দুর্নীতিবিরোধী দিবসে আসিফ নজরুল
দুদক ও বিচার বিভাগ ছিল হাসিনার দাস
বিভিন্ন আড্ডায় শুনতাম শেখ হাসিনা শেখ রেহানার ক্যাশিয়ার কে * দুই সংস্থা মিলে খালেদাকে দণ্ড দেয় * দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি বিব্রতকর -ড. ইফতেখারুজ্জামান
যুগান্তর প্রতিবেদন
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিচার বিভাগকে শেখ হাসিনার দাসে পরিণত করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, কোনো টাকা আত্মসাৎ না করলেও দুদক ও বিচার বিভাগ মিলে খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের দণ্ড দিয়েছিল। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ও দুদক সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, দুদকের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতির যেসব তথ্য পাচ্ছি তা বিব্রতকর। যা এতদিন শুনেছি দুদকের ভেতরে তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি দুর্নীতি ও বৈষম্য হচ্ছে। সোমবার সকালে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উপলক্ষ্যে রাজধানীর কাকরাইলে বাংলাদেশ ডিপ্লোমা ইন ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে আলোচনা অনুষ্ঠানে তারা এসব কথা বলেন। আসিফ নজরুল অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও ড. ইফতেখারুজ্জামান বিশেষ অতিথির বক্তব্য দেন।
শেখ হাসিনা সরকারের আমলে দুর্নীতির বিচার হতো না বলে অভিযোগ করে আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, দুর্নীতির বিচার তো হতোই না, দুর্নীতি যে একটা খারাপ জিনিস এটা ভাবার সংস্কৃতিও আমাদের সমাজ থেকে চলে গিয়েছে। গত ১৫ বছরের দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলেন, ১০০ টাকার বালিশ চার থেকে পাঁচ হাজার টাকায় কেনা হয়েছে। আমরা দেখলাম ছয়টি ব্যাংক লুটপাট হয়েছে। বাংলাদেশের একজন সাধারণ ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ধনীর তালিকায় জায়গা করে নিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সময় ছিনতাইকারী হিসাবে পরিচিত এক লোক হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছে। আমরা দেখলাম একটা বেহায়া প্রধানমন্ত্রী; তার পিয়ন ৪০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছে; এটা হাসতে হাসতে জাতির সামনে বলছে।
বিভিন্ন আড্ডায় শেখ হাসিনার দুর্নীতির গল্প জায়গা করে নিয়েছিল উল্লেখ করেন আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, বিভিন্ন আড্ডায় শুনতাম শেখ হাসিনার ক্যাশিয়ার কে, শেখ রেহানার ক্যাশিয়ার কে? সালমান কার ক্যাশিয়ার, জয়ের টাকা কার মাধ্যমে যায়? পলক কার টাকা রাখে? ওইসব দুর্নীতির ঘটনায় দুদক ও উচ্চ আদালত থেকে বিচার করা হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, দুদক-উচ্চ আদালত ছিল, কিন্তু এসব দুর্নীতিবাজের বিচার হয়েছে? কিচ্ছু হয়নি। খালেদা জিয়ার সাজা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দুদকের দায়ের করা জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেন বিচারিক আদালত। পরে হাইকোর্ট এ সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর করেন। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সাজা স্থগিত করে মামলাটি শুনানি করছেন আপিল বিভাগ। সেখানে দুর্নীতি হয়নি, প্রক্রিয়াগত ভুল ছিল দাবি করে দুদক ও বিচার বিভাগ মিলে খালেদা জিয়াকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিল। শেখ হাসিনার পুরো পরিবার চোর ছিল; দুদক ও বিচার বিভাগকে তার দাসে পরিণত করেছিল বলে উল্লেখ করে আসিফ নজরুল বলেন, ৩ কোটি টাকা এক জায়গায় রেখেছে। এক টাকাও সেখান থেকে আত্মসাত করেনি। মানে ভোগ করেননি। ৩ কোটি টাকা ব্যাংকে থেকে ৬ কোটি টাকা হয়েছে। ওই টাকা কেউ টাচ করেনি। সেজন্য তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে ১০ বছরের জেল দিয়েছে দুদক-বিচার বিভাগ মিলে। আর সেই চোর প্রধানমন্ত্রী, যার পুরো পরিবার ছিল চোর, সে সারা দেশে বলে বেড়াত এতিমের টাকা নাকি খালেদা জিয়া আত্মসাৎ করেছেন। এই চোরের মুখের সামনে কেউ কথা বলতে পারত না। দুদক তার দাসে পরিণত হয়েছিল, বিচার বিভাগ তার দাসে পরিণত হয়েছিল। সাত মাস আগে একটি ফ্ল্যাট নিবন্ধন করাতে গেলে আমার কাছেও ১০ লাখ টাকা ঘুস দাবি করা হয়েছিল।
আইন উপদেষ্টা বলেন, আওয়ামী লীগের আমলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুদক কর্মকর্তারা কাজ করতে পারেনি। কিন্তু এখন পরিবেশ বদলেছে। এখন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিন। এখন তদন্ত করেন, প্রমাণ করেন যে, ভালো পরিবেশ পেলে আপনারা ভালো কাজ করতে পারেন। গত আমলে চুরি করে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক যারা হয়েছে, তাদের অনেকের বিরুদ্ধে তদন্ত করার অ্যাপ্রোভাল দিয়ে গেছেন মোহাম্মদ মঈনদ্দীন আব্দুল্লাহ কমিশন। এখন তদন্ত করে দেখান যে, আপনাদের হৃদয় ওদের দ্বারা পলিউটেড হয়নি, ভালো পরিবেশ পেলে কাজ করতে পারেন। এটাই আপনাদের কাছে আমাদের ও সারা দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা।
উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগে বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশন ও প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে দুটি আলাদা আইনের খসড়া পাওয়া গেছে বলে জানান আইন উপদেষ্টা। তিনি বলেন, এই দুটি আইন অবলম্বনে উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগসংক্রান্ত আইনটি যত দ্রুত সম্ভব করা হবে। আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্য শেষে বের হওয়ার সময় সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এ কথা বলেন। দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনার নিয়োগে কত সময় লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, দুদকের ব্যাপারটা আমি দেখছি না। যারা দেখছেন বা যিনি দেখছেন তারা এ বিষয়ে সচেতন আছেন। দুদককে অচল রাখা যাবে না। এত বড় বড় দুর্নীতি হয়েছে দুদককে অবশ্যই সচল করতে হবে। বিশেষ অতিথির বক্তব্যে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, একদিকে দুদক দুর্নীতির সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। অন্যদিকে দুদকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা নিজেরা দুর্নীতিতে লিপ্ত হয়েছে। আমরা গবেষণা ও সংবাদমাধ্যমে এতদিন যা দেখে এসেছি, আজকে দুদক সংস্কার কমিশনের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে যেই ধরনের তথ্য পাচ্ছি সেটি অত্যন্ত বিব্রতকর। যা এতদিন জেনেছি তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি অনিয়ম, অনাচার, বৈষম্য, দুর্নীতি রয়েছে। এ সংস্থাটি ঢেলে সাজাতে সাঁড়াশি অভিযানের বিকল্প নেই বলেও মনে করেন তিনি।
‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা : গড়বে আগামীর শুদ্ধতা’ প্রতিপাদ্য নিয়ে দুদকের আয়োজনে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবসের আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন দুদক সচিব খোরশেদা ইয়াসমিন। এতে স্বাগত বক্তব্য দেন দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন।