ফিরে দেখা ২০২৪
হাইকোর্টের রায় থেকেই জুলাই-আগস্ট বিপ্লব

আলমগীর মিয়া
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

২০২৪ সালজুড়ে আলোচনায় ছিলেন সর্বোচ্চ আদালত (সুপ্রিম কোর্ট)। এ বছর সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি নিয়ে সর্বোচ্চ আদালতের রায়, প্রধান বিচারপতিসহ ৬ বিচারপতির পদত্যাগ ও অন্তর্বর্তী সরকারকে সুপ্রিমকোর্টের বৈধতা নিয়ে সরব ছিলেন সুপ্রিমকোর্ট। এছাড়া, পঞ্চদশ সংশোধনীর দুটি ধারা অবৈধ ঘোষণা, ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সব আসামি খালাস ও ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের ঘটনা ছিল আলোচনায়। দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালান মামলা নিয়ে রায়, হাইকোর্টের ১২ বিচারপতিকে বিচারকাজ থেকে বিরত রাখা ও খালেদা জিয়া-তারেক রহমানকে বিভিন্ন মামলা থেকে অব্যাহতির ঘটনাও ঘটে এ বছর।
এদিকে নতুন প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগ সংস্কারের যেসব উদ্যোগ নিয়েছেন তা জনগণকে আশাবাদী করে তুলেছে।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগে কোটা পদ্ধতি বহাল করে উচ্চ আদালতের রায় থেকেই জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সূত্রপাত। রায় প্রত্যাখ্যান করে কোটা পদ্ধতি বাতিল চেয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনেই আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। টানা ৩৬ দিনের আন্দোলনে পদত্যাগ করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান ভারতে।
আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের পরে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন নানা কারণে উত্তপ্ত হয়ে উঠে। এর রেশ সুপ্রিমকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। রাজনৈতিক অঙ্গনের মতোই সুপ্রিমকোর্ট ছিল সরগরম। দেশের সব ক্রান্তিলগ্নে বারবরই সুপ্রিমকোর্ট ঐতিহাসিক ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। এবারও এর ব্যতিক্রম ছিল না। তবে কেউ কেউ সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকার সমালোচনাও করেছেন। তারা মনে করেন, বিচার বিভাগ নিয়ে জনগণের প্রত্যাশার জায়গা এখনও পূরণ হয়নি। মিথ্যা মামলায় হয়রানি এখনও চলছে, বন্ধ রয়েছে আগাম জামিন।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন যুগান্তরকে বলেন, অধিকার সুরক্ষা বা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্টের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকে। যেহেতু সুপ্রিমকোর্ট আমাদের শেষ আশ্রয়স্থল। ৫ আগস্টের আগের কথা যদি বলি, তাহলে কোটা নিয়ে আপিল বিভাগের যে রায় এসেছে-তা অনেক পরে হয়েছে। চূড়ান্ত রায়টা যখন হয়েছে, ততক্ষণে দেশে অনেক কিছু হয়ে গেছে। বিশেষ করে অনেক প্রাণ ঝরে গেল। নতুন প্রধান বিচারপতি আসলেন। তিনি বলেছেন, অনেক কিছু ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করবেন। শপথের সময় তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতি, সিন্ডিকেট নিয়ে যেসব অভিযোগ এসেছে সেসব বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। সুপ্রিমকোর্টের আলাদা সচিবালয় গঠনের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়া খুবই প্রশংসনীয় বলে মনে করেন তিনি।
সারা হোসেন বলেন, সংশয়ের ব্যাপার হচ্ছে, ন্যায়বিচার হচ্ছে কিনা। এখন আগাম জামিন দেওয়া বন্ধ রয়েছে। ৫ আগস্টের আগে দেখেছিলাম, গণহারে মানুষ আটক হতো, আবার গণহারে জামিন নাকচ হতো। এখন জুলাইয়ের ঘটনা নিয়ে সবার বিরুদ্ধে যেসব মামলা হচ্ছে, তা সঠিকভাবে হচ্ছে না। জামিন নাকচের বিষয়টি চিন্তার বিষয়। তিনি বলেন, আমাদের উপমহাদেশজুড়ে একটা ইতিহাস আছে, অনেক মিথ্যা মামলা হয় শুধু হয়রানির জন্য। তিনি বলেন, শুধু যে ৫ আগস্টের পরে হচ্ছে তা না, এটা আগেও ছিল। এ বিষয়ে আদালত থেকে পদক্ষেপ দেখছি না। এসব হয়রানি বন্ধে উচ্চপর্যায়ে উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
সুপ্রিমকোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, সুপ্রিমকোর্টের জন্য আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বছর ছিল ২০২৪। এ বছর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এখানে নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে ক্রান্তিলগ্নে সুপ্রিমকোর্টের অবস্থান আগের চেয়ে কত উন্নতি হয়েছে, তা গবেষণার বিষয়। তবে প্রত্যাশার জায়গায় বড় একটা শূন্যতা রয়ে গেছে। যেমন মিথ্যা মামলায় হয়রানি এখনও চলছে। আগাম জামিনও বন্ধ। আইন করে বিচারপতি নিয়োগের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু আইন করার আগেই বিচারপতি নিয়োগ হয়েছে। তিনি বলেন, আমাদের খারাপ দৃষ্টান্ত রয়েছে। বিচারপতিরা স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন কিনা-এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সুপ্রিমকোর্ট ঘেরাও করে বিচারপতিদের পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। ২০২৪ সালে সুপ্রিমকোর্ট জনগণের প্রত্যাশা পূরণ করতে পেরেছে বলে মনে হয় না। মনজলি মোরসেদ বলেন, সুপ্রিমকোর্টের আলাদা সচিবালয়সহ বেশকিছু সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছেন প্রধান বিচারপতি। আমরা এর সফলতা কামনা করি।
