বিএফআইইউর প্রধান পদে নিয়োগ
বিতর্কিত এহসান আলোচনায়!
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) মতো প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা জাতীয় আর্থিক ও নিয়ন্ত্রক কাঠামোর প্রতি আস্থা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গত সরকারের আমলে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে দেশের ব্যাংকিং খাতে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত কমিটির অর্থনীতির শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, গত দেড় দশকে ২৮ উপায়ে লুটপাট করা অর্থের ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাচার করা হয়েছে দেশের বাইরে। এসব অর্থ ফেরত আনার লক্ষ্য নিয়ে তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। এ কাজে মূল নেতৃত্ব দেবে যে সংস্থাটি, সেই ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রধান হিসাবে কাকে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, তা নিয়ে শুরু হয়েছে নতুন জটিলতা। গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থার প্রধান হতে আগ্রহীদের মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে গত ১১ ও ১২ ডিসেম্বর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এ পরীক্ষায় অংশ নেওয়া বেশিরভাগ ব্যক্তির বিরুদ্ধেই রয়েছে নানা অভিযোগ। এমনকি দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের দায়ে অভিযুক্ত এবং সমালোচিত শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের সুবিধাভোগী একাধিক কর্মকর্তাও রয়েছেন পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের তালিকায়। বিতর্কিত এসব কর্মকর্তাকে বিএফআইইউর প্রধান বানানো হলে পাচারের অর্থ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্য কতটা পূরণ হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তাসহ ১০ জন। তারা হলেন-বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এএফএম শাহীনুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, জহুরুল হুদা, আকতারুল ইসলাম ও নুরুল আমিন; বর্তমান নির্বাহী পরিচালকদের মধ্যে রয়েছেন রফিকুল ইসলাম, একেএম এহসান, মামুন হোসেন ও মো. সাইফুল ইসলাম খান এবং এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ডিএমডি আশিকুর রহমান। এই ১০ জনের মধ্য থেকে সার্চ কমিটির পরামর্শে একজনকে বিএফআইইউ প্রধান হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হবে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া কর্মকর্তাদের মধ্যে বিএফআইইউর নির্বাহী পরিচালক এবং উপপ্রধান হিসাবে দায়িত্ব পালনরত একেএম এহসানের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ের অভিযোগগুলো উদ্বেগজনক প্রশ্ন উত্থাপন করেছে। এই অভিযোগগুলো তার আচরণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের সম্ভাবনার বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এহসানের বিরুদ্ধে অন্যতম গুরুতর অভিযোগটি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তার ভূমিকার সঙ্গে সম্পর্কিত। সূত্রে জানা যায়, তিনি মামলার কেন্দ্রীয় আর্থিক লেনদেনের সঠিক রিপোর্ট দিতে ব্যর্থ হন। বিশেষত, ট্রাস্টের নামে একই দিনে ২ কোটি টাকা উত্তোলন ও ফিক্সড ডিপোজিট রিসিট (এফডিআর) হিসাবে পুনরায় জমা দেওয়ার ঘটনা তার প্রতিবেদনে আত্মসাতের ঘটনা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। সমালোচকরা বলছেন, এই ব্যাখ্যা কেবল ভুলই নয়, ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর ছিল। এই ধরনের ভুল উপস্থাপনা কেবল একটি ভুল সিদ্ধান্তই নয়; এটি একটি নৈতিক মানদণ্ডের লঙ্ঘন, যা ন্যায্য ও নিরপেক্ষ মূল্যায়ন দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বকে ক্ষুণ্ন করে। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, এহসান তার অবস্থান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রচারের জন্য ব্যবহার করেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা বলেন, এহসানের বিরুদ্ধে অভিযোগগুলোর মোকাবিলা করতে এবং বিএফআইইউর অখণ্ডতা রক্ষার জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। প্রথমত, এহসানকে বিএফআইইউর নির্বাহী পরিচালক এবং উপপ্রধান পদ থেকে অবিলম্বে বরখাস্ত করা উচিত। এই বরখাস্তকে ঘিরে অভিযোগগুলোর একটি বিস্তৃত ও নিরপেক্ষ তদন্তের সুযোগ দেবে। দ্বিতীয়ত, এহসানের প্রভাবিত বা প্রণীত সব প্রতিবেদনের নির্ভুলতা এবং নিরপেক্ষতা নির্ধারণের জন্য একটি নিরীক্ষা চালানো প্রয়োজন। এই নিরীক্ষা তথ্য বা