ব্যবসায়ী নেতাদের প্রতিক্রিয়া
অর্থনীতি ধ্বংস করতেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব
অর্থনীতিকে ধ্বংস করতেই গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। পেট্রোবাংলার প্রস্তাব কার্যকর হলে দেশে শিল্প সম্প্রসারণ হবে না। শিল্প বন্ধ হয়ে গিয়ে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করতে পারে, বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে এ ধরনের প্রস্তাব দেশবিরোধী চক্রান্তের অংশ। এ প্রস্তাব নতুন শিল্পের সঙ্গে পুরোনো শিল্পের বৈষম্য তৈরি করবে। মঙ্গলবার পেট্রোবাংলার গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রক্রিয়ায় ব্যবসায়ী নেতারা যুগান্তরকে এসব কথা বলেছেন।
শিল্পমালিকরা বলছে, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের কথা বলে গত ২ বছরে গ্যাসের দাম ১৫০ থেকে ১৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়। কিন্তু শিল্পমালিকরা নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস পাননি। গ্যাসের বদলে বাতাসের দাম দিতে হয়েছে। এখন আবার কাউকে কিছু না জানিয়ে, অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা না করে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত শিল্পের জন্য আত্মঘাতী। এ প্রস্তাব কার্যকর হলে দেশে শিল্পায়ন হবে না। নতুন শিল্প না হলে কর্মসংস্থানও হবে না। অন্তর্বর্তী সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে একটি চক্র এ ধরনের একের পর এক প্রস্তাব দিয়ে যাচ্ছে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল বলেন, আমরা আশা করেছিলাম অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর জ্বালানি খাতে নৈরাজ্য কমবে, গ্যাসের দাম পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনা হবে। কিন্তু গণমাধ্যমে জানতে পারলাম পেট্রোবাংলা গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে। কার সঙ্গে আলোচনা করে দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হলো, এই দাম বৃদ্ধির ভার শিল্প সইতে পারবে কিনা তা পর্যালোচনা করা হয়েছে বলে আমি মনে করি না। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্প ধ্বংস হয়ে যাবে। হয়তো এক সময় প্রচুর গ্যাস থাকবে, কিন্তু সেই গ্যাস ব্যবহারের জন্য শিল্প থাকবে না। এমনিতেই ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ও ফেব্রিকের মূল্য হ্রাসের কারণে টেক্সটাইল শিল্প অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে আছে।
তিনি আরও বলেন, আমদানি করা এলএনজি দেশীয় গ্যাসের মিশ্রণের পরে দাম কত হতে পারে, সেই হিসাব ব্যবসায়ীরা করতে জানে। তাই দাম বৃদ্ধির বিষয়টি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে করা উচিত। এ প্রস্তাবের পেছনে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চক্রান্ত থাকতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
রাসেল বলেন, টেক্সটাইল খাত সবচেয়ে বেশি ক্যাপটিভ পাওয়ার জেনারেশন করে থাকে। তাই গ্যাসের দাম নির্ধারণের আগে অবশ্যই টেক্সটাইল খাতসহ অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে দাম নির্ধারণ করা উচিত। গ্যাসের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে তিতাসের মুনাফা যোগ করার প্রয়োজনীয়তা নেই। কারণ তিতাস সেবাদাতা সংস্থা। এই প্রতিষ্ঠানের মুনাফা করার দরকার কী? কারও সঙ্গে আলোচনা না করে হঠাৎ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব এই সরকারের সঙ্গে যায় না।