হাইকোর্টে কোটা পদ্ধতি বহাল : সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে ৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালের ৪ অক্টোবর পরিপত্র জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ পরিপত্রের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ২০২১ সালে রিট করেন চাকরিপ্রত্যাশী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তান অহিদুল ইসলামসহ সাতজন। রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০২১ সালের ৬ ডিসেম্বর হাইকোর্ট রুল দেন। চূড়ান্ত শুনানি শেষে রুল অ্যাবসলিউট (যথাযথ) ঘোষণা করে ৫ জুন রায় দেন হাইকোর্ট। ফলে সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি বহাল হয়। হাইকোর্টের রায় স্থগিত চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগে আবেদন করে, যা আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত হয়ে ৪ জুলাই আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে শুনানির জন্য ওঠে।
আন্দোলন করে কি রায় পরিবর্তন করা যায়, প্রশ্ন আপিল বিভাগের : ৪ জুলাই অ্যাটর্নি জেনারেলের উদ্দেশে আপিল বিভাগ বলেন, রাস্তায় এত কিসের আন্দোলন শুরু হয়েছে? আন্দোলনের চাপ দিয়ে কি হাইকোর্টের রায়, সুপ্রিমকোর্টের রায় পরিবর্তন করবেন? প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চে সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা পদ্ধতি বৈধতার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় স্থগিত আবেদনের শুনানিকালে আপিল বিভাগ এ মন্তব্য করেন।
কোটা বহালে হাইকোর্টের রায় বাতিল, মেধায় চাকরি ৯৩ শতাংশ : ২২ জুলাই আপিল বিভাগ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির নিয়োগে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) কোটা বাতিলের সরকারি সিদ্ধান্ত অবৈধ ঘোষণাসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায় বাতিল করেন। একই সঙ্গে সাধারণ তথা মেধাবীদের জন্য ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, নাতি-নাতনিদের জন্য ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর জন্য ১ শতাংশ এবং প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গের জন্য ১ শতাংশ কোটা নির্ধারণ করেন আপিল বিভাগ। ওইদিন পৃথক দুটি লিভ টু আপিলের শুনানি শেষে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বে সাত সদস্যের বেঞ্চ এ রায় দেন।
আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করলেন প্রধান বিচারপতিসহ ৬ বিচারপতি : ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির পদত্যাগ দাবিতে সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বর্ধিত ভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন আন্দোলনকারীরা। দুপুর দেড়টার দিকে জানা যায়, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন। এরপর দুপুর ২টার দিকে আন্দোলনকারীরা হাইকোর্ট এলাকা ছেড়ে চলে যান। বিকালে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগপত্র জমা দেন। তারা আইন মন্ত্রণালয়ে এ পদত্যাগপত্র জমা দেন বলে জানান মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা। প্রধান বিচারপতি ছাড়া অন্য পাঁচ বিচারপতি হলেন এম ইনায়েতুর রহিম, মো. আবু জাফর সিদ্দিকী, জাহাঙ্গীর হোসেন, মো. শাহিনুর ইসলাম ও কাশেফা হোসেন।
সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ : ২০ অক্টোবর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা বহাল রেখে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনা (রিভিউ) চেয়ে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদন নিষ্পত্তি করে আদেশ দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। ফলে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে। রায়ে সংবিধানের এ-সংক্রান্ত ৯৬ অনুচ্ছেদ পুরোটাই পুনর্বহাল করেন আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এই সিদ্ধান্ত দেন।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তির বিধান বাতিল : এ বছরের ১৭ ডিসেম্বর নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের দুটি ধারা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে বাতিল ঘোষণা করেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে গণভোটের বিধান পুনর্বহাল এবং আইনের আরও চারটি ধারা বাতিল করেন আদালত।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও উপদেষ্টাদের শপথ নিয়ে সুপ্রিমকোর্টের মতামত : সংবিধানের ১০৬ অনুচ্ছেদ অনুসারে রাষ্ট্রপতি যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আপিল বিভাগের মতামত চাইতে পারেন। ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন ও উপদেষ্টাদের শপথ পাঠ করানো যেতে পারে বলে মতামত দেন সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ। প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ বিষয়টির ওপর মতামত দেন। শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আগে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন এই মতামত চেয়েছিলেন।