বাস্তবায়ন হতে পারে চলতি বছর
এবার ঘরে বসেই পাসপোর্ট
স্মার্টফোনেই হবে সবকিছু। ছবি, ফিঙ্গার প্রিন্ট (আঙ্গুলের ছাপ), আইরিশ (চোখের মণি)-সহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দেওয়া যাবে ঘরে বসে। সব হবে বিশেষ অনলাইন অ্যাপের মাধ্যমে। এরপর যাচাই শেষে প্রিন্ট হবে পাসপোর্ট। এমনকি যথাসময়ে তা পৌঁছে দেওয়া হবে সংশ্লিষ্ট আবেদনকারীর ঠিকানায়। বিদ্যমান পাসপোর্ট ভোগান্তি নিরসনে এমন এক সমন্বিত ডিজিটাল উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এজন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পাসপোর্ট অধিদপ্তরকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি বছরেই এমন স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব হতে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
অ্যাপেই সবকিছু : বর্তমানে পাসপোর্ট পেতে হলে আবেদনকারীকে অফিসে গিয়ে ছবি ও ফিঙ্গার প্রিন্ট দিতে হয়। এ সময় বিশেষ যন্ত্রের সাহায্যে নেওয়া হয় আইরিশ (চোখের মণির ছবি)। তবে নতুন পদ্ধতিতে এর সবকিছুই ঘরে বসে স্মার্টফোনে করা যাবে। এজন্য আবেদনরকারীকে অ্যাপস স্টোর থেকে একটি বিশেষ অ্যাপ ডাউনলোড করে নিতে হবে।
পাসপোর্ট অধিদপ্তরের সিস্টেম অ্যানালিস্ট নজরুল ইসলাম ভুঁইয়া যুগান্তরকে বলেন, এখন স্মার্টফোনে ফেস লক এবং ফিঙ্গার প্রিন্ট লক সুবিধা রয়েছে। পাসপোর্ট আবেদনের জন্য একই পদ্ধতিতে বায়োমেট্রিক তথ্য নেওয়া হবে। এতে আবেদনকারীদের পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না। সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে আবেদনের সঙ্গে ছবি, আঙুলের ছাপ, আইরিশসহ পূর্ণাঙ্গ বায়ো এনরোলমেন্ট সম্পন্ন হবে অনলাইনে। এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট মোবাইল ফোনের ক্যামেরায় স্ক্যান করে আবেদনের সঙ্গে জুড়ে দিতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় নতুন এবং নবায়ন (রি-ইস্যু) সব ধরনের পাসপোর্ট আবেদন ঘরে বসেই করা যাবে।
বৈঠক : উল্লিখিত উদ্যোগ বাস্তবায়নে সরকারের উচ্চপর্যায়ে এ বিষয়ে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। খোদ প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাসপোর্ট অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ডেকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। ৪ ডিসেম্বর প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা ও স্বরাষ্ট্র সচিব ছাড়াও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল নূরুল আনোয়ার, প্রকল্প পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুস ছালাম, অতিরিক্ত মহাপরিচালক সেলিনা বানুসহ পাসপোর্ট অধিদপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র জানায়, নতুন পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এজন্য ই-পাসপোর্ট বাস্তবায়নকারী সংস্থা জার্মান কোম্পানি ভেরিডোজের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ এবং অনুমোদন থেকে শুরু প্রযুক্তিগত বিভিন্ন বিষয় ক্ষতিয়ে দেখা হচ্ছে।
বদলে যাবে সেবা : উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে পাসপোর্ট সেবার বিদ্যমান চিত্র আমূল বদলে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে প্রচলিত পুলিশ ভেরিফিকেশন একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। তাই গণহারে পুলিশি যাচাই ব্যবস্থা তুলে দেওয়া হতে পারে। তবে অপরাধীদের পাসপোর্ট পাওয়া ঠেকাতে পুলিশের অপরাধ তথ্যভান্ডারের (সিডিএমএস) সঙ্গে পাসপোর্টের সর্ভার সংযুক্তির চিন্তা করা হচ্ছে। এছাড়া পাসপোর্ট প্রাপ্তির পর কেউ অপরাধ করলে তাকে ইমিগ্রেশন চেকপোস্টেই ঠেকিয়ে দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পাসপোর্ট কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, পাসপোর্ট একটি নাগরিক অধিকার। জাতীয় পরিচয়পত্র থাকলেই দেশের যে কোনো নাগরিকের শর্তহীনভাবে পাসপোর্ট পাওয়ার অধিকার রয়েছে। কিন্তু পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে পাসপোর্ট প্রত্যাশীদের ব্যাপকভাবে হয়রানি করা হয়। এতে পাসপোর্ট সেবায় ভোগান্তির মাত্রা বহুগুণ বাড়ে। একটি উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ধরুন কেউ অপরাধী। ভেরিফিকেশনে তার পাসপোর্ট আবেদন আটকে দেওয়া হলো; কিন্তু যারা ইতোমধ্যে পাসপোর্ট পেয়েছেন, তারা জীবনে আর কোনোদিন অপরাধ করবেন না-এমন গ্যারান্টি কি আছে? আবার কেউ খুনের মতো বড় অপরাধ করলেও তাৎক্ষণিক তার পাসপোর্ট জব্দ করা হয় না। অথচ পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য সাধারণ আবেদনকারীদের দীর্ঘসময় অপেক্ষায় রাখা হয়। এছাড়া মনগড়া ডকুমেন্ট সংগ্রহ, অহেতুক কলক্ষেপণসহ পুলিশের বিরুদ্ধে ঘুস বাণিজ্যের ভূরিভূরি অভিযোগ রয়েছে।