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রির (বিসিআই) সভাপতি আনোয়ার উল আলম চৌধুরী পারভেজ বলেন, শুধু সস্তা শ্রম ও গ্যাসের কারণে বাংলাদেশে শিল্পায়ন হয়েছিল। গত কয়েক বছরে দুটোর খরচই অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। এখন আবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। গ্যাসের এত উচ্চমূল্য দিয়ে শিল্প লাভজনক করা সম্ভব নয়। কোনো উদ্যোক্তাই আগামী দিনে দেশে নতুন শিল্প স্থাপন করার সাহস দেখাবে না বলে মনে হয়। ফলশ্রুতিতে কর্মসংস্থানও হবে না। অবশ্য সরকারের একটা লাভ হবে, তা হলো-শিল্প স্থাপন না হলে সরকারকে কম গ্যাস আমদানি করতে হবে। তাই সরকারকে এখন ভাবতে হবে উৎপাদনমুখী দেশ থেকে ট্রেডিং (আমদানি) নির্ভর দেশ হলে এত বিপুলসংখ্যক জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থান হবে কোত্থেকে। তিনি আরও বলেন, সব সময় পেট্রোবাংলা আর বিইআরসি নিজেরা নিজেরা মিলে গ্যাসের দাম বাড়ায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে মনে হয়। আওয়ামী লীগ শাসনামলে এই প্রবণতা দেখা গেছে, এবার অন্তর্বর্তী সরকারের আমলেও সেটি দেখলাম। এ সিদ্ধান্ত দেশের অর্থনীতির জন্য কখনোই মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না।
বাংলাদেশ নিটপণ্য প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পেট্রোবাংলা কিসের ভিত্তিতে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে তা বোধগম্য নয়। আন্তর্জাতিক বাজারে কী গ্যাসের দাম বেড়েছে। এ ধরনের প্রস্তাব শিল্পায়ন পরিপন্থি। কেননা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, নতুন সংযোগের ক্ষেত্রে বেশি দামে গ্যাস কিনতে হবে। এ সিদ্ধান্তের ফলে নতুন উদ্যোক্তারা শিল্প করতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। আর যারা ইতোমধ্যেই শিল্প করে ফেলেছেন তারা পুরোনোদের সঙ্গে অসম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে তা বন্ধ হয়ে যাবে। এ প্রস্তাব কার্যকর হলে নতুন উদ্যোক্তারা শিল্পায়নে আগ্রহী হবেন না, পুরোনোরাও নতুন করে শিল্প সম্প্রসারণে যাবেন না। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের খুঁজে বের করা উচিত, কেন এবং কারা এ ধরনের প্রস্তাব দিয়েছে। আগের সরকার ঘনিষ্ঠরা কমিশন বাণিজ্য করতে গ্যাস উত্তোলনের পরিবর্তে আমদানিকে গুরুত্ব দিয়েছে। এ সরকার তো কমিশন বাণিজ্য করে না। তাহলে কেন গ্যাসের দাম বাড়াতে হবে।
বিজিএমইএর সাবেক জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আব্দুল্লাহ হিল রাকিব বলেন, রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক শিল্প আইসিইউতে আছে, প্রতিনিয়ত রক্তক্ষরণ হচ্ছে। শ্রমিক খরচ ও জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পেয়ে উৎপাদন খরচ ৫০ শতাংশ বেড়েছে, পক্ষান্তরে ক্রেতারা পোশাকের দাম বাড়ায়নি। এ অবস্থায় টিকতে না পেরে গত কয়েক মাসে অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। এর প্রেক্ষিতে শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দেয়। এই মুহূর্তে কিসের বিবেচনায় সরকার আবার গ্যাসের দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে তা বোধগম্য নয়। একটি সরকারের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও অর্থনৈতিক রোডম্যাপ কী হবে তা নির্ধারিত হয় গৃহীত পলিসির মাধ্যমে। গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে শিল্পের ওপর এটি যেমন বিরূপ প্রভাব ফেলবে, তেমনি সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতাকে আরও সংকুচিত করবে। এ ধরনের পলিসি দিয়ে সাধারণ মানুষ ও শিল্পের উন্নয়ন কখনোই সম্ভব নয়। সোমবার গ্যাসের দাম বাড়াতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) কাছে প্রস্তাব দিয়েছে পেট্রোবাংলা। এতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৩০ টাকা ৭৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।