বাংলাদেশ-ভারত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক
সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একমত
সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রশ্নে ভারতে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু, এ নিয়ে অন্য দেশের নাক গলানো আমরা পছন্দ করি না; ভারতে থেকে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বক্তব্যও বাংলাদেশের পছন্দ নয়-মো. জসিম উদ্দিন * বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক স্বার্থের সম্পর্ক চায় ভারত; সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ আছে; অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে আগ্রহী-বিক্রম মিশ্রি
![Icon](https://cdn.jugantor.com/uploads/settings/icon_2.jpg)
কূটনৈতিক প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
![সম্পর্ক এগিয়ে নিতে একমত](https://cdn.jugantor.com/assets/news_photos/2024/12/10/Untitled-design-(18)-67576bd790a46.jpg)
বাংলাদেশের সঙ্গে ইতিবাচক, গঠনমূলক এবং পারস্পরিক স্বার্থের সম্পর্ক চায় ভারত। এই সম্পর্কের কেন্দ্রে থাকবে জনগণ। অতীতেও সম্পর্ক জনগণকে ঘিরেই ছিল। ভবিষ্যতেও দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার প্রেরণা হবে জনগণ। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে ভারত নিবিড়ভাবে কাজ করতে আগ্রহী। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি সোমবার ঢাকায় এমন মন্তব্য করেছেন। ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে উত্তেজনার মধ্যে দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিক্রম মিশ্রির এক দিনের এই ঝটিকা সফরকালে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে তিনি সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন। পাশাপাশি পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গেও তার সাক্ষাৎ হয়েছে। তবে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় আনুষ্ঠানিক বৈঠক করেছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিনের সঙ্গে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতের পর সাংবাদিকদের সামনে দেওয়া মন্তব্যে ভারতীয় সচিব সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং সাংস্কৃতিক ও কূটনৈতিক স্থাপনায় হামলার বিষয়ে দিল্লির উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে একমত হয়েছে দুই দেশই।
পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে আস্থার ঘাটতি রয়েছে। সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রশ্নে ভারতে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। এই ইস্যুটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যু যা নিয়ে অন্য দেশের নাক গলানো ঢাকার পছন্দ নয়। তবে এই ইস্যুতে বাংলাদেশ একটি ‘খোলা বই’ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদেশি সাংবাদিকসহ সবাই পরিস্থিতি নিজেরা দেখতে পারেন। বৈঠকে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত চায়নি বাংলাদেশ। এ বিষয়ে রাজনৈতিক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত হলে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে ভারতে থেকে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক বক্তব্য বাংলাদেশের পছন্দ নয় বলে জানানো হয়েছে। ভারতীয় পররাষ্ট্র সচিব বিষয়টি নোট নিয়েছেন বলে জানান পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন। বাংলাদেশের সঙ্গে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের নজরে আনা হয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি সকালে একটি বিশেষ বিমানযোগে ঢাকায় পৌঁছান। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ এশিয়া অনুবিভাগের মহাপরিচালক ইসরাত জাহান বিমানবন্দরে তাকে স্বাগত জানান। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রতিবেশী ভারতের তরফে এটিই প্রথম উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির বাংলাদেশ সফর। শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রথম দিকেই তাকে অভিনন্দন জানান। সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্করের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্তের আলোকে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব দুই দেশের মধ্যে ‘ফরেন অফিস কনসালটেশন’-এ অংশ নিতে এই সফর করলেন। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের পর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিক্রম মিশ্রি সাংবাদিকদের বলেছেন, আজকের বন্ধুত্বপূর্ণ, সৌহার্দ্যপূর্ণ এবং গঠনমূলক মতবিনিময় হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্পসমূহ অব্যাহতভাবে এগিয়ে নিতে হবে। এসব হলো পারস্পরিক স্বার্থে সম্পৃক্ত থাকার উদাহরণ। আমরা ব্যবসা-বাণিজ্য, কানেকটিভিটি, বিদ্যুৎ, পানি ও জ্বালানি, উন্নয়ন সহযোগিতা, কনস্যুলার সহযোগিতা এবং সাংস্কৃতিক সহযোগিতার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছি। তিনি প্রশ্ন রাখেন, আমাদের উভয় দেশের জনগণের স্বার্থে কেন আমরা এসব বিষয় এগিয়ে নিয়ে যাব না?
