Logo
Logo
×

প্রথম পাতা

বিআইডিএসের গবেষণা সম্মেলনে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ

আগামী বছর নির্বাচিত সরকার দেখা যাবে

সব টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে। ব্যাংকে জনগণ টাকা রেখেছেন। কিন্তু ব্যাংকের টাকা দেশে নেই * বেক্সিমকোসহ বড় বড় কোম্পানির ব্যালেন্স শিটে টাকা থাকলেও বাস্তবে নেই * দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অগণতান্ত্রিক -রেহমান সোবহান

Icon

যুগান্তর প্রতিবেদন

প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

আগামী বছর নির্বাচিত সরকার দেখা যাবে

ছবি: সংগৃহীত

পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, আগামী বছর রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকার দেখব বলে আশা করছি। নির্বাচিত সরকারবিষয়ক এই মত একান্তই আমার ব্যক্তিগত। শেষমেশ কী হবে, সেটি আমি জানি না। তিনি বলেন, বেক্সিমকোসহ বড় বড় কোম্পানিগুলোর ব্যালেন্স শিটে টাকা থাকলেও বাস্তবে দেশে টাকা নেই। সব টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে। ব্যাংকে জনগণ টাকা রেখেছেন। কিন্তু ব্যাংকের টাকা দেশে নেই। এই টাকা তো জনগণের। সম্পদের অভাবে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বেশি বরাদ্দ দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু বৈষম্য কমাতে হলে সামাজিক নিরাপত্তা, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো প্রয়োজন। শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) উদ্যোগে আয়োজিত বার্ষিক গবেষণা সম্মেলনের উদ্বোধনী অধিবেশনে তিনি এসব কথা বলেন। একই সম্মেলনে অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহান বলেছেন, সংসদ-সদস্যরা রাবার স্ট্যাম্পে পরিণত হয়েছিলেন।

৪ দিনের আন্তর্জাতিক গবেষণা সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছিলেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। এতে সভাপতিত্ব করেন বিআইডিএসের মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন। গবেষণাপত্র উপস্থাপন করেন বিশ্বব্যাংকের চিফ ইকোনমিস্ট ইন্ডারমিট এস গিল। এ সময় তিনি ‘দ্য মিডল ইনকাম ট্রাপ’ শীর্ষক একটি গবেষণা পত্র তুলে ধরেন।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, গত সরকারের আমলে যেসব প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, তার মধ্যে পদ্মা সেতুসহ বেশ কয়েকটি ভালো প্রকল্প আছে। কিন্তু এর অনেকগুলোই ‘প্রেস্টিজ প্রকল্প’ বা সুখ্যাতি অর্জনের জন্য নেওয়া হয়েছিল। এসব নিয়ে কী করা যায়, তা ভেবে দেখা হচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ কীভাবে সমতামূলক সমাজ নির্মাণ করতে পারে সে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার বড় ধরনের সম্পদের স্বল্পতায় আছে। অনেক টাকা দেশের বাইরে পাচার হয়েছে। এই বাস্তবতায় সমতামূলক সমাজ নির্মাণ কঠিন। সম্পদ স্বল্পতার মধ্যে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো কঠিন। এখন ডায়ালাইসিস মেশিন কেনা হবে নাকি জনস্বাস্থ্যে বিনিয়োগ করা হবে এটা নৈতিক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি মনে করেন, এই নৈতিক উভয় সংকটের জবাব অমর্ত্য সেন বা জন রলসের মতো অর্থনীতিবিদরাও দিতে পারবেন না।

ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ আরও বলেন, আমরা স্বল্পকালীন সময়ের জন্য এসেছি। তাই সবকিছু করা সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে বৈষম্য দূর করতে হলে গরিব মানুষদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। তেমনি ধনীদের কাছ থেকে কর আদায় বাড়াতে কর নীতিমালায় সংস্কার আনতে হবে। তিনি বলেন, আমরা ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ করব। কেউ বলছে এলডিসি থেকে বেরিয়ে আসা দরকার। আবার কেউ বলছেন এখনই নয়। কিন্তু আমি এক সময় জাতিসংঘের এই কমিটিতে ছিলাম বলে বিষয়টি জানি। আমরা যে অবস্থায় আছি এতে এলডিসি উত্তরণের বিকল্প নেই। তবে আমরা যেটি করতে পারি সেটি হলো-এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলেও উন্নত দেশগুলোকে বলতে পারি, আমাদের সক্ষমতা এখনো বাড়েনি। তাই রপ্তানি ক্ষেত্রে বিভিন্ন সুযোগ এবং জিএসপি প্লাস সুবিধা যেন দেওয়া হয়। তবে রানা প্লাজা ধসের পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রে আমরা জিএসপি সুবিধা পাচ্ছি না। আমাদের শিল্পগুলোকে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়াতে হবে। শুধু কম মজুরি, নিু প্রযুক্তি ইত্যাদি দিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখলে হবে না। পাশাপাশি সরকারের পক্ষে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করার উদ্যোগ নিতে হবে। আমাদের মতো অবস্থা থেকে যাত্রা শুরু করে ভিয়েতনাম আজ অনেক দূর এগিয়ে গেছে। তারা ৩০-৪০টি দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট করেছে। আমাদের এখনো একটি দেশের সঙ্গেও এই অ্যাগ্রিমেন্ট হয়নি। আন্তর্জাতিকভাবে যুক্ত হতে না পারলে আমরা টেকসই উন্নয়ন করতে পারব না। তিনি আরও বলেন, বৈষম্য দূর করতে হলে আমাদের মানবসম্পদকে দক্ষ করতে হবে। দেশের কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ৮০ শতাংশ শিক্ষক নেই। আবার সাধারণ শিক্ষায় জেলায় জেলায় এমনকি উপজেলা পর্যায়েও বড় বড় অবকাঠামো হয়েছে। আমি জানি না কবে কারিগরি শিক্ষার সংকট কাটবে। তিনি বলেন, আমাদের স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো দরকার। এ খাতে বরাদ্দ দিলে তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে। তবে বলা হয় বড় বড় হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বানাতে হবে, ডায়ালাইসিস মেশিন কিনতে হবে। কিন্তু দেখা যায় দক্ষ অপারেটরের অভাবে এসব যন্ত্রপাতি থাকলেও তা পড়ে থাকে। এখানে এক ধরনের ডিলেমা আছে।

অন্য এক অধিবেশনে ‘এজেন্ডা ফর ইকোনমিস অ্যান্ড সোশ্যাল রিফর্ম’ শীর্ষক পাবলিক লেকচারে, সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. রেহমান সোবহান বলেছেন, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো অগণতান্ত্রিক। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। সংসদ-সদস্যরা নিজ নিজ এলাকায় রীতিমতো জমিদার। ফলে স্থানীয় সরকার অকার্যকর হয়ে পড়েছিল। সেই সঙ্গে গত তিনটি নির্বাচন ছিল ত্রুটপূর্ণ। সেই নির্বাচনে নির্বাচিত সংসদ-সদস্যরা শুধু রাবার স্ট্যাম্পের মতো কাজ করতেন। ফলে অবসরে তারা ব্যবসা-বাণিজ্যসহ বিভিন্ন কাজে সময় ব্যয় করেছেন।

তিনি আরও বলেন, বিগত সরকারের জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান ও গুণগত মান নিয়ে অনেক বিতর্ক ছিল। তবে সেই সময় দেশে দারিদ্র্য বিমোচনের গতি ভালো ছিল বলে মন্তব্য করেন রেহমান সোবহান। দারিদ্র্যের বহুমুখী সূচকেও বাংলাদেশ ভালো করেছে। মানব উন্নয়নেও ভালো করেছে।

