তৃতীয় দফায় রিপোর্ট ‘পজিটিভ’
‘অকার্যকর’ কেমিক্যাল গছানো হচ্ছে রেলে
মূল্যবান ইঞ্জিন ঝুঁকিতে পড়ার শঙ্কা

ব্যবহারিক পরীক্ষায় দুই দফায় কার্য-উপযোগী না হওয়া সত্ত্বেও তৃতীয় দফায় পরীক্ষার নামে প্রায় ৭ হাজার লিটার কুলিং এজেন্ট (ইঞ্জিন ঠান্ডা রাখা ও মরিচারোধী কেমিক্যাল) রেলওয়েকে গছিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
চাপ প্রয়োগ এবং মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে তৃতীয় দফায় প্রায় ৩ কোটি টাকা মূল্যের এই কেমিক্যাল গছানোর সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন। ভারত থেকে আমদানি করে এ কেমিক্যাল রেলওয়েকে সরবরাহ করেছে লাকি এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। পরীক্ষায় অনুপযোগী হওয়া এসব কেমিক্যাল ব্যবহার করা হলে রেলের কোটি কোটি টাকার ইঞ্জিন নষ্ট হওয়ার ঝুঁকি তৈরি হবে বলে সংশ্লিষ্টরা আশঙ্কা করছেন।
তাছাড়া প্রাথমিকভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে একটি ইঞ্জিন দুর্ঘটনার কবলে পড়ে বলেও তারা জানান।
জানা গেছে, রেলের ইঞ্জিন ঠান্ডা রাখা ও মরিচা রোধের জন্য কুলিং এজেন্ট নামের কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ টেন্ডারের মাধ্যমে তা সংগ্রহ করে থাকে। ৬ মাস আগে টেন্ডারের মাধ্যমে ৬ হাজার ৯৬০ লিটার কেমিক্যাল (নেলকো-২১০০) সরবরাহ করে লাকী এন্টারপ্রাইজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। রেলের ক্রয় বিভাগ এসব কেমিক্যাল কিনে ভোক্তা বিভাগে পাঠায়। ভোক্তা বিভাগ সংগৃহীত কেমিক্যাল ব্যবহারিক টেস্টে পাঠায়।
সূত্র জানায়, সরবরাহ করা কুলিং এজেন্ট ২৬০০ সিরিজের লোকোমোটিভে (ইঞ্জিন) ব্যবহারিক পরীক্ষার অনুমতি ছিল। সে অনুযায়ী রেলওয়ের ওই সিরিজের ইঞ্জিনে দুই দফায় সরবরাহ করা কেমিক্যাল পরীক্ষা করা হয়। দুই দফায় টেস্টে দেখা যায়, কেমিক্যাল ব্যবহারের পর ইঞ্জিনে দেওয়া পানি স্বচ্ছ থাকার পরিবর্তে ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে। একইভাবে পানিতে আয়রন বা মরিচার উপস্থিতি ধরা পড়ছে। এ অবস্থায় কেমিক্যাল কার্য-উপযোগী নয় বলে মতামত দেয় সংশ্লিষ্ট বিভাগ।
বর্তমানে রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন উপসহকারী প্রকৌশলী (জেনারেল) মফিজ উদ্দিন ফকির যুগান্তরকে বলেন, সরবরাহকৃত কেমিক্যাল ৬ মাস আগে রেলের ২৬০০ সিরিজের ইঞ্জিনে পরীক্ষা করা হয়। এই কেমিক্যাল কার্য-উপযোগী পাওয়া না যাওয়ায় তা অকার্যকর উল্লেখ করে বাতিল করে দেন। এখন শুনছেন তৃতীয় দফায় পরীক্ষা করে তা ‘কার্য-উপযোগী’ হিসাবে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
এই কেমিক্যাল ব্যবহার করে একটি লোকোমোটিভ দুর্ঘটনায় পতিত হয় বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
জানা গেছে, পরে ২৯০০ সিরিজের ইঞ্জিনেও এই কেমিক্যাল ব্যবহারিক পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়। এরপরও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নানাভাবে অকার্যকর কেমিক্যাল গছিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকলে রেলওয়ের ক্রয় বিভাগ, প্রকৌশল বিভাগ ও ভোক্তা বিভাগের কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়।
এক পর্যায়ে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তৃতীয় দফায় এই কেমিক্যাল ব্যবহারিক পরীক্ষা করার আবেদন করেন রেলওয়ে মহাপরিচালক বরাবরে। এবার ৩০০০ সিরিজের ইঞ্জিনে পরীক্ষার অনুমতি নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি।
সূত্র জানায়, তিন হাজার সিরিজের ইঞ্জিন একেবারে নতুন। তাই নতুন ইঞ্জিনে ব্যবহারিক পরীক্ষা করলে রিপোর্ট পজিটিভ আসবে বলে মত দেন তারা। তাদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সর্বশেষ নতুন ইঞ্জিনে আলোচ্য কেমিক্যালের পরীক্ষা করা হয়। এতে পজিটিভ রিপোর্ট আসে। তাই এই কেমিক্যাল গ্রহণ করার পক্ষে মত দেন রেলওয়ে কর্মব্যবস্থাপক (ডিজেল) এহতেশাম মোহাম্মদ শফিক।
রেলওয়ের একাধিক সূত্র জানায়, নতুন বা পুরোনো ইঞ্জিনে ব্যবহারের জন্য আলাদাভাবে কেমিক্যাল বা কুলিং এজেন্ট কেনা হয় না। সব ইঞ্জিনেই সংগৃহীত কেমিক্যাল ব্যবহার-উপযোগী হতে হবে। পুরোনো ইঞ্জিনের জন্য যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয় তা নতুন ইঞ্জিনেও ঝুঁকি তৈরি করবে। মূলত সরবরাহকারীর পক্ষ হয়ে মোটা অঙ্কের ঘুসের বিনিময়ে প্রায় তিন কোটি টাকা মূল্যের অকার্যকর কেমিক্যাল গ্রহণ করার প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ের ডিজেল ইলেকট্রিক লোকোমোটিভ ওয়ার্কশপ, পাহাড়তলীর কর্মব্যবস্থাপক (ডিজেল) এহতেশাম উল হক যুগান্তরকে বলেন, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আলোচ্য কেমিক্যাল তৃতীয় দফায় নতুন ইঞ্জিনে ব্যবহারিক পরীক্ষার পর পরিদর্শন রিপোর্ট পজিটিভ আসে। তাই এই কেমিক্যাল গ্রহণ করার পক্ষে মতামত দিয়েছেন তিনি। এক্ষেত্রে কোনো চাপ বা অন্য কোনো বিষয় নেই। তা ছাড়া আলোচ্য কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে একটি ইঞ্জিন দুর্ঘটনায় পড়ার যে অভিযোগ উঠেছে সেটি সত্য নয় বলেও তিনি দাবি করেন।