পেট্রোল পাম্পে যাচ্ছে অপরিশোধিত কনডেনসেট
বছরে লোপাট সরকারের শত কোটি টাকা
মুজিব মাসুদ
প্রকাশ: ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
দেশব্যাপী পেট্রোল ও অকটেনের সঙ্গে মেশানো হচ্ছে অপরিশোধিত কনডেনসেট। অভিযোগ উঠেছে, এই ভেজাল তৈরিতে পেট্রোল পাম্প মালিকদের সহায়তা করছে বেশ কয়েকটি বেসরকারি রিফাইনারি ও ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট। এতে সরকার বছরে শতকোটি টাকার বেশি রাজস্ব হারাচ্ছে। ক্ষতি হচ্ছে যানবাহনের ইঞ্জিন। এটি পরিবেশদূষণেও ভূমিকা রাখছে। সম্প্রতি কয়েকটি বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানির কনডেনসেট উত্তোলন এবং পরিশোধিত জ্বালানি বিক্রির পরিসংখ্যান থেকে এ ভয়াবহ চিত্র পেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)।
পেট্রোল পাম্পগুলোয় সরাসরি কনডেনসেট বিক্রি প্রসঙ্গে বিপিসি চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, এসব অভিযোগে প্রতিনিয়ত সারা দেশে মোবাইল কোর্ট চালানো হচ্ছে। তিনি বলেন, কারও বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ প্রমাণিত হলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, দেশের প্রাকৃতিক সম্পদ গ্যাসক্ষেত্রের তলানি কনডেনসেট সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ নিয়ে কয়েকটি বেসরকারি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট সরাসরি পেট্রোল পাম্পে বিক্রি করছে। অনেক প্ল্যান্ট কোনোরকম পরিশোধন না করে গ্যাসক্ষেত্র থেকে সরাসরি বাইরে বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার মুনাফা লুটছে। শুধু তাই নয়, ওইসব ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট সরকারকে রাজস্ব ফাঁকি দিচ্ছে। এতে কনডেনসেট বরাদ্দের তুলনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ভ্যাট পাচ্ছে কম।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কনডেনসেট বরাদ্দের তুলনায় বিপিসিকে অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেল বুঝিয়ে দেওয়ার পরিমাণ এবং ভ্যাট দেওয়ার রেকর্ড দেখলেই এর প্রমাণ সহজে পাওয়া যাবে। তারা বলছেন, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যারা কনডেনসেট নিয়ে সরকারকে সর্বোচ্চ অকটেন ও পেট্রোলের মতো দামি পেট্রোলিয়াম বিক্রি এবং সর্বোচ্চ ভ্যাট দেওয়ার রেকর্ড আছে, শুধু তাদেরই কনডেনসেট বরাদ্দ দেওয়া উচিত। সরকারি আইন অনুযায়ী, স্থানীয় কনডেনসেট বরাদ্দের ১০ শতাংশ কারিগরি সিস্টেম লস ছাড়া বাকি ৯০ শতাংশ অকটেন, পেট্রোল বা ডিজেল বিপিসির কাছে বিক্রি করতে হবে। কিন্তু অধিক মুনাফার জন্য বিপিসির কাছে বিক্রি না করে কনডেনসেট বিভিন্ন পাম্পে বিক্রি করা হচ্ছে বলে অভিযোগের প্রমাণ রয়েছে। এতে পরিবেশেরও ক্ষতি হচ্ছে। নষ্ট হচ্ছে যানবাহনের মূল্যবান ইঞ্জিন। বর্তমানে দেশের কয়েকটি বেসরকারি এবং একটি সরকারি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট কনডেনসেট বরাদ্দ পাচ্ছে। এর মধ্যে সরকারি রশিদপুর কনডেনসেট ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট দৈনিক ৪ হাজার ২৫০ ব্যারেল, বেসরকারি সুপার পেট্রোকেমিক্যাল ও পেট্রোম্যাক্স রিফাইনারি লিমিটেড দৈনিক ২ হাজার ২৫০ ব্যারেল এবং অ্যাকোয়া রিফাইনারি লি. পাচ্ছে দৈনিক ৭৫০ ব্যারেল। এর মধ্যে অ্যাকোয়া পতিত শেখ হাসিনা সরকারের আমলে অন্যতম সুবিধাভোগী বলে অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, চলতি বছরের জানুয়ারি-আগস্টে একটি ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট ১ লাখ ৩০ হাজার ২৯৩ টন সরকারের কাছ থেকে কনডেনসেট এবং ন্যাফথা নিয়েছে। এর বাইরে বিদেশ থেকে কনডেনসেট আমদানি করেছে ৭৬ হাজার ৮১৬ টন। কিন্তু বিপিসিকে অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেল অর্থাৎ পেট্রোলিয়াম পণ্য বুঝিয়ে দিয়েছে মাত্র ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪৭ টন; যা মোট কাঁচামাল অর্থাৎ কনডেনসেট ও ন্যাফথার মাত্র ৬৭ দশমিক ৬৮ শতাংশ। অথচ ১০ শতাংশ স্টকে থাকলেও কমপক্ষে ৮০ শতাংশ সরকারকে বুঝিয়ে দেওয়ার কথা। ভ্যাটসহ পাম্পগুলোয় বিক্রির কারণে এ কোম্পানি থেকে সরকারের লোকসান হয়েছে কমপক্ষে ১৬৭ কোটি টাকা। অন্য একটি বেসরকারি রিফাইনারি কোম্পানি এ সময়ে আমদানি করেছে ২৬ হাজার ১৬ টন এবং সরকারের কাছ থেকে কনডেনসেট নিয়েছে ৫২ হাজার ২২ টন। মোট ৭৮ হাজার ৩৮ টনের মধ্যে বিপিসিকে সরবরাহ করেছে ৬১ হাজার ২৫৯ টন বা ৭৮ দশমিক ৫০ শতাংশ। এতে ৯ কোটি টাকার হিসাবে গরমিল আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশের আরেক ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত বিদেশ থেকে আমদানি করেছে ২০ হাজার ৪৭৫ টন কনডেনসেট। আর সরকারের কাছ থেকে কনডেনসেট পেয়েছে ৪৮ হাজার ৩৬টন। সব মিলিয়ে পরিশোধন করেছে ৬৮ হাজার ৫১১ টন। এর মধ্যে বিপিসিকে অকটেন ও পেট্রোল হিসাবে বুঝিয়ে দিয়েছে ৫৪ হাজার ৮৮৫ টন, যা ৮০ দশমিক ১১ শতাংশ। এছাড়া একটি বেসরকারি ফ্রাকশনেশন কোম্পানি আপাতত কনডেনসেট আমদানি করে চলছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কোম্পানিটি ওই সময়ে কনডেনসেট আমদানি করেছে ৮৬ হাজার ৫২১ টন। আর পরিশোধন করে সরকারকে বা বিপিসির কাছে অকটেন, পেট্রোল এবং ডিজেল বিক্রি করেছে মাত্র ৬০ হাজার ১১৭ টন, যা মোট আমদানির ৬৯ দশমিক ৪৮ শতাংশ। এতে সরকারের নানাভাবে লোকসান হয়েছে ৬০ কোটি টাকার বেশি। খোদ জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, কোম্পানিটি ঠিকমতো পেট্রোলিয়াম পণ্য বুঝিয়ে না দিয়ে এখন স্থানীয়ভাবে কনডেনসেট পেতে তদবির করছে। কোম্পানিটি ২০১৬ সালে আমদানি করা কনডেনসেট থেকে তাদের ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্টে পেট্রোলিয়াম পণ্য উৎপাদনের লাইসেন্স নেয়।
অভিযোগ আছে, অনেক ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট কনডেনসেটের বেশি বরাদ্দ নিতে প্ল্যান্টের পরিশোধনের ক্ষমতা বেশি করে দেখাচ্ছে। অনুসন্ধান করলে কয়েকটি ফ্রাকশনেশন কোম্পানির মালিকদের এমন প্রতারণা বের হয়ে আসবে। এসব ফ্রাকশনেশন অসাধু মালিকরাই স্থানীয় কনডেনসেট বেশি বরাদ্দ নিয়ে পাম্পগুলোয় বিক্রি করছে বলেও অভিযোগ আছে।