শ্বেতপত্র কমিটির প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। এ প্রতিবেদনেও দারিদ্র্যবিমোচনের বিষয়টি নিয়ে কেউ চ্যালেঞ্জ করেনি। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন উল্লেখযোগ্য। দারিদ্র্যের হার ৫৭ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২৫ শতাংশে নিয়ে আসা যে কোনো বিচারে তাৎপর্যপূর্ণ। এছাড়া পুষ্টিমান, শিশুমৃত্যু, পড়াশোনার সময়, পানযোগ্য পানির প্রাপ্যতা, আবাসন এসব ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। এ বাস্তবতায় তার মত, গবেষকদের কাজ হবে বাংলাদেশ প্যারাডক্সের নতুন রূপে সন্ধান করা। এতদিন সুশাসনের অভাবের মধ্যে কীভাবে প্রবৃদ্ধি হয়েছে, তা নিয়ে ছিল বিস্ময়। এখন দেখতে হবে, এ ধরনের অসম সমাজ ও অপশাসনের মধ্যে কীভাবে দারিদ্র্যবিমোচন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে এতটা ভালো করল বাংলাদেশ। তবে এই গবেষণা করতে গিয়ে অর্থনীতিবিদরা চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বেন। দেশে বৈষম্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে কাঠামোগত সমস্যা আছে। যেভাবে ঋণখেলাপিরা সুবিধা পেয়েছেন, সরকারের এ জাতীয় নীতি দেশে অসমতা বৃদ্ধি করেছে। অর্থনীতিবিদদের সমালোচনা করে রেহমান সোবহান বলেন, অসমতা পরিমাপের ক্ষেত্রে শুধু খানা আয়-ব্যয় জরিপের পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হচ্ছে; এর বাইরে কেউ যাচ্ছে না। তার মত, এ ক্ষেত্রে আয়করের বিবরণী গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর কারণ হিসাবে তিনি বলেন, ‘খানা আয়-ব্যয় জরিপে শীর্ষ আয়ের মানুষের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করা হয়েছে, তা হলো ১০ লাখ টাকার সম্পদ ও মাসিক ৩০ হাজার টাকা আয়। এ সম্পদ এবং আয় গুলশান ও বারিধারার বেশিরভাগ গাড়িচালকেরই আছে। এই মানদণ্ড বিচার করা হলে আমাদের মতো অনেক মানুষই পরিসংখ্যান থেকে হারিয়ে যাবে। ফলে গবেষকরা যা করছেন, তা মূলত আলংকারিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের। তিনি আরও বলেন, সমাজে বৈষম্য বাড়ছে। কিন্তু সেই বৈষম্যের চরিত্র যথাযথভাবে চিত্রিত হচ্ছে না। কোথায় কোথায় কোন খাতে বৈষম্য সৃষ্টি হচ্ছে, তা নিরূপণ করা গেলে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব।

ড. রেহমান সোবহান আরও বলেন, গত সরকারের সময় জাতীয় সংসদে অনেকে ব্যবসায়ী ছিলেন। ফলে তারা নীতিনির্ধারণে প্রভাব বিস্তার করেছেন। এজন্য সংসদ থেকে শুরু করে জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত একটি ক্রনিক ক্যাপিটালিজম তৈরি হয়েছে। এর ফলে সরকারের মধ্যেও অগণতান্ত্রিক মনোভাবের সৃষ্টি হয়। ড. রেহমান সোবহান বলেন, আমাদের রপ্তানি খাত শুধু পোশাক নির্ভর হলে চলবে না। রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। আমাদের নির্মাণ শিল্প ও সিরামিক শিল্পসহ অন্যান্য শিল্পগুলোকে এগিয়ে আনতে হবে। যখন বাজার কাজ করে না তখন রাষ্ট্রকে হস্তক্ষেপ করতে হয়। কিন্তু এখানে রাষ্ট্রই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। তিনি আরও বলেন, আমাদের দেশে আঞ্চলিক বৈষম্য আছে। বিশেষ করে রংপুর অঞ্চলে এ বৈষম্য অনেক বেশি। কিন্তু ঢাকা ও চট্টগ্রামে তেমন বৈষম্য নেই।

বিনায়ক সেন জানান, ৪ দিনে বিভিন্ন অধিবেশনে মোট ৩০টি গবেষণাপত্র এবং ১২টি পাবলিক লেকচার অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন, জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের মধ্যদিয়ে বৈষম্যবিরোধী মনোভাব আরও বড় হিসাবে দেখা দিয়েছে। সেই স্পিরিট সামনে রেখে বৈষম্য দূর করতে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করা দরকার।

ইন্ডারমিট এস. গিল ‘দ্য মিডল ইনকাম ট্রাপ’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে বলেন, বিশ্বব্যাপী অনেক দেশ মধ্য আয়ের ফাঁদে পড়ে আছে। প্রায় ৬০০ কোটি মানুষ আজ এই ফাঁদের শিকার। তারা এই সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। এই মধ্য আয়ের ফাঁদ থেকে বাঁচতে হলে মেধা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে এবং পুঁজির সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। উচ্চ আয়ের দেশের তুলনায় একটি মধ্যম আয়ের দেশে মন্দার সম্ভাবনা তিনগুণ বেশি থাকে। মধ্য আয়ের দেশে এমনিতেই পুঁজি কম থাকে। আবার যা থাকে সেটিরও ব্যবহার হয় কম। এই মধ্য আয়ের ফাঁদ বৈষম্য তৈরি করে। মধ্যম আয়ের দেশগুলো নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার কম করে। অপরদিকে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বেশি হয়। ফলে এসব দেশে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা বেশি থাকে। এই দেশগুলোতে গবেষণা কম হয়। ফলে অর্থনীতিতে সৃজনশীলতা কম থাকে। এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা জরুরি।

Jamuna Electronics

Logo

সম্পাদক : আবদুল হাই শিকদার

প্রকাশক : সালমা ইসলাম