এজেন্ট নিয়োগ : বর্তমানে পাসপোর্ট আবেদনের জটিল ফরম পূরণে অনেকেই দালালের দ্বারস্থ হন। বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের আবেদনকারীদের দালালনির্ভরতা ৯৫ ভাগের বেশি। এ সুযোগে একশ্রেণির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী দালালচক্রের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিশেষ সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন। এমন বাস্তবতায় ফরম পূরণে এজেন্ট নিয়োগের কথা ভাবা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে ফরম পূরণের জন্য দালালরা ইচ্ছামতো অর্থ আদায় করে। একেকটি ফরমে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা আদায় করা হয়। কিন্তু এজেন্ট লাইসেন্স দেওয়া হলে নির্ধারিত ফির বিনিময়ে ফরম পূরণ করা যাবে। অতিরিক্ত অর্থ দাবি করলে বাতিল করা হবে লাইসেন্স।
তবে এজেন্ট নিয়োগের এ উদ্যোগ ইতোমধ্যে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছে। কারণ, এর আগে হাসিনা সরকারের আমলেও একবার এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। কিন্তু ব্যাপক সমালোচনার মুখে শেষ পর্যন্ত তৎকালীন সরকার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফরম পূরণে এজেন্ট নিয়োগের উদ্যোগ কোনোভাবেই যৌক্তি হবে না। এতে দালালনির্ভরতা বরং আরও বাড়বে। এমনকি পুরো প্রক্রিয়া দালালদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়ার শঙ্কা রয়েছে। এছাড়া এজেন্ট লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ এবং কমিশন বাণিজ্যের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে।
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এজেন্ট নিয়োগের বদলে আবেদন ফরম সহজ করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে পাসপোর্ট ফরম কিউআর কোডে রূপান্তর করা যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে স্মার্টফোনের ক্যামেরায় কোড স্ক্যান করলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে ফরম পূরণ হয়ে যাবে। এতে স্বল্প বিনিয়োগে কার্যকর ফল পাওয়া যাবে।
ডাকযোগে পাসপোর্ট : ভোগান্তি লাঘবে আবেদনকারীর ঠিকানায় ডাকযোগে পাসপোর্ট পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ডাক বিভাগের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে পাসপোর্ট অধিদপ্তর। এখন উভয় পক্ষের মধ্যে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হলেই পাসপোর্ট বুকলেট ডাকযোগে পাঠানো শুরু হবে। তখন আর পাসপোর্ট অফিসে যাওয়ার প্রয়োজন হবে না।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে আবেদনকারীকে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসে হাজির হয়ে বুকলেট বুঝে নিতে হয়। এতে সময়ক্ষেপণ হয়। এছাড়া ডেলিভারি লাইনে দাঁড়িয়ে দীর্ঘসময় অপেক্ষা করতে হয়। এমনকি অহেতুক পাসপোর্ট আটকে রেখে দিনের পর দিন ঘোরানোর ভূরিভূরি নজির রয়েছে।
কমবে প্রবাসীদের ফি : বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশি নাগরিকদের জন্য পাসপোর্ট ফি অর্ধেকে নামিয়ে আনার চিন্তা করছে সরকার। রেমিটেন্স যোদ্ধা হিসাবে দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখায় প্রবাসীদের এমন সুযোগ দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে। এক্ষেত্রে প্রবাসী শ্রমিকদের অগ্রাধিকার দেওয়া হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আপাতত সৌদি আরব, মালয়েশিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে অবস্থানরত প্রবাসী শ্রমিকদের পাসপোর্ট নবায়ন ফি অর্ধেকে নামিয়ে আনা হতে পারে। পরে পর্যায়ক্রমে অন্য দেশগুলোয় এ সুযোগ দেওয়া হবে। এছাড়া বিএমইইটির তথ্যভান্ডারে যুক্ত বিদেশ গমনেচ্ছুদেরও এ ধরনের সুযোগ দেওয়া যায় কি না, এ আলোচনা চলছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ই-পাসপোর্ট ও স্বয়ংক্রিয় বর্ডার ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নুরুস ছালাম রোববার যুগান্তরকে বলেন, দুটি বিষয়ে একসঙ্গে কাজ চলছে। প্রথমত, ডাকযোগে পাসপোর্ট সংশ্লিষ্টদের ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়া এবং দ্বিতীয় হচ্ছে স্মার্টফোনের মাধ্যমে বায়ো এনরোলমেন্ট সম্পন্ন করা। ব্যক্তিগতভাবে আমার ইচ্ছা চলতি বছরের মধ্যেই এ দুটি উদ্যোগের বাস্তবায়ন। এ দুটি পদ্ধতি বাস্তবায়ন হলে পাসপোর্ট সেবায় আমূল পরিবর্তন আসবে।