বিপিসির কর্মকর্তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, কোম্পানিগুলোর মধ্যে কনডেনসেট বরাদ্দের বিপরীতে সবচেয়ে বেশি অকটেন, পেট্রোল ও ডিজেল বিপিসিকে বুঝিয়ে দেওয়ার রেকর্ড ৮ বছরে মাত্র একটি রিফাইনারি কোম্পানির রয়েছে। এ কারণে তুলনামূলকভাবে ছোট ফ্রাকশনেশন প্ল্যান্ট হওয়া সত্ত্বেও তারা বিগত তিন বছর টানা সেরা ভ্যাটদাতা হিসাবে এনবিআরের পুরস্কার পেয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে দেশে জ্বালানি তেল ব্যবহার হয়েছে প্রায় ৭৫ লাখ টন। পরিশোধিত ৫২ লাখ টন এবং অপরিশোধিত ২২ লাখ টন। এর মধ্যে ডিজেলের ব্যবহার ৫০ লাখ মেট্রিক টন, অকটেন ও পেট্রোল মিলে প্রায় ১০ লাখ মেট্রিক টন এবং বাকি অংশ অন্যান্য পেট্রোলিয়ামজাত পণ্য রয়েছে। অকটেন-পেট্রোল স্থানীয়ভাবে উৎপাদনের কারণে সরকারের বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রার আমদানি দায় কমে যায়। সঠিকভাবে মনিটরিং না হলে সরকারের বছরে প্রায় ৫০ মিলিয়ন ডলারের আমদানি দায় নতুনভাবে তৈরি হবে।
বিপিসি সূত্রে জানা যায়, আগে অপরিশোধিত কনডেনসেট বাইরে বিক্রির অপরাধে তিনটি বেসরকারি রিফাইনারিতে কনডেনসেট সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল পেট্রোবাংলা। এছাড়া ভেজাল জ্বালানি বিক্রির অভিযোগে বিভিন্ন জেলার ১৪টি ফিলিং স্টেশন (পেট্রোল পাম্প), ২২৪ এজেন্ট ও ৩৫৮ প্যাক্ড পয়েন্ট ডিলারের লাইসেন্স বাতিল করেছিল বিপিসি। এখনো ২০৫টি এজেন্ট ও ১৫৫ প্যাকড পয়েন্ট ডিলারের লাইসেন্স বাতিল প্রক্রিয়াধীন। এদিকে পেট্রোল পাম্পগুলোয় ভেজাল তেল থাকায় নষ্ট হচ্ছে যানবাহন। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুস সালাম আকন্দ যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রতিটি ইঞ্জিন ডিজাইন করা হয় নির্দিষ্ট জ্বালানির জন্য। সেই জ্বালানি না দিলে ইঞ্জিনের পারফরম্যান্স কমে যাবে। কম শক্তি উৎপন্ন করবে। এতে জ্বালানি খরচ বাড়বে। যানবাহনের আয়ু কমে যাবে। সার্ভিস লাইফ শেষ হওয়ার আগেই বদলাতে হবে নানা যন্ত্রাংশ। যানবাহন রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বেড়ে যাবে। বিলাসবহুল অনেক গাড়ি নির্দিষ্ট জ্বালানি না দিলে ইঞ্জিনই স্টার্ট নেয় না। এসব গাড়িতে খুবই সতর্কভাবে জ্বালানি ব্যবহার করতে হয়। কম দামি গাড়ি মানহীন তেলে চললেও দ্রুত ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনের জন্য নির্ধারিত জ্বালানির চেয়ে হালকা জ্বালানি ব্যবহার করলে তা দ্রুত পুড়ে অল্প সময়ের জন্য পিস্টনে উচ্চচাপ ও তাপ তৈরি করে। তাপে অন্যান্য লুব্রিক্যান্ট শুকিয়ে যায়। আবার কম দামি ভারী জ্বালানি ব্যবহার করলে তা নির্দিষ্ট সময়ে পুরোপুরি পুড়বে না। অদাহ্য অংশ সাইলেন্সার দিয়ে বেরিয়ে বায়ুদূষণ ঘটাবে। স্টার্ট নিতে চাইবে না। পারফরম্যান্স পেতে এক্সিলেশন বাড়িয়ে রাখতে গিয়ে ইঞ্জিন গরম হবে। উভয় ক্ষেত্রেই ইঞ্জিনের যন্ত্রাংশের মারাত্মক ক্ষতি হয়।’