নানা আয়োজনে মহান বিজয় দিবস উদযাপন
বৈষম্যহীন-গণতান্ত্রিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মহান বিজয় দিবসে ফুলেল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় স্মরণ করা হয়েছে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। দেশের জন্য আত্মদানকারী বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধে দেশের শীর্ষ পর্যায় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের ঢল নামে। ১৯৭১ সালে ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় আসার এদিন উদযাপনে রাজধানীসহ সারা দেশেই দিনভর ছিল নানা আয়োজন। রাজধানীসহ আশপাশের মানুষের জন্য বরাবরের মতো এবারও উদযাপনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল সাভারের জাতীয় স্মৃতিসৌধ। পৌষের প্রথম সকালে শীত উপেক্ষা করে জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রবেশের অপেক্ষায় ছিলেন হাজারো জনতা। বিগত বছরগুলোর তুলনায় এবারের বিজয় দিবসে ছিল ভিন্ন আমেজ। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী প্রথম বিজয় দিবসের এসব কর্মসূচিতে বীর শহিদদের আত্মত্যাগের মহিমায় বলিয়ান হয়ে বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়।
ভোরের আলো ফুটতেই শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস এবং বাংলাদেশে সফররত পূর্ব তিমুরের প্রেসিডেন্ট হোসে রামোস হোর্তা। সকাল ৭টার দিকে জাতীয় স্মৃতিসৌধে মহান মুক্তিযুদ্ধে বীর শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন নবনিযুক্ত প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। এ সময় তার সঙ্গে সুপ্রিমকোর্টের অন্য বিচারপতিরা উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী, মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, দেশি-বিদেশি কূটনীতিক শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও বীর শহিদদের শ্রদ্ধা জানানো হয়।
এদিকে রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টাদের আগমন ঘিরে স্মৃতিসৌধের চারপাশে ছিল কঠোর নিরাপত্তা। তারা চলে যেতেই হাজারো মানুষের স্রোত ঢুকে পড়ে স্মৃতিসৌধে। মুহূর্তে যেন বিজয়ের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে। নারীদের কেউ এসেছিলেন লাল-সবুজ শাড়িতে সেজে, পুরুষদের কেউ কেউ পরেছেন পাঞ্জাবি। লাল-সবুজের আধিক্য ছিল শিশুদের পোশাকেও। জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, স্কুল-কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থী, শিশু-কিশোর ও বয়োবৃদ্ধরা ফুলেল শ্রদ্ধা জানান বীর শহিদদের। শ্রদ্ধা জানায় বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি, জাতীয় পার্টি-জাপা, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, গণ-অধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণফোরাম, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, জাগপা, যুবদল, ছাত্রদল, স্বেচ্ছাসেবক দল। শ্রদ্ধা জানায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, বুয়েট, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রসহ সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন।
স্মৃতিসৌধে বীর শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে আসা শিক্ষার্থী তাহমিনা বলেন, আমরা সপরিবারে এসেছি। যাদের জীবনের বিনিময়ে দেশে স্বাধীনতা পেয়েছি তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। আরেক শিক্ষার্থী মাহবুব বলেন, আমরা দেশ স্বাধীন হতে দেখিনি। তবে যারা দেশকে স্বাধীন করেছেন তাদের আত্মত্যাগের কথা আমরা জেনেছি। আমরা নতুন প্রজন্ম তাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি। আগতরা বলেন, ’৭১-এর যুদ্ধের পর ২৪ এর গণ-অভ্যুত্থানে শহিদ সবার জন্য তাদের শ্রদ্ধা ও গভীর ভালোবসার বহিঃপ্রকাশ করতেই এখানে আসা। এ সময় তারা বৈষম্যহীন, গণতান্ত্রিক নতুন বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন।
বিজয় দিবসে সরকারি ছুটির দিনে দেশের সব সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনাগুলোয় করা হয় আলোকসজ্জা। সাজানো হয় ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়কদ্বীপ। এছাড়া দিবস উপলক্ষ্যে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, বাংলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, বাংলাদেশ শিশু একাডেমিসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলোচনা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, শিশুদের চিত্রাঙ্কন, রচনা ও ক্রীড়া প্রতিযোগিতা এবং মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনের আয়োজন করে। দেশের সব জেলা ও উপজেলায় দিনব্যাপী হয় বিজয় মেলা। শিশুদের জন্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।
বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসেও দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে স্মারক ডাক টিকিট প্রকাশ করে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ। চট্টগ্রাম, খুলনা, মোংলা ও পায়রা বন্দর, ঢাকার সদরঘাট, পাগলা (নারায়ণগঞ্জ) ও বরিশালসহ বিআইডব্লিউটিসির ঘাটে, চাঁদপুর ও মুন্সীগঞ্জ ঘাটে বাংলাদেশ নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের জাহাজগুলো দুপুর ২টা থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। এছাড়া দেশের সব শিশু পার্ক ও জাদুঘর সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয় এবং সিনেমা হলে করা হয় বিনামূল্যে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র দেখানোর ব্যবস্থা।
এদিকে বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ সালের সংগ্রাম ও বিজয় স্মরণে র্যালি করেছেন ছাত্র-জনতা। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এ আয়োজন করে। দুপুর ১২টায় কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে বিজয় র্যালি শুরু হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি-শাহবাগ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে আবার শহিদ মিনারে গিয়ে সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয় র্যালি। নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মহান বিজয় দিবস উদযাপিত হয়েছে। ভোরে উপাচার্য ভবনসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ ভবনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) যথাযোগ্য মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস-২০২৪ উদযাপন করেছে। এ উপলক্ষ্যে বিজিবি সদর দপ্তরসহ বাহিনীর সব রিজিয়ন, প্রতিষ্ঠান, সেক্টর ও ইউনিটগুলোতে নানা কর্মসূচি পালন করা হয়।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে পুলিশ স্মৃতিসৌধে শহিদ পুলিশ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.), প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মো. খোদা বখস চৌধুরী ও পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম। রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে পুলিশ স্মৃতিসৌধে শহিদ পুলিশ সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছে বাংলাদেশ পুলিশ নারী কল্যাণ সমিতি (পুনাক)।
বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানীর শাহবাগে জাতীয় জাদুঘরের সামনে ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪-এর বীর শহিদদের স্মরণে স্বাধীনতা সংগ্রামের ছবি প্রদর্শনী, ভিডিও ডকুমেন্টেশন ও শহিদি স্মৃতিকথায় ‘বিজয়ের লাল জুলাই’ শীর্ষক দিনব্যাপী কর্মসূচি পালন করেছে ইনকিলাব মঞ্চ। এদিকে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে ১৩৫ বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সংবর্ধনা প্রদান করেছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। প্রথমে মুক্তিযোদ্ধাদের ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। পরে তাদের মধ্যে প্রাইজমানি বিতরণ করা হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয় প্রাঙ্গণে তাদের এ সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
ডিএনসিসি ওয়ার্ড নং ৪২ (বেরাইদ) : বেরাইদের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো পৃথক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে যথাযথ মর্যাদায় মহান বিজয় দিবস ২০২৪ উদযাপন করেছে। কর্মসূচির মধ্যে ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধে শহিদদের স্মরণে আলোচনা ও দোয়া পাঠ, কবিতা আবৃত্তি, প্রবন্ধ পাঠ, সুন্দর হাতের লেখা, চিত্রাঙ্কন ও সংক্ষিপ্ত ক্রীড়া প্রতিযোগিতা।