Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

কেরানীগঞ্জে ব্যাংকে ডাকাতের হানা

চার ঘণ্টা পর তিন জনের আত্মসমর্পণ

‘কিশোর অ্যাডভেঞ্চার’ থেকে ডাকাতির পরিকল্পনা-ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার * উদ্ধার হওয়া চার পিস্তলই খেলনা

Icon

আবু জাফর, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)

প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

চার ঘণ্টা পর তিন জনের আত্মসমর্পণ

ঢাকার কেরানীগঞ্জে রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় হানা দেওয়া ডাকাতরা ৪ ঘণ্টা পর অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণ করেছে। জিম্মিদশা থেকে অক্ষত অবস্থায় মুক্ত হয়েছেন ব্যাংকের গ্রাহক-স্টাফসহ সবাই। আলোচনার মাধ্যমে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা সাড়ে ৫টার দিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তারা। ব্যাংকের ভেতরে ছিল তিন ডাকাত। এর মধ্যে দুজন ছিল কিশোর। তাদের বয়স ১৬। একজনের ২২। তাদের কাছ থেকে ব্যাংক থেকে লুট করা নগদ ১৮ লাখ টাকা, চারটি খেলনা পিস্তল, দুটি চাকু, একটি লোহার পাইপ, একটি স্কুলব্যাগ, তিনটি মাস্ক, তিন জোড়া হ্যান্ড গ্লাভস ও তিনটি কালো চশমা উদ্ধার করেছে যৌথ বাহিনী। তাদের নাম আরাফাত, সিফাত ও নিরব। যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের পর তিনজনকে কেরানীগঞ্জ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। ‘কিশোর অ্যাডভেঞ্চার’ থেকে তারা এ ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করছে পুলিশ। ডাকাতরা দাবি করেছে, মৃত্যুপথযাত্রী এক কিডনি রোগীর চিকিৎসার অর্থের জন্য তারা ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করেছে। তাদের এই দাবি পুলিশ খতিয়ে দেখছে বলে জানিয়েছেন ঢাকার পুলিশ সুপার আহমেদ মুঈদ। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, ডাকাতরা কালো মাস্ক পরে ব্যাংকের ভেতরে সোফায় বসে আছে। 

বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় রূপালী ব্যাংকের জিনজিরা শাখায় হানা দেয় তারা। এতে ব্যাংকের গ্রাহক ও কর্মী মিলে ১৪ জন ভেতরে জিম্মি হয়ে পড়েন। ব্যাংকে ঢুকে ডাকাতরা অস্ত্রের মুখে স্টাফদের কাছে ১৫ লাখ টাকা দাবি করে। বৃহস্পতিবার রাতে কেরানীগঞ্জ মডেল থানায় এক ব্রিফিংয়ে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার আহমেদ মুঈদ বলেন, বৃহস্পতিবার বেলা ২টার দিকে রূপালী ব্যাংক জিনজিরা শাখায় কিছু দুষ্কৃতকারীরা প্রবেশ করে। একপর্যায়ে তারা ব্যাংকে কর্মরত ৮ ব্যাংক কর্মকর্তা ও ৬ গ্রাহককে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে। পরবর্তী সময়ে তারা ব্যাংকের কাউন্টার থেকে নগদ ১৫ লাখ টাকা লুট করে একটি ব্যাগে গচ্ছিত রাখে। একই সঙ্গে আরও তিন লাখ টাকা তিনজনের প্যান্টের পকেটে রাখে।

তিনি আরও বলেন, ডাকাতি চেষ্টার ঘটনাটি ছিল ‘কিশোর অ্যাডভেঞ্চার’। এ ঘটনায় যে তিনজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তাদের দুজনের বয়স ১৬, একজনের ২২। চারটি খেলনা পিস্তল নিয়ে তারা ব্যাংক ডাকাতি করতে গিয়েছিল। ব্যাংক ডাকাতি করতে তারা বিভিন্ন সিনেমা ও অনলাইনে ভিডিও দেখে। তিনি বলেন, ব্যাংক ডাকাতির খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ, র‌্যাব, সেনাবাহিনীসহ বিভিন্ন সরকারি সংস্থা যেভাবে কার্যক্রম চালিয়েছে তা অভূতপূর্ব। ওদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে আমরা দফায় দফায় কথা বলেছি। একপর্যায়ে আইজি স্যারও ওদের সঙ্গে কথা বলে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানান। এরপর ওরা ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আত্মসমর্পণ করে। ওদের দাবি ছিল, একজন কিডনি রোগীকে সাহায্য করার জন্য ওদের ১৫ লাখ টাকা ও নিরাপদে বেরিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। আমরা ওদের কথায় রাজি হই। আমরা ওদের অস্ত্র জমা দিতে বলি। একপর্যায়ে ওরাও রাজি হয়। অস্ত্র জমা দেয়। অস্ত্রের মধ্যে ছিল ৪টি পিস্তল (খেলনা পিস্তল) ও দুটি ছুরি। এরপর তারা ব্যাগে ১৫ লাখ টাকা ও ৩ জন প্যান্টের পকেটে ৩ লাখ টাকা নিয়ে বেরিয়ে আসে। পরে অস্ত্রের সঙ্গে এই টাকাও তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয়।

আত্মসমর্পণ করা কিশোর-তরুণরা হলো মো. লিয়ন মোল্লা নিরব (২২)। সে পেশায় গাড়িচালক। গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি উপজেলার কুমুরিয়া গ্রামে। থাকত দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের কদমতলী খালপাড়ে। এ ছাড়া রয়েছে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মো. আরাফাত (১৬)। সে সপ্তম শ্রেণির ছাত্র এবং দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের মো. সিফাত (১৬)। সে কেরানীগঞ্জের একটি মাদ্রাসার ছাত্র।

পুলিশ সুপার আরও জানান, ডাকাতির আগে তারা বেশকিছু মুভি দেখে। এরপর তারা পরিকল্পনা করে। পরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই প্রায় একই রকম ড্রেস পরিধান করে ব্যাংকে ঢোকে। এ সময় ওদের মাথায় ক্যাপ ও মুখে মাস্ক ছিল।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম বলেন, দুপুর দেড়টার দিকে ওই ৩ কিশোর ব্যাংকে ঢুকে কেচি গেট নিজেরাই ভেতর থেকে বন্ধ করে দেয়। এ সময় ব্যাংকের কোনো গার্ড গেটে ছিল না। ব্যাংকে ৬ জন গ্রাহক ও ৮ জন স্টাফ ছিলেন। তারা ভেতরে ঢুকেই একজন গ্রাহকের মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে হত্যার হুমকি দেয়। বাকিদের নিজ নিজ জায়গায় চুপচাপ বসে থাকতে বলে। এভাবে তারা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ নেয়। তবে ওরা ব্যাংকে ঢোকার কয়েক মিনিটের মধ্যে বিষয়টি এলাকাবাসী জেনে যান। মাইকে ব্যাংক ডাকাতির বিষয়টি প্রচার করা হলে ঘটনাস্থলে শত শত জনতা এসে ব্যাংকটি ঘিরে ফেলেন। পরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কয়েক ঘণ্টা নেগোসিয়েশনের পর তারা আত্মসমর্পণ করে। 

স্থানীয়রা জানান, বৃহস্পতিবার দুপুর দেড়টার দিকে ডাকাতরা ব্যাংকে ঢোকে। এ সময় পাশের মসজিদের মাইকে ঘোষণা দেওয়া হলে স্থানীয় কয়েক হাজার লোক ব্যাংকের ওই শাখা ঘিরে ফেলেন ও বাইরে থেকে তালা ঝুলিয়ে দেন। পরে পুলিশ, র‌্যাব ও সেনাবাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য ব্যাংকটির চারপাশে অবস্থান নেন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন র‌্যাব-১০ এর অধিনায়ক অতিরিক্ত ডিআইজি খালিদুল হক হাওলাদার, ঢাকার পুলিশ সুপার আহমেদ মুঈদ, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রিনাত ফৌজিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।

জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে ডাকাত দলের সদস্যদের সঙ্গে আলোচনা করে তাদের আত্মসমর্পণে রাজি করানো হয়। তারা জানালা দিয়ে অস্ত্র (খেলনা পিস্তল) সমর্পণ করে। পরে একে একে তারা বেরিয়ে আসে। তখন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তিন ডাকাত সদস্যকে গাড়িতে তুলে নিয়ে যান। 

ব্যাংকের ম্যানেজার শেখর মন্ডল বলেন, ডাকাতরা ব্যাংকে যখন প্রবেশ করে তখন তিনি মার্কেটিংয়ের কাজে বাইরে ছিলেন। আগ্নেয়াস্ত্রসহ ডাকাতরা ব্যাংকে ঢুকে স্টাফ ও কয়েকজন গ্রাহককে জিম্মি করে। সবার মোবাইল ফোন নিয়ে নেয়। ডাকাতরা যখন বুঝতে পারে, তারা আটকা পড়েছে, তখন এক স্টাফের ফোন থেকে তাকে ফোন করা হয়। তারা ১৫ লাখ টাকা ও নিরাপদ প্রস্থান দাবি করে। পরে ওই মোবাইল ফোনে দফায় দফায় ডাকাতদের সঙ্গে কথা বলেন এসপিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা। এভাবে কয়েক ঘণ্টা চলার পর বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে তারা আত্মসমর্পণ করে ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসে। 

এক টাকাও খোয়া যায়নি-জিএম : কেরানীগঞ্জের চুনকুটিয়া এলাকায় রূপালী ব্যাংকের শাখায় গ্রাহক সেজে ডাকাতি চেষ্টার ঘটনায় এক টাকাও খোয়া যায়নি বলে আশ্বস্ত করেছেন ব্যাংকটির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের জিএম ইসমাইল হোসেন শেখ। তিনি বলেন, ডাকাতরা হানা দেওয়ার সময় ব্যাংকে মোট ছয়জন গ্রাহক ছিলেন। তারা নিরাপদে আছেন। সে সময় ব্যাংকে ছিলেন ৭ কর্মকর্তা, একজন অফিস সহকারী, সবাই সুস্থ আছেন। ব্যাংকের সব টাকা গুনে দেখা হয়েছে, এক টাকাও খোয়া যায়নি। রোববার থেকে ব্যাংকের এই শাখায় আবার আগের মতো লেনদেন হবে।

বৃহস্পতিবার রাতে ব্যাংক পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের এসব তথ্য জানিয়ে তিনি আরও বলেন, আত্মসমর্পণকারী তিন ডাকাত গ্রাহক সেজে ব্যাংকে প্রবেশ করে। এরপর খেলনা পিস্তল ঠেকিয়ে কর্মকর্তাদের জিম্মি করে টাকা আদায়ের চেষ্টা করে।


Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম