকারের ঋণ পরিশোধও বেড়েছে। গত আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকার প্রায় ৫০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ করেছে। এছাড়া নিয়মিত আমদানির দায়ও পরিশোধ করে যাচ্ছে। কিন্তু এরপরও সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের প্রবাহ কমছে না। কারণ, নতুন করে এ ঋণে জ্বালানি তেলসহ সার আমদানি করা হচ্ছে।
এদিকে বেসরকারি খাতে বায়ার্স ক্রেডিটের প্রবাহ কমছে। এর কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি খাতে এখন যেসব আমদানি হচ্ছে, সেগুলোর দেনা নিয়মিত শোধ করা হচ্ছে। বকেয়া থাকছে না। ফলে এসব ঋণের স্থিতি বাড়ছে না। আগের ঋণও নিয়মিতভাবে পরিশোধের কারণে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের স্থিতি কমে যাচ্ছে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বায়ার্র্স ক্রেডিটের স্থিতি ছিল ১ হাজার ১৯ কোটি ডলার। ২০২৩ সালের জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৭৭০ কোটি ডলারে। একই বছরের ডিসেম্বরে তা আরও কমে দাঁড়ায় ৬২৪ কোটি ১২ লাখ ডলারে। গত বছরের মার্চে আরও কমে দাঁড়ায় ৫৬৯ কোটি ডলারে, জুনে ৫৭৬ কোটি ডলার এবং অক্টোবরে তা আরও কমে হয় ৫৭০ কোটি ডলার।
এদিকে ২০২২ সালের বৈশ্বিক মন্দার পর থেকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৈদেশিক ঋণের সুদের হার বেড়েছে। সেই বাড়তি ধারা এখনো অব্যাহত রয়েছে। করোনার সময় বৈদেশিক ঋণের সুদের হার ছিল ৪ থেকে ৬ শতাংশ। বৈশ্বিক মন্দার পর তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ থেকে ৯ শতাংশে। এখন গড়ে ৩ শতাংশ বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আরও বেশি। সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট ও বায়ার্স ক্রেডিটের অন্যতম শর্ত হচ্ছে এসব ঋণ যখন পরিশোধ করা হবে, তখন ঋণের সুদ যা থাকবে, ওই হারে পরিশোধ করতে হবে। একই সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার ঋণ পরিশোধের সময় যা থাকবে, সে হিসাবেই পরিশোধ করতে হবে। আলোচ্য সময়ে ঋণের সুদহার বাড়ায় এখন বাড়তি অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। একই সঙ্গে আলোচ্য সময়ে ডলারের দাম ৮৬ থেকে বেড়ে ১২২ টাকা হয়েছে। ফলে প্রতি ডলারে এখন ৩৬ টাকা বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। সুদ ও বাড়তি দামে ডলার কেনায় ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে এখন ডলারের পাশাপাশি টাকার ওপরও চাপ বাড়ছে। এ কারণে ঋণের খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এতে পণ্যের দাম বেশি পড়ছে। বাজারেও এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পণ্যের দাম বেড়ে যাচ্ছে।