Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের দাবি

বিএনপিসহ একাট্টা হচ্ছে মিত্ররা

তারিকুল ইসলাম

তারিকুল ইসলাম

প্রকাশ: ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বিএনপিসহ একাট্টা হচ্ছে মিত্ররা

দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে একাট্টা হচ্ছে বিএনপিসহ মিত্ররা। আগামী বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন চায় দলগুলো। এজন্য দ্রুত সময়ের মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নির্বাচনমুখী সংস্কার চান। বাকি সংস্কারগুলো পরে নির্বাচিত সরকার সংসদে আলোচনা করে চূড়ান্ত করার পক্ষে দলগুলো। এজন্য সংস্কারে বেশি সময় না নিয়ে অবিলম্বে নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা চান নেতারা। জানুয়ারির মধ্যে এ ঘোষণা দেওয়া না হলে যুগপৎ আন্দোলনের কথা ভাবা হচ্ছে।

রাজনৈতিক দলের নেতারা বলেন, মাঠের কর্মসূচি দেওয়ার লক্ষ্য হবে ভোটের আবহ তৈরি এবং সরকারের ওপর নির্বাচনি চাপ বাড়ানো। নির্বাচন নিয়ে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা সংশয়-সন্দেহ তৈরি হয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে গত কয়েকদিন ধরে ২৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। প্রয়োজনীয় সংস্কার করে ২০২৫ সালের মধ্যেই নির্বাচন চায় দলগুলোর নেতারা। এসব বৈঠকে অংশ নেওয়া বিএনপির লিয়াজোঁ কমিটির এক সদস্য যুগান্তরকে বলেন, সভা-সমাবেশে যে যা-ই বলুক না কেন, ভোটের অধিকারের প্রশ্নে সব রাজনৈতিক দল ঐক্যবদ্ধ। দীর্ঘ ১৫ বছর ভোটের অধিকারের জন্য লড়াই করতে হয়েছে। এখন সেই ভোটের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এখনো যদি ভোটের জন্য রাস্তায় নামতে হয়, তবে তা খুবই দুঃখজনক হবে। তাহলে বুঝতে হবে মৌলিকভাবে কোনো কিছু পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং আশা করব রাজনৈতিক দলগুলোকে রাস্তায় নামতে হবে না। সরকার রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নেবে এবং আগামী বছরের মধ্যই জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ নেবে।

তবে বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস সরকারের ব্যর্থতাও চায় না। বিএনপি নেতারা মনে করেন, অন্তর্বর্তী সরকার ব্যর্থ হলে দেশে এমন প্রেক্ষাপট তৈরি হবে, যা নির্বাচনকে বিলম্বিত করতে পারে। এ বিষয়ে কয়েকটি দল ও মহলের কর্মকাণ্ড বিএনপি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিএনপি মনে করছে, কোনো কোনো মহল সরকারকে বেকায়দায় ফেলে ভিন্ন পরিস্থিতি তৈরি করতে চাচ্ছে।

এমন প্রেক্ষাপটে সোমবার ঠাকুরগাঁওয়ে এক জনসভায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বক্তব্যেও আন্দোলনের ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। তিনি সভায় উপস্থিত জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘আপনারা কি সত্যি সত্যি পরিবর্তন চান নাকি আবার ওই আওয়ামী লীগের নৌকায় ফিরে যেতে চান। যদি পরিবর্তন চান তবে ৫ আগস্ট আপনারা যেমন রাস্তায় নেমেছিলেন, আবারও ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাস্তায় নামতে হবে। ভোটের অধিকার, ভাতের অধিকার আদায়ের জন্য এবং ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য রাস্তায় নামতে হবে।’

জানতে চাইলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু যুগান্তরকে বলেন, মানুষ কখন ভোট দিয়ে তাদের নির্বাচিত সরকার ও সংসদ গঠন করতে পারবে-সেটি সরকার স্পষ্ট করেনি বলেই জনমনে এক ধরনের সংশয় তৈরি হয়েছে। কোনো কোনো মহল নির্বাচন বিলম্বিত করার চেষ্টা করছে বলেই বিএনপি বারবার সরকারকে সতর্ক করছে।

গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, অনেকে বলার চেষ্টা করে সংস্কার শেষ না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচন নয়। যা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সংস্কার তো একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রশ্ন। এটার প্রকারান্তরে ক্ষমতা প্রলম্বিত করার কোনো তৎপরতা কিনা? বোঝা যায় তারা এসব ইস্যুকে সামনে আনছেন ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য। তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সরকারের এক ধরনের দূরত্বের জায়গা তৈরি হবে, সন্দেহ-অবিশ্বাস বাড়বে। যেটা আমরা কেউ চাই না। আমরা আশা করি সরকার প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দেবে। রাজতৈনিক দলগুলোকে আস্থায় নিয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

তিনি বলেন, আমরা চাই না ভোটের অধিকারের জন্য আবার বিরোধী দলগুলো রাস্তায় নামুক। এটা খুবই অপ্রত্যাশিত, এটা আমরা চাই না। আমরা চাই রাস্তায় যাতে নামতে না হয়, সেজন্য সরকার প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেবে, আলাপ-আলোচনা করবে। আর রাস্তায় যদি নামতেই হয়, সেটা খুবই অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় হবে। ১৫ বছর পর ভোটের একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে সেটা কাজে না লাগানো হবে খুবই দুঃখজনক। এখনও যদি ভোটের জন্য, ভাতের জন্য রাস্তায় নামতে হয়, তাহলে বুঝতে হবে মৌলিকভাবে কোনো কিছুই পরিবর্তন হয়নি। সুতরাং আশা করব রাজনৈতিক দলগুলোকে রাস্তায় নামতে হবে না। আমরা সরকারকে হুমকি দিতে চাই না, সতর্ক করতে চাই। বলতে চাই প্রত্যাশাটাকে সীমিত করা দরকার, উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক প্রকল্প না নিয়ে যেটা অর্জনযোগ্য, সবাই মিলে একমত হওয়া যাবে-এমন পদক্ষেপ নেবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় নেবে। সরকার আগামী বছরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের উদ্যোগ নেবে এ প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

সাইফুল হক বলেন, নির্বাচন কমিশনও বলেছে তারা নির্বাচন করার জন্য প্রস্তুত। এখন সরকার নির্বাচন কমিশনকে বলবে যে ২০২৫ সালের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনটা সম্পূর্ণ করতে চাই। এই নির্দেশনা গেলেই নির্বাচন কমিশন সেভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ থেকে শুরু করে প্রয়োজনীয় কাজগুলো সম্পন্ন করবে। পুরো প্রস্তুতিটা ৫ থেকে ৬ মাসের ব্যাপার। সবকিছু শেষ করে তারা আগামী মে-জুন মাসের মধ্যে নির্বাচনের শিডিউল ঘোষণা করতে পারেন। এতে সর্বোচ্চ নভেম্বর-ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন করা সম্ভব।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ ইতোমধ্যে দলের অবস্থান পরিষ্কার করে বলেছেন, ‘নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো প্রধানতম সংস্কার বলে মনে করি। এই সরকারের প্রধান ও প্রথম দায়িত্ব হলো-একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া। আর সেজন্য কিছু আইনি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও মাঠের সংস্কার দরকার আছে। আমরা পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ করে দেখেছি, এ ক্ষেত্রে সংস্কারে চার থেকে ছয় মাসের বেশি সময় লাগার কথা নয়। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান, গণতন্ত্রের যাত্রাপথে আমরা যেন কোনো কৌশল প্রয়োগ না করি। ভোটের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব, নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার সেরে ভোটের আয়োজন করতে হবে।’

গত প্রায় ১৫ বছর থেকে বিএনপি মিত্রদের সঙ্গে নিয়ে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে অন্তত ৫০টি নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করেছে বিএনপি। যুগপতে না থাকলেও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী অভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে মাঠে ছিল। এসব দলের অন্তত বারো জন শীর্ষ নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সভা-সমাবেশে দলগুলোর নেতারা যা-ই বক্তব্য দিক না কেন আগামী নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বক্তব্যে তারা সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ফলে তারা সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে মাঠের কর্মসূচির কথা ভাবছেন। বিএনপির সর্বশেষ স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও বেশির ভাগ সদস্য মনে করেন, সরকার আদৌ নির্বাচন দিতে চায় কিনা, তা নিয়ে সংশয় আছে। সরকারের কিছু কর্মকাণ্ড ও নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা নিয়ে ‘গড়িমসি’ দেখে নেতাদের মধ্যে এ শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

গত কয়েকদিন ২৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করেছে বিএনপি। এসব বৈঠকে স্থায়ী কমিটির এক সিনিয়র সদস্য বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে তাদের কোনো কর্মসূচি দেওয়া ঠিক হবে না। তবে দেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বড় ধরনের সমাবেশ করা যেতে পারে। এসব সমাবেশের লক্ষ্য থাকবে নির্বাচনি আবহ তৈরি করা। দেশব্যাপী নির্বাচনি আমেজ তৈরি করতে পারলে সরকারের ওপর তা চাপ হিসাবে কাজ করবে। মঙ্গলবার পর্যন্ত ১২ দলীয় জোটে থাকা ১২ দল, জাতীয় সমমনা জোটে থাকা ১১ দলসহ মোট ২৯টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে মিত্র দলগুলো দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। এজন্য অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে সার্বিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য যা যা করা দরকার তা করবে বলেও মত দেন নেতারা। সেখানে জোট ও দলের নেতারা অভিন্ন সুরে জানান, ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোনোভাবেই ২০২৫ সাল অতিক্রম করতে পারে না। এই সময়ের মধ্যে নির্বাচন না হলে দেশে অস্থিরতা বাড়বে, পতিত ফ্যাসিবাদের দোসররা আরও শক্তি সঞ্চয় করে গভীর ষড়যন্ত্রে নামবে। এতে দেশ ও জাতির বড় ক্ষতি হবে।

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার যুগান্তরকে বলেন, ‘আমরা বলেছি, নির্বাচন সুষ্ঠু এবং নিরপেক্ষ হতে রাষ্ট্রের যে বিভাগগুলোর সংস্কার প্রয়োজন, সেগুলো সংস্কার করে নির্বাচন দিতে হবে। সেটা ২-৩ মাস আগে পরে হতে পারে। নির্বাচন নিরপেক্ষ হবে কিনা সেটাই বড় ফ্যাক্টর। সেজন্য আমরা সংস্কার চাই, কিন্তু সব বিভাগের সংস্কার এই সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। এজন্য নির্বাচনের সঙ্গে যেসব বিষয় যুক্ত সেগুলোর সংস্কার করতে হবে। সরকার নির্বাচনের যে ধারণা দিচ্ছে, সেটা যদি সিনসিয়ারলি বলে থাকে এর মধ্যেই সংস্কার করে নির্বাচনে যাওয়া সম্ভব। এজন্য জামায়াত এটাকে ইতিবাচক হিসাবে দেখে।’ তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রের সব বিভাগের সংস্কার এই সরকারের সময় হবে না। এটা করতে গেলে অনেক সময় এবং বছর লাগবে। আমরা চাচ্ছি নির্বাচন নিরপেক্ষ করতে ইলেকশন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সরকারের যেসব বিভাগ জড়িত সেগুলো সংস্কার হোক। সে সংখ্যাটা কম এবং সেটা এর মধ্যে হওয়া সম্ভব।’ ১২ দলীয় জোট প্রধান জাতীয় পার্টির (জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার মনে করেন, ‘বিএনপি, ১২ দলীয় জোটসহ যারা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে, আমাদের সেই ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি। আগামীতে সেটা আরও গভীরভাবে অনুভূত হবে। বিএনপিসহ অন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে খুব শিগগিরই আমরা কর্মসূচি ঘোষণা করব।’

জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘আমরাও দ্রুত নির্বাচন চাই। কারণ মানুষ দীর্ঘ বছর ধরে ভোট দিতে পারেনি। আমরা চাই একটা স্পষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ। সংস্কারের নামে নির্বাচনে কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। দ্রুত সময়ের মধ্যে নির্বাচন কেন্দ্রিক সংস্কার বর্তমান সরকার করবে, বাকি সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার সংসদের মাধ্যমে। দ্রুত জনগণের নির্বাচিত সরকার চাই। শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যেমন আন্দোলন করে তাকে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, তেমনি আগামীতেও প্রয়োজনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন হবে। আমরা আরেকটা ওয়ান-ইলেভেনের সরকার চাই না। এই সরকারের ছত্রছায়ায় আরেকটা কিংস পার্টি তৈরি হোক এটাও চাই না।’

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম