বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের প্রতিক্রিয়া
জনগণের প্রত্যাশা পূরণে একধাপ অগ্রগতি
তারিকুল ইসলাম
প্রকাশ: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
হাইকোর্টের রায়ে বহুল আলোচিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল হওয়ায় সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল। নেতাদের মতে, এ রায়ের মধ্য দিয়ে দেশের জনগণের মনের আশা পূর্ণ হয়েছে। ভোটারের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠিত হলো। এর ফলে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তীতে নতুন বাংলাদেশের জনপ্রত্যাশা পূরণে একধাপ বড় অগ্রগতি হয়েছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসাবে কাজ করবে কিনা, এ বিষয়টিসহ কয়েকটি প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ। অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বোঝাপড়া করে এ ব্যাপারে একটি ঐকমত্যের জায়গায় পৌঁছানের বিষয়েও তাগিদ দিয়েছে ন দলগুলোর শীর্ষ নেতারা।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় মঙ্গলবার অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। একই সঙ্গে সংবিধানে গণভোটের বিধান ফিরিয়ে এনেছেন উচ্চ আদালত। তবে পঞ্চদশ সংশোধনী পুরোটা বাতিল করা হয়নি এই রায়ে। জাতির জনক, ৭ মার্চসহ এর কয়েকটি ধারা ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখেছেন আদালত। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, আমরা গত ১৪ বছর দেশের গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার দাবিতে ও দেশে স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার আন্দোলন করেছিলাম। এর সঙ্গে অন্যতম দাবি ছিল এই সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর বিষয়টি। আমরা পঞ্চদশ সংশোধনীও বাতিল চাচ্ছিলাম এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃস্থাপনের বিষয়েও আমাদের দাবি ছিল। এটা জনগণের দাবি ছিল। উচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ জানাই জনগণের এই প্রত্যাশা পূরণ করেছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ যাতে স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারে, সেজন্য এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া আমাদের সংবিধানে সন্নিবেষ্টিত করেছিলেন। তিনবার স্বাধীনভাবে ভোট দিতে পারায় এদেশের জনগণ ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করেছিল। তাই এটা প্রমাণিত, এ দেশের জনগণ পারে ভোটের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করতে। এটাই তো গণতন্ত্র। কিন্তু শেখ হাসিনা স্বৈরাচারী শাসন এবং ফ্যাসিস্ট পদ্ধতিতে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য গণতন্ত্রকে হত্যা করেছে এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীতে আওয়ামী লীগ নেতার বক্তৃতা সংবিধানে সন্নিবেষ্টিত করেছে, যা কখনো কোনো দেশের সংবিধানে নেই। সেজন্য এটা ছিল অসাংবিধানিক। হাইকোর্ট এটাই রায় দিয়েছে যে, পঞ্চদশ সংশোধনী সংবিধানবহির্ভূত ছিল। আমরা হাইকোর্টকে ধন্যবাদ জানাই। এর মাধ্যমে জনগণের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। এখন বর্তমান সরকারের দায়িত্ব তারা দক্ষতার সঙ্গে অতি দ্রুত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার এদেশে প্রতিষ্ঠিত করে একটি নির্বাচন দেওয়া, যে নির্বাচনে জনগণ তাদের ইচ্ছামতো স্বাধীনভাবে ভোট দিয়ে একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করবে। সেই সরকার বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার এক বিবৃতিতে বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১১ সালের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাশ হয়। এই সংশোধনীর মাধ্যমে জনগণের ভোট ও নির্বাচনব্যবস্থাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করা হয়েছিল। এই সংশোধনীর মাধ্যমে বিনা ভোটে ক্ষমতা দখলের প্রবণতা তৈরি হয়। ফলে গত ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে বাংলাদেশে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। নির্বাচনের নামে তামাশা হয়েছে মাত্র। মূলত পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। দেশের উচ্চ আদালতের রায়ে জনগণের অধিকার পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হলো। এটি জনগণের আরেকটি বিজয়।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, রায়ের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা পূরণে একধাপ অগ্রগতি হয়েছে। তিনি বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরে আসায় জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছে। তবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আমাদের জাতিসত্তার রক্ষাকবচ সংবিধানের মূলনীতিতে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে দিলে দেশের মানুষ আরও বেশি উৎফুল্ল হতো এবং জাতীয় সংহতি আরও মজবুত হতো।
তিনি বলেন, শুধু তত্ত্বাবধায়ক সরকার নয় আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে এনে আওয়ামী আমলের সব সংশোধনী বাতিল করা জনগণের প্রাণের দাবি। বিগত সময়ে আওয়ামী লীগ ভারতের আজ্ঞাবহ হয়ে তাদের আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদকে টিকিয়ে রাখতে সংবিধানের যে অবৈধ সংশোধনী এনেছে তার সবকিছু বাতিল করতে হবে।
গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলসহ সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে আনা কয়েকটি বিষয় উচ্চ আদালত বাতিল করাটাকে স্বাগত জানাই। আওয়ামী লীগ এটা অন্যায় কাজ করেছিল। গোটা নির্বাচনব্যবস্থার ওপর একটি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য এ কাজ করেছিল আওয়ামী লীগ। এটি জনআকাঙ্ক্ষার পরিপন্থি ছিল। তখন রায়ে বলা হয়েছিল কমপক্ষে দুটি নির্বাচন তত্ত্বাবধায়কের অধীনে হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ সেটা বিবেচনার মধ্যে নেয়নি। আমি মনে করি, এটা জনআকাঙ্ক্ষার সঙ্গে রেখে এই রায়টা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, কিন্তু এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্ন আছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা কিভাবে পুনঃস্থাপিত হবে এরকম চারটি প্রশ্ন এখন গুরুত্বপূর্ণ। এক. ভবিষ্যৎ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়টা কী হবে এটি একটি আলোচনা। দুই. তাদের ক্ষমতা এবং এখতিয়ার কী হবে? তিন. পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে তত্ত্বাবধাক সরকার কিভাবে জবাবদিহি করবে-এটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। আগে যে প্র্যাকটিস ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের, পরবর্তী সরকারের কাছে তাদের কোনো জবাবদিহিতার তেমন কোনো পরিষ্কার করে কিছু ছিল না। সুতরাং তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে অবশ্যই পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের কাছে জবাবদিহি করার একটি বিধানের প্রশ্ন আছে। চার. বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তারাই এখন তত্ত্বাবধায়ক সরকার হিসাবে কাজ করবে কিনা? এসব সমাধানে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে আলাপ-আলোচনা করে একটি ঐকমত্যের জায়গায় আসতে হবে। আর তত্ত্বাবধায়ক সরকার আগামী কয়টি নির্বাচনের জন্য, এটা কি অনন্তকাল চলবে নাকি পরবর্তী দুটি, তিনটি, চারটি নির্বাচন হবে। এসবও আলাপ-আলোচনা করে একটি মীমাংসা লাগবে। রায় হয়েছে। এখন অন্তর্বর্তী সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে বোঝাপড়া করে আমরা মনে হয় এ ব্যাপারে একটি ঐকমত্যের জায়গায় আসতে পারি।