ক্ষমতার কোনো সম্ভাব্য অপব্যবহার চিহ্নিত করতে গুরুত্বপূর্ণ। অবশেষে যদি অভিযোগগুলো প্রমাণিত হয়, তাহলে তার বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। এমন ব্যবস্থা একটি স্পষ্ট বার্তা দেবে যে ক্ষমতার অপব্যবহার সহ্য করা হবে না। এই বিতর্কিত কর্মকর্তা সংস্থার প্রধান হিসাবে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার বিষয়টি বিস্মিত করেছে আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টদের। মৌখিক পরীক্ষায় ডাক পাওয়া আরেকজন এনসিসি ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর (ডিএমডি) আশিকুর রহমান। তিনি পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) বিতর্কিত সাবেক চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াতের ঘনিষ্ঠজন হিসাবে পরিচিত। পুঁজিবাজারে অস্থিরতা সৃষ্টির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগও রয়েছে আশিকুরের নামে।
এনসিসি ব্যাংকের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা জানান, দুর্নীতির মাধ্যমে ব্যাংক ঋণ দেওয়ায় ডিএমডি পদ থেকে আশিকুরকে অপসারণ করা হয়েছিল। পরে শিবলী রুবাইয়াতের মাধ্যমে মাসিক ৮ লাখ টাকা বেতনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) চিফ রেগুলেটরি অফিসার (সিআরও) পদে নিয়োগ পান আশিকুর। ডিএসইর নীতিমালা অনুযায়ী, সিআরও পদে নিয়োগপ্রাপ্ত কেউ পুঁজিবাজারে লেনদেন করতে পারবেন না। কিন্তু আশিকুর সেই নীতিমালার ধার ধারেননি। পুঁজিবাজারে ছিল তার বিপুল বিনিয়োগ। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে সিআরও পদ থেকে অপসারণ করা হয়। দুটি পদ থেকে অনিয়মের দায়ে অপসারিত ব্যক্তির নাম বিএফআইইউর সম্ভাব্য প্রধানের তালিকায় উঠে আসায় উদ্বেগ বেড়েছে সংশ্লিষ্টদের।
দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বিএফআইইউ প্রধান নিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ৩১ সেপ্টেম্বর প্রচারিত বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে, সরকারের অর্থ বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান-সংক্রান্ত কার্যক্রমে কমপক্ষে পাঁচ বছরের অভিজ্ঞতাসহ প্রশাসনিক কার্যক্রম বা বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রমে কমপক্ষে ২০ বছরের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। কিন্তু আশিকুর বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা সরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কখনো কাজ করেননি। অর্থাৎ বিএফআইইউ প্রধান হিসাবে নিয়োগ পাওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতাই নেই তার। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাথমিকভাবে বিএফআইইউ প্রধান হিসাবে সম্ভাব্য যে ২০ প্রার্থীর তালিকা করা হয়েছিল, তাতেও আশিকুরের নাম ছিল না। এরপরও তিনি ডাক পেয়েছেন মৌখিক পরীক্ষায়। এর পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক একজন ডেপুটি গভর্নর কলকাঠি নেড়েছেন বলে জানা গেছে।
মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নেওয়া আখতারুল ইসলামের বিরুদ্ধে ইউসিবি ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান এবং সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাভেদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার অভিযোগ রয়েছে। ২০২১-২২ সালে বিএফআইইউর উপপ্রধানের দায়িত্ব পালনকালে আখতারুল ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, এস আলম গ্রুপের কর্ণধার সাইফুল আলম ও সাইফুজ্জামান জাভেদকে বিভিন্ন অনৈতিক সুবিধা দিয়েছেন। সাইফুজ্জামান জাভেদকে আইএফআইসি ব্যাংক থেকে অনৈতিকভাবে ঋণ বের করে দিতেও আখতারুল সহযোগিতা করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। আর্থিক খাত সংশ্লিষ্টরা এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মুখ খুলতে নারাজ। তবে অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিরা বিএফআইইউর মতো একটি স্পর্শকাতর সংস্থার প্রধানের পদে আলোচনায় উঠে আসায় বিষয়টি নিয়ে শঙ্কিত সবাই। কয়েকজন সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা এ প্রসঙ্গে বলেন, বিএফআইইউ প্রধান হিসাবে নিয়োগ দিতে হবে একজন সৎ, যোগ্য ও চৌকশ কর্মকর্তাকে। যিনি নির্মোহভাবে এবং দক্ষতার সঙ্গে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফেরাতে কাজ করবেন। কিন্তু পাচারকারীদের সহযোগীরাই যদি নিয়োগ পান, তাহলে সরকারের সদিচ্ছা মুখ থুবড়ে পড়বে। পাচার হওয়া অর্থ তো ফেরত আসবেই না, বরং আর্থিক খাত আবারও অনিয়মের চক্রে আটকে যাবে।