বাংলাদেশ-ভারত বৈঠক প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞ অভিমত
ইতিবাচক তবে ইঙ্গিত নেই সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার
আশা করি, প্রতিবেশী হিসাবে দুই দেশ স্বাভাবিক সম্পর্কের জায়গায় পৌঁছাতে পারবে -এম হুমায়ুন কবির * দুই দেশেই সরকার আসবে-যাবে, এটি মেনে নিয়েই সব সময় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হয় -এম সফিউল্লাহ
হক ফারুক আহমেদ
প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
ভারত ও বাংলাদেশের অবনতি হওয়া সাম্প্রতিক সম্পর্কের মধ্যেই দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে সোমবার। আলোচনা হয়েছে তিক্ততা বৃদ্ধি করা নানা ইস্যুসহ পারস্পরিক সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নিয়ে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি। পুরো বিষয়টিকে ইতিবাচক হিসাবে দেখছেন কূটনৈতিকসহ সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব বা কর্মপরিকল্পনা না থাকায় দুই দেশকেই সামনের দিনগুলোর দিকে লক্ষ রাখতে হবে। তবে এ বৈঠককে ‘আইস ব্রেকিং’ হিসাবে আখ্যায়িত করছেন তারা।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির যুগান্তরকে বলেন, পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে। এ আলোচনাটি চালু ছিল এবং চালু থেকেছে সবসময়। এটি একটি ইতিবাচক জায়গা। এখানে দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় নিয়েই খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। এটিও আরেকটি ইতিবাচক দিক। তিনি বলেন, এটি অবস্থার কতটুকু পরিবর্তন করবে, সেটি এখনো আমরা বলতে পারি না। কারণ, মিটিংয়ে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নেই। আলোচনার পর দুই দেশেরই পররাষ্ট্র সচিব কথা বলেছেন বাইরে। ভারতের দিক থেকেও কথা বলা হয়েছে। সেখানেও কোনো সুনির্দিষ্ট কিছু অর্জন হয়েছে, সেটি তারা বলেননি। দুই পক্ষ আলাপ-আলোচনা করেছে। বাংলাদেশ তার বক্তব্য দিয়েছে। ভারত তাদের বক্তব্য দিয়েছে। যদিও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বলেছেন তারা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশে ভারতের কূটনীতি জনগণকেন্দ্রিক এবং তারা বিভিন্ন প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহায়তা করেন। তাদের উদ্দেশ্য জনগণকেন্দ্রিক কূটনীতিই পরিচালনা করা। অতীতেও ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে।
এম হুমায়ুন কবির বলেন, চলমান কিছু সমস্যা আছে। এর মধ্যে ভিসা ইস্যু, কানেকটিভিটি ইস্যু-এগুলো নিয়ে কোনোরকম সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত বা অগ্রগতির কোনো কিছু বলা হয়নি। পাশাপাশি আস্থার যে সংকট আছে, সেটি নিরসনের জন্য কী করা হবে, সেটিও কিন্তু বলা নেই।
তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা আলোচনা চালাচ্ছি। এটি ইতিবাচক। কিন্তু এরপর কী ফল হবে, কোনদিকে যাব-এটি নিয়ে অবস্থানের কোনো পরিবর্তন হয়েছে বা কোনো ইঙ্গিত পাওয়া গেছে, তেমনটি দেখা যাচ্ছে না। তবে আশাবাদী হতে চাই। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব যেহেতু আমাদের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে ফরেন অফিস ডায়ালগ করেছেন, পররাষ্ট্র উপেদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করেছেন-এখন তাদের মধ্যে একটি মূল্যায়ন নিশ্চয়ই আসবে। আশা করি, প্রতিবেশী হিসাবে দুই দেশ স্বাভাবিক সম্পর্কের জায়গায় পৌঁছাতে পারবে। আগামী দিনে সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনার ইঙ্গিত হয়তো পাব।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম সফিউল্লাহ বলেন, বিগত চার মাস শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং ভারতে পলায়নের পর বাংলাদেশের পরিস্থিতি উত্তাল ছিল। শেখ হাসিনা তার পলায়নের আগে বাংলাদেশকে একটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেন এবং আইনশৃঙ্খলাসহ সব পরিস্থিতি নষ্ট করেন। আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের সঙ্গী হিসাবে তাদের সঙ্গে সংসদ-সদস্য, নেতাকর্মী থেকে সব জায়গায় সব ধর্ম ও পেশার লোক ছিলেন। গণ-অভ্যুত্থানপরবর্তী সময়ে যখন দেশে কয়েকদিন কোনো সরকার ছিল না, তখন যারা অত্যাচারিত হয়েছিল, তারা ওইসব নেতাকর্মী যারা জুলুম করেছিল, তাদের ওপরই আক্রমণ করে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভারত এটি বুঝতে ভুল করেছে। তারা মনে করেছে, শুধু হিন্দুদের ওপর আক্রমণ হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বিষয়ে ভারতের সরকারি পর্যায়ে এবং গণমাধ্যমে যে বিরূপ প্রচার-প্রচারণা চালানো হয়েছে, আলটিমেটলি এটি দুই দেশের সম্পর্কের জন্য ক্ষতিকর। এটি দুই দেশের মানুষের মধ্যে তিক্ততা সৃষ্টি করেছে। ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশেই সরকার আসবে-যাবে, এটি মেনে নিয়েই সবসময় সম্পর্ক এগিয়ে নিতে হয়। কিন্তু ভারত সে পথে না গিয়ে বরং বাংলাদেশের ওপর দোষারোপ করেছে। আমরা বারবার টেবিলে এসে আলোচনার কথা বলেছি। কারণ, কূটনৈতিক সমাধান ছাড়া অন্য কোনোভাবে শান্তিপূর্ণভাবে সমাধান করা যায় না। শেষ পর্যন্ত ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের রুটিন মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। এটি প্রতিবছর হয়। আমাদের সন্দেহ ছিল তারা আসবে কি না। কারণ, তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ককে তিক্ততার পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
এম সফিউল্লাহ আরও বলেন, তারা এসেছেন, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব তার বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব তার বক্তব্য দিয়েছেন। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক সূচনা। দুই দেশের সম্পর্কে যে ‘ফ্রোজেন’ অবস্থা ছিল, সেখান থেকে বিষয়টি ‘আইস ব্রেকিং’ পদক্ষেপ। মিটিংয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষ থেকে যার যার বক্তব্য পরিষ্কারভাবে দেওয়া হয়েছে। কেউ কাউকে আক্রমণ করেছে-এমন বিষয় ছিল না। তাদের ব্যাখ্যা তারা করেছে। পারসেপশনটুকু তুলে ধরেছে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকেও যা বলা দরকার, সব বলা হয়েছে।
তিনি বলেন, এটি একটি প্রথম পদক্ষেপ। এতেই যে সফলতা আসবে, বিষয়টি এমন নয়। এখন বাংলাদেশ তাদের বিভিন্ন পর্যায়ে এনগেজড হবে। ভারতের গণমাধ্যমও সংযত আচরণ করবে বলে আশা করি। ভারতের সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা তাদের শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিরা আর নানা সময়ে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করবে না। তিনি আরও বলেন, প্রথমবার সরকারি পর্যায়ে এ মিটিংয়ের মানে, যার যার অবস্থান তুলে ধরা এবং সেটির ফিডব্যাক দেওয়া। আমরা যা বলেছি, এর ফিডব্যাক তারা পেয়েছে আবার তারা যা যা বলেছে, সেটার ফিডব্যাকও আমরা দিয়েছি। পরবর্তী পদক্ষেপগুলো এটিকেই অনুসরণ করবে। এখান থেকে যার যার বিষয়গুলোকে আমলে নিয়ে কীভাবে তিক্ততা কমিয়ে আনা যায়, সম্পর্কের উন্নয়ন করা যায়, সেই চেষ্টা থাকবে বলে আশা করি। দুই প্রতিবেশী দেশ হিসাবে আমাদের চিরজীবন থাকতে হবে। দুই দেশেরই, বিশেষ করে ভারত আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করে তার কোনো লাভ হবে না। এতে ভারত-বাংলাদেশ উভয়ের ক্ষতি হবে। প্রতিবেশী হিসাবে আমরা একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। এটি সবার মনে রাখতে হবে।
তিনি বলেন, ভারত বলেছে বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক, গঠনমূলক পারস্পরিক স্বার্থনির্ভর সম্পর্ক চায় তারা। এটি অত্যন্ত ইতিবাচক বক্তব্য। আরও বলেছে, ঢাকার সঙ্গে কাজ করতে চায় দিল্লি। সংকট কাটিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে কাজ করতে চায় ভারত। এর মানে, ভারত এতদিন বাংলাদেশের এই সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি। পররাষ্ট্র সচিবের সফরের মাধ্যমে এবং দ্বিপাক্ষিক উচ্চপর্যায়ের মিটিংয়ের মাধ্যমে ভারত তাদের স্বীকৃতি রাখল। তারা আরও বলেছে, চলমান থাকবে উন্নয়ন প্রকল্প। গত চার মাস কোনো কাজ হয়নি। সেটি নতুন করে আবার শুরু হবে। এটিকে সামনের দিকে যাওয়ার জন্য একটি ব্র্যাকগ্রাউন্ড হিসাবে ধরা যায়। কূটনৈতিকভাবে বিষয়টিকে আমরা এভাবে দেখতে চাই-আর যেন পেছনের দিকে না যেতে হয়। ভারত যেন সামনের দিকে যেতে পদক্ষেপ রাখে। তিনি বলেন, এখন থেকে আমরা দৃষ্টি রাখব ভারতের মিডিয়াগুলো কীরকম ভূমিকা রাখে। তাদের সরকারি কোনো বিবৃতি আসে কি না বা তাদের রাজনৈতিক নেতারা কোনো বিরূপ মন্তব্য করেন কি না। তারা কী করছে, সেটা আমাদের যেমন লক্ষ রাখতে হবে আবার আমরা কী করছি, সেটা তারাও নিশ্চয়ই লক্ষ রাখবে। তবে তারা এতদিন একটি আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে ছিল। আমরা আশা করব, সেটি এখন অনেকটাই কমে আসবে। হিংসাত্মক কোনো মনোভাব আর আসবে না মনে করে আমরা সম্পর্কের উন্নতির বিষয়ে আশা রাখতে পারি।