ভারতীয় সচিব আরও বলেন, আমরা সাম্প্রতিক কিছু ঘটনাবলি নিয়ে আলোচনা করেছি। সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তাসহ আমাদের কিছু উদ্বেগের কথা জানিয়েছি। সাংস্কৃতিক, ধর্মীয় এবং কূটনৈতিক স্থাপনায় হামলার মতো দুঃখজনক ঘটনা নিয়েও আমরা আলোচনা করেছি। বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষের কাছে আমরা গঠনমূলক দৃষ্টিভঙ্গি প্রত্যাশা করি। আমরা সম্পর্ককে ইতিবাচক, সামনে তাকানো এবং গঠনমূলক দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রতি তাকিয়ে আছি।
বিকালে পররাষ্ট্র সচিব মো. জসিম উদ্দিন সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে বলেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। এই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্ককে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে একমত হয়েছে। দুই দেশের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে খোলামনে আলোচনা হয়েছে। অনিষ্পন্ন বিষয়ে একযোগে কাজ করার বিষয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছি। দুই দেশের সাধারণ জনগণের মধ্যে আস্থা ও বিশ্বাস বিনির্মাণের প্রতি জোর দিয়েছি। বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক প্রচারণা রোধে ভারতের সক্রিয় ভূমিকা কামনা করেছি। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ভারতের গণমাধ্যমে মিথ্যা তথ্য এবং বিভ্রান্তিকর বয়ান রয়েছে। এ বিষয়ে ভারত সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছি। বাংলাদেশে সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্মচর্চা করে আসছে। এ বিষয়ে বিভ্রান্তি কিংবা অপপ্রচারের সুযোগ নেই। একই সঙ্গে এটিও বলেছি যে, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। বাংলাদেশ কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্তব্য করে না। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো আমরা পছন্দ করি না।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনা আমাদের অগ্রাধিকার। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি জীবন মূল্যবান। এই লক্ষ্যে ভারত সরকারকে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ করি। আজকের আলোচনায় আন্তঃনদীর পানিবণ্টন নিয়ে আলোকপাত করেছি। আমি তিস্তার পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদনের আহ্বান জানাচ্ছি। গঙ্গার পানিবণ্টন চুক্তির মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হয়ে যাবে। আমরা চুক্তিটি নবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করার আহ্বান জানাচ্ছি। বন্যার পূর্বাভাস ও ডাটা আদান-প্রদানের আহ্বান জানিয়েছি। বাণিজ্য ক্ষেত্রে অশুল্ক বাণিজ্য বাধা দূর করার আহ্বান জানিয়েছি। ভারত থেকে নিত্যপণ্য নিরবচ্ছিন্ন পাঠানোর অনুরোধ জানিয়েছি। নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুৎ আমদানি ভারতের সহযোগিতা প্রয়োজন। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে ভারতের সহযোগিতার জন্য আহ্বান জানিয়েছি। ভারতের ভিসাপ্রাপ্ত সহজীকরণের জন্য আমরা আহ্বান জানিয়েছি।
শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা নিয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্র সচিব জসিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীকে ফিরিয়ে আনার একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। যখন এই সিদ্ধান্ত হবে তখন প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গ্রহণ করবে। সেটার জন্য ফরেন অফিস কনসালটেশনের কোনো প্রয়োজন নেই। কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ হতে পারে কিংবা ভারতীয় মিশনের মাধ্যমে যোগাযোগ সম্ভব। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ভারতে অবস্থান করে যেসব বক্তব্য রাখছেন সে বক্তব্যের প্রতি আমরা দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। গতকালও প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী একটি বক্তব্য দিয়েছেন। সেই বক্তব্য সরকার পছন্দ করছে না। তারা বলেছেন, এই বাস্তবতা সত্ত্বেও তারা বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাইছে। তিনি (ভারতীয় সচিব) অবশ্য আমাদের বক্তব্য নোট নিয়েছেন।