Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর কিছু অংশ বাতিল

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল

হাইকোর্টের ঐতিহাসিক রায়: ফের কার্যকর গণভোটের বিধান * তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তিসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনীর ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, এ ব্যবস্থা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছে-হাইকোর্ট * জাতির পিতার স্বীকৃতি, ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণাসহ বাকি অনুচ্ছেদের বিষয় আগামী সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন উচ্চ আদালত

আলমগীর মিয়া

আলমগীর মিয়া

প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল

ছবি: সংগৃহীত

নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা এবং গণভোট পুনর্বহাল করে ঐতিহাসিক রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন ও আইনের কয়েকটি ধারার বৈধতা নিয়ে পৃথক রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ রায় দেন।

২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলোপ করা হয়েছিল। এর কিছু অংশ বাতিল ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তি সংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনীর ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে। ফলে দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের যে বিধান করা হয়েছিল, তা বাতিল হয়ে গেল। এর পরিবর্তে ফিরল নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা। তবে বাকি বিধানগুলোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার আগামী সংসদের হাতে ছেড়ে দিয়েছেন উচ্চ আদালত। সংসদ আইন অনুসারে জনগণের মতামত নিয়ে বিধানগুলো সংশোধন, পরিমার্জন ও পরিবর্তন করতে পারবে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-জাতির পিতার স্বীকৃতি, ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা। এছাড়া ৪৭ অনুচ্ছেদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় তা বাতিল ঘোষণা করে গণভোটের বিধান পুনরায় কার্যকর করেছেন আদালত।

রায়ে আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদ দুটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোকে ধ্বংস করেছে, যেটি হচ্ছে গণতন্ত্র। ওই দুটিসহ পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের মাধ্যমে সংবিধানে যুক্ত ৭ক, ৭খ, ৪৪(২) অনুচ্ছেদ সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। ৭ক অনুচ্ছেদে সংবিধান বাতিল, স্থগিতকরণ, ইত্যাদি অপরাধ এবং ৭খ সংবিধানের মৌলিক বিধানাবলি সংশোধন অযোগ্য করার কথা বলা ছিল। আর ৪৪ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার বলবৎকরণ বিষয়ে বলা আছে। ৪৪(২) অনুচ্ছেদ বলছে, এই সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদের অধীন হাইকোর্ট বিভাগের ক্ষমতার হানি না ঘটিয়ে সংসদ আইনের দ্বারা অন্য কোনো আদালতকে তার এখতিয়ারের স্থানীয় সীমার মধ্যে ওই সকল বা এর যে কোনো ক্ষমতা প্রয়োগের ক্ষমতাদান করতে পারবেন। এই অনুচ্ছেদটি বাতিল ঘোষণা করা হয়েছে রায়ে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫৪টির ক্ষেত্রে সংযোজন, পরিমার্জন ও প্রতিস্থাপন আনা হয়েছিল। রায়ে আদালত বলেছেন, পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পুরোটা বাতিল করা হচ্ছে না।

রায়ে আদালত বলেন, গণভোটের বিধান বিলুপ্ত করা হয়, যেটি সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের অংশ ছিল। এটি ১৯৯১ সালে দ্বাদশ সংশোধনীতে যুক্ত হয়। সংবিধানের ১৪২ অনুচ্ছেদের গণভোটের বিধান বিলুপ্তিসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ৪৭ অনুচ্ছেদ সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ায় বাতিল ঘোষণা করা হলো। ফলে দ্বাদশ সংশোধনীর ১৪২ অনুচ্ছেদ পুনর্বহাল করা হলো। রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান বলেছেন, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বিলুপ্তিসংক্রান্ত পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ২০ ও ২১ ধারা বাতিল ঘোষণা করে রায় দিয়েছেন উচ্চ আদালত। এর ফলে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন হবে। তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার করার প্রক্রিয়া কেমন হবে, সেটা সুপ্রিমকোর্ট নির্ধারণ করবেন। রায়ে সন্তুষ্টি প্রকাশ করে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান এ মামলার রিটকারী বদিউল আলম মজুমদার বলেন, এ রায়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসার একটা গুরুত্বপূর্ণ দ্বার উন্মোচিত হলো।

রায়ের পর সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তারা জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করেছে। জনগণ হচ্ছে সব ক্ষমতার মালিক।

অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, গণতন্ত্র হলো আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামো। আর কেয়ারটেকার সরকার সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে রূপান্তরিত হয়েছে। কারণ কেয়ারটেকার সরকার ছাড়া অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায় না। এজন্য আদালত বলেছেন, কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি সংবিধানের মৌলিক কাঠামো।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল করে এবং সংবিধানে জাতীয় চার মূলনীতি-জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনে। একই সঙ্গে তখন সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম বহাল রেখে অন্যান্য ধর্মের সমমর্যাদা নিশ্চিত করার বিধান আনা হয়। পাশাপাশি ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করে। অবৈধ ক্ষমতা দখল করলে সর্বোচ্চ শাস্তির বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা ও সংরক্ষিত নারী আসন ৫০-এ উন্নীত করা এবং জাতির পিতা হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয় ২০২১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে।

২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন পাশ হয়। ২০১১ সালের ৩ জুলাই এ সংক্রান্ত গেজেট প্রকাশ করা হয়। পঞ্চদশ সংশোধনী আইন চ্যালেঞ্জ করে গত ১৮ আগস্ট সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট ব্যক্তি রিট করেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট ১৯ আগস্ট রুল দেন। রুলে পঞ্চদশ সংশোধনী আইন কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। এ রুলে ইন্টারভেনার (আদালতকে সহায়তা করতে) হিসাবে বিএনপি, গণফোরাম, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, সংস্থা, ব্যক্তিসহ বেশ কয়েকজন যুক্ত হন। শুনানিতে রিট আবেদনকারী, বিএনপি, রাষ্ট্রপক্ষ, জামায়াত, গণফোরাম, ব্যক্তি ও সংস্থার পক্ষে তাদের আইনজীবীরা বক্তব্য তুলে ধরেন। অন্যদিকে পঞ্চদশ সংশোধনী আইনের ১৬টি ধারার বৈধতা নিয়ে নওগাঁর রানীনগরের নারায়ণপাড়ার বাসিন্দা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মোফাজ্জল হোসেন গত অক্টোবরে একটি রিট আবেদন করেন। এ রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২৯ অক্টোবর হাইকোর্টের একই বেঞ্চ রুল দেন। রুলে আইনের ওই ধারাগুলো কেন সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। রুলের ওপর দ্বাদশ দিনে ৪ ডিসেম্বর শুনানি শেষ হয়। পরদিন আদালত রায়ের জন্য ১৭ ডিসেম্বর তারিখ রাখেন। এর ধারাবাহিকতায় পর্যবেক্ষণসহ রুল আংশিক যথাযথ (অ্যাবসলিউট) ঘোষণা করে রায় দেন। মঙ্গলবার সকাল ১০টা ৫২ মিনিটে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা শুরু করেন। রায়ের মূল অংশ পাঠ করেন জ্যেষ্ঠ বিচারপতি ফারাহ মাহবুব। রায় ঘোষণা শেষে পঞ্চদশ সংশোধনী মামলাসংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের ধন্যবাদ জানিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, এত বড় ও গুরুত্বপূর্ণ মামলা নিয়ে আপনারা একজন নারী বিচারপতির বেঞ্চে এসেছিলেন। একজন নারী বিচারপতির ওপর আস্থা রেখেছেন, এ কারণে আপনাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। এটা আমার জন্য বড় পাওয়া। এ রায় দিতে পেরে আমি গর্বিত। আমি মনে করি, নারী জাতির জন্য এটি গর্বের বিষয়। বিচারপতি ফারাহ মাহবুব বলেন, এ রায় দেওয়ার সময় আমরা জনগণের চাওয়া ও অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করেছি। এ সময় আইনজীবীরাও তার প্রতি কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ জানান।

আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদ উদ্দিন, রিটকারীর পক্ষে সিনিয়র আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া, সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার এএম মাহবুব উদ্দিন খোকন, ব্যারিস্টার বদরুদ্দোজা বাদল, ব্যারিস্টার রুহুল কুদ্দুস কাজল, অ্যাডভোকেট ফারজানা শারমিন পুতুল, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির ও ব্যারিস্টার এহসান সিদ্দিকী। ইনসানিয়াত বিপ্লবের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট ইশরাত হাসান, চার আবেদনকারীর পক্ষে ছিলেন ব্যারিস্টার জুনায়েদ আহমেদ চৌধুরী এবং ইন্টারভেনর হিসাবে ছিলেন ব্যারিস্টার হামিদুল মিসবাহ।

আদালত পর্যবেক্ষণে বলেন, গণতন্ত্র হচ্ছে আমাদের সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশ। এ গণতন্ত্র বিকশিত হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ এবং প্রভাবমুক্ত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। কিন্তু দলীয় সরকারের অধীনে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচনে তাতে জনগণের ইচ্ছার কোনো প্রতিফলন হয়নি। দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচনের আত্মবিশ্বাস জনগণের মধ্যে জন্ম নেয়নি। যার ফলে হয়েছে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান। রায়ে হাইকোর্ট বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা জনগণের অভিপ্রায় অনুযায়ী সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এবং এটি সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর অংশে পরিণত হয়েছে।

রায়ের পর রিটকারীর আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, তারা পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চেয়েছিলেন। আদালত বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করলেও অন্যগুলো বাতিল করেননি। আদালত বলেছেন, বাকিগুলোর বৈধতাও তিনি দিচ্ছেন না। সেগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দিয়েছেন। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো রাখতে পারে অথবা বাতিল করতে পারে।

রিটকারী আইনজীবী শরীফ ভূঁইয়া বলেন, আদালত বলেছেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি অংশ। যেহেতু নির্বাচন, গণতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামো, যেহেতু তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করেছে; সেহেতু এটি সংবিধানের একটি মূল কাঠামো। এটি ঐতিহাসিক রায়। শরীফ ভূঁইয়া বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দূর হলো। তবে সেটি এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না; কারণ, সেটি বাতিল করা হয়েছিল দুইভাবে। আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। তিনি বলেন, বদিউল আলম মজুমদার ও আরও চারজন এ বিষয়ে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেছেন। জানুয়ারিতে শুনানি হবে। সেটা আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরবে।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম