পরামর্শক টবি ক্যাডম্যান
হাসিনাকে ফেরত না দিলে বিচার অনুপস্থিতিতেই
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ছবি: সংগৃহীত
ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বলেছেন, অভিযোগ গঠনের পর ভারত সরকারের কাছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত দিতে অনুরোধ জানানো হবে। তারা যদি ফেরত না দেয়, তখন বাংলাদেশ সরকার তার (শেখ হাসিনা) অনুপস্থিতিতে বিচারের বিষয়ে বিবেচনা করবে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের বিশেষ পরামর্শক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছেন টবি ক্যাডম্যান। বুধবার সকালে তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের কাছে এ প্রত্যাশার কথা জানান। এ সময় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম, প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। টবি ক্যাডম্যান বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে অনুরোধ করলে গণতন্ত্র ও আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধা দেখিয়ে শেখ হাসিনাকে ভারত ফেরত পাঠাবে বলে আশা করি। তিনি বলেন, যদি ভারত শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠাতে না চায়, সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) সহযোগিতা নেওয়া যায় কিনা, সেটা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ সরকার ঠিক করবে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যখন একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলছিল, সে সময় অভিযুক্তদের পক্ষের আইনজীবী হিসাবে বাংলাদেশে আসতে চেয়েছিলেন ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান। তখন তাকে আটকে দেওয়া হয়েছিল। এরপরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বাংলাদেশে এসেছিলেন ব্রিটিশ এই আইনজীবী। ২ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন তিনি। বর্তমানে টবি ক্যাডম্যান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটরের বিশেষ পরামর্শক হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত।
টবি ক্যাডম্যান বলেন, আমি আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে চিফ প্রসিকিউটরের পরামর্শক হিসাবে নিয়োগ পেয়েছি। এ পর্যন্ত আমার বাংলাদেশে দুবার আসা হয়েছে। আমি মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন, নীতিমালা ও আন্তর্জাতিকমানের বিচার প্রক্রিয়া চালানোর বিষয়ে পরামর্শ দেব। বিগত সরকারের সময় আন্তর্জাতিক অপারাধ ট্রাইব্যুনালের বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতা অতটা ভালো ছিল না, এটা বলাই যায়। সে সময়ে বিচার প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার বেশি ছিল।
টবি ক্যাডম্যান বলেন, আমি অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে বিভিন্ন আলোচনায় স্পষ্টভাবে বলেছি, এ যাবৎকালে যত বিচার প্রক্রিয়া হয়েছে, তার মধ্যে এবারের বিচার প্রক্রিয়টি খুবই স্বচ্ছ হতে হবে। পাশাপাশি আজ প্রসিকিউটর টিমের সঙ্গে আলোচনা করে যা দেখেছি, তারা খুবই সুন্দরভাবে এই বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনা করছেন। আমি বাংলাদেশের জনগণকে বলতে চাই, এই বিচারকাজের বিষয়ে আপনাদের ধৈর্য ধারণ করতে হবে, যাতে করে প্রসিকিউটর টিম ও তদন্ত সংস্থা সুন্দরভাবে তাদের কাজ করে এই বিচার প্রক্রিয়া পরিচালনা করতে পারে। এবারের বিচার প্রক্রিয়াটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি বলেন, আমার একটাই অনুরোধ থাকবে, আমি যাদের সঙ্গে কাজ করছি, তাদের (প্রসিকিউটর টিম) কাজে যেন কোনো প্রকার পলিটিক্যাল হস্তক্ষেপ না করা হয়। এই বিচার প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক কমিউনিটির পুরো সাপোর্ট থাকবে। এই বিষয়ে আমি জাতিসংঘ, ইউকে গভর্নমেন্ট ও আমেরিকার গভর্নমেন্টসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে আলোচনা করেছি। তারা এ বিষয়ে সম্পূর্ণ সাপোর্ট করেছে। তারা আশাবাদী এই বিচারকাজের মাধ্যমে বাংলাদেশে আবারও আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে।
শেখ হাসিনাকে কীভাবে বা কোন প্রক্রিয়ায় ভারত থেকে এনে বিচার করা হবে, এমন প্রশ্নের জবাবে টবি ক্যাডম্যান বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যেহেতু একটি আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আছে সেহেতু শেখ হাসিনার বিষয়ে ভারত কী সিদ্ধান্ত নেবে, সে বিষয়ে আমি আগাম কোনো প্রতিক্রিয়া দিতে চাই না। ভারত যেহেতু গণতান্ত্রিক দেশ এবং তারা আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই শেখ হাসিনার যদি রায়ের মাধ্যমে সাজা হয়, এ বিষয়ে ভারত বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি সম্মান জানিয়ে তাকে দেশে পাঠাবে। তিনি বলেন, একজন ব্রিটিশ ব্যারিস্টার হিসাবে আমার প্রধান কাজ হচ্ছে, এই বিচার প্রক্রিয়াটি যেন আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও স্বচ্ছ প্রক্রিয়াতে পরিচালিত হয়, সে বিষয়ে প্রসিকিউটর টিমকে সহায়তা করা। এই মামলার আসামির (শেখ হাসিনা) মৃত্যুদণ্ড হবে বা মুক্তি পাবেন, তা সম্পূর্ণ আদালতের বিষয়।
মামলাটি আন্তর্জাতিক আদালতে বিচার করার কোনো সুযোগ আছে কিনা, এমন প্রশ্নের জবাবে টবি ক্যাডম্যান বলেন, প্রথমত বাংলাদেশ হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের মেম্বার। তাই এখানে বাংলাদেশ যদি কোনো কারণে এই বিচারকাজ পরিচালনায় ব্যর্থ হয় ও অপারগতা প্রকাশ করে, তাহলে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্টের জুরিসডিকশন আছে, এ বিষয়ে নিজ থেকে বিচারকাজ পরিচালনা করতে পারবে। যেভাবে পুতিন ও নেতানিয়াহুর বিষয়ে করা হচ্ছে। তবে আন্তর্জাতিক ক্রিমিনাল কোর্ট সব সমস্যার সমাধান নয়।
এ সময় ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম বলেন, “টবি ক্যাডম্যান আমাদের প্রসিকিউশন এবং তদন্ত সংস্থার সঙ্গে বসেছেন। আমরা এখন পর্যন্ত যেসব কাজ করেছি, তিনি তাতে সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। তিনি এটাও বলেছেন, ‘যেসব আইন সংশোধন’ হয়েছে, সেগুলো খুব কাজের হয়েছে। দু-একটা ব্যাপারে আরও সংশোধন হতে পারে, সেই ব্যাপারে আমরা প্রসিকিউটর ও তদন্ত সংস্থার সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাব দেব।”
মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম আরও বলেন, মৃত্যুদণ্ড থাকলে যেসব দেশ বন্দি বিনিময় করতে চায় না, তাদের বিষয়ে তিনি (টবি ক্যাডম্যান) বলেছেন, ‘বাংলাদেশের বাস্তবতা আলাদা। এই মামলার ব্যাপারে যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান আছে, সেই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা হচ্ছে আদালতের। আদালতই ঠিক করবেন, মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে কি হবে না। বাংলাদেশ সরকার এই মৃত্যুদণ্ড বাতিল করবে কিনা, এটা বাংলাদেশের জনগণের চাহিদা ও এই রাষ্ট্রের বাস্তবতার আলোকে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। এই ব্যাপারে আমাদের কিছু বলার নেই।’ টবি ক্যাডম্যানের বক্তব্যের বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর আরও বলেন, ‘অতীতের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জানতেন, কী কারণে এই ট্রাইব্যুনাল বিতর্কিত হয়েছে এবং কোথায়, কী সমস্যা রয়েছে, সেটা তিনি জানেন এবং বোঝেন। সে কারণে তিনি আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন এবং আমাদের পরামর্শ দিচ্ছেন যে অতীতে যে ভুলগুলো হয়েছে, সেগুলো যাতে আর কখনো না হয়। ফ্রি, ফেয়ার অ্যান্ড ইম্পার্শিয়াল একটি ট্রায়াল যাতে হয়। আন্তর্জাতিক মহলের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা বিচার যেন হয়, সেই ব্যাপারে প্রসিকিউশন সংস্থাকে তিনি পরামর্শ দেবেন, সহযোগিতা করবেন। দুনিয়ার কাছে যাতে একটি গ্রহণযোগ্য বিচার হিসাবে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই ব্যাপারে তিনি তার সব ধরনের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখবেন।’
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালে আসামিরা চাইলে বিদেশি পরামর্শক রাখতে পারবেন, তবে আইনজীবী নিয়োগ দিতে হলে বার কাউন্সিলের অনুমতি লাগবে বলেও জানিয়েছেন